প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্পে দুর্নীতি
নয় বছরেও আলোর মুখ দেখেনি উপকূলের ৭ রেডিও স্টেশন
প্রায় শতকোটি টাকা অনিয়মের অভিযোগ * পিডির বিরুদ্ধে অভিযোগ মহাপরিচালকের
মুহাম্মদ আবুল কাশেম
প্রকাশ: ০৮ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রতীকী ছবি
অনিয়ম ও দুর্নীতিতে আটকে আছে প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অনুমোদন পাওয়া উপকূলে নজরদারির জন্য রেডিও স্টেশন স্থাপনের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি বিশেষ প্রকল্প। উপকূল এলাকা থেকে দূর সাগরের ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত নজরদারির আওতায় আনার লক্ষ্যে ৭টি রেডিও স্টেশন স্থাপনে ২০১৪ সালে প্রকল্প হাতে নেয় নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়। ওই প্রকল্পের আওতায় ঢাকায় একটি ১১তলা ভবন ছাড়াও কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, কুতুবদিয়া, নিঝুম দ্বীপ, কুয়াকাটা, চরকুকরি-মুকরি, দুবলারচরে সাতটি কোস্টাল রেডিও স্টেশন হওয়ার কথা। প্রতিটি সাইটে ২টি ভবন ও একটি টাওয়ার বসবে। প্রকল্পটির বাজেট ধরা হয় প্রায় ৭৭৯ কোটি টাকা। যার অংশীদার কোরিয়া থাকলেও ৬০ শতাংশের বেশি বাংলাদেশের বিনিয়োগ।
কিন্তু নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কবলে পড়া প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্পটিতে একে একে ৩ দফায় আরডিপিপি সংশোধনী আনা হয়েছে। সবশেষ তৃতীয় সংশোধনী অনুমোদিত প্রকল্পের মেয়াদ ২০২২ থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। কনসালটেন্ট, কোরিয়ান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সামিহ কনস্ট্রাকশনের অসহযোগিতা এবং প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে কাজ তেমন এগোচ্ছে না। এখনো অবকাঠামোতে সীমাবদ্ধ। যে কারণে নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প সমাপ্তি নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে নৌপরিবহণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমোডর নিজামুল হক যুগান্তরকে বলেন, নির্মাণ সহযোগী প্রতিষ্ঠান কোরিয়ান সামিহ কনস্ট্রাকশন লি. ও বর্তমান প্রকল্প পরিচালকের বিভিন্ন দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের তথ্য পাওয়ায় নৌপরিবহণ অধিদপ্তরের একটি অভ্যন্তরীণ অডিট চলছে। সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালক, পরামর্শক প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পিএসসি সভায় উত্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দক্ষিণ কোরিয়ার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সামিহ পূর্তের (অবকাঠামো) কাজ এবং এলজি করবে আইসিটির কাজ। জিএমডিএসএস স্থাপনের জন্য ইজিআইএমএনএস প্রকল্পের আওতায় দক্ষিণ কোরিয়ান ঋণ ও জিওবি সহায়তায় ২০১৪ সালে সরকারি অনুমোদন পাওয়া প্রকল্পটি ২০১৬ সালে সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল।
মহাপরিচালক দপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০১৬-২০২০ সালের জুন পর্যন্ত প্রথম দফায় আরডিপিপি সংশোধনী আনা হয়। এ সময়ে প্রকল্প পরিচালক ছিলেন নৌপরিবহণ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী এসএম নাজমুল হক। তার সময় কাজ হয়েছে ১০ শতাংশের মতো। দুর্নীতির মামলায় বরখাস্ত হয়ে তিনি জেলে যান। দায়িত্বে আসেন একেএম জসিম উদ্দিন সরকার। তিনি ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে এখন অবসরে। তার বিরুদ্ধেও ৬২ কোটি টাকার অডিট আপত্তি ওঠে। তাতে প্রায় ১৩ কোটি টাকা আত্মসাৎ করার প্রমাণ পায় মন্ত্রণালয়ের অডিট কমিটি। এরই মধ্যে তিনি অবসর গ্রহণ করলে তার পেনশন আটকে রাখা হয়েছে।
এ অবস্থায় ২০২১ সালের ডিসেম্বরে পিডির দায়িত্ব নেন আবু সাইদ মো. দেলোয়ার রহমান। ২০২২ সালের জুন নাগাদ অবকাঠামোগত কাজের সর্বোচ্চ অগ্রগতি হয়েছে ৩৫ শতাংশ। গেল নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি-এ চার মাসে ৭০ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে। এরপর থেকে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে গতি বাধাগ্রস্ত হয়। এসব বিষয় জানিয়ে ২০ মার্চ নৌপরিবহণ সচিবকে চিঠি দেন মহাপরিচালক কমোডর নিজামুল হক।
প্রকল্প পরিচালক আবু সাইদ মো. দেলোয়ার রহমানকে প্রতিস্থাপন প্রসঙ্গে পাঠানো ওই পত্রে তিনি উল্লেখ করেন, আগামী জুনের মধ্যে পূর্তের কাজ শেষ করা না হলে ইকুইপমেন্ট স্থাপনসহ প্রকল্প ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে সম্পন্ন করা অসম্ভব মনে হচ্ছে। প্রকল্পের গতি ত্বরান্বিত এবং সঠিক সময়ে বাস্তবায়নের স্বার্থে অসহযোগিতা ও অদক্ষতার দায়ে কোরিয়ান কনসালটেন্ট মি. পিটারকে ২০২২ সালের অক্টোবরে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
সামিহ কনস্ট্রাকশনের স্থানীয় কর্মকর্তাদের অনিয়ম ও অসহযোগিতার জন্য সতর্ক করে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কাজ না করে ঠিকাদারদের বিল প্রদান, মালামাল না কিনে বিল পরিশোধের মতো মারাত্মক অভিযোগও আছে। প্রকল্প পরিচালক দায়িত্ব¡ গ্রহণের সময় বা পরে কোনো উদ্যোগ না নিয়ে দোষী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে দিয়েই প্রকল্পের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ আসছে।
এসব বিষয় সামনে আসায় ঠিকাদারদের অর্থছাড় বন্ধ করে দেন প্রকল্প পরিচালক। যে কারণে কাজের গতি কমে আসে, এমনটি অভিযোগ। কোরিয়ান ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের ২ নাগরিক মি. কেসপার ও মি. হার, পিডি আবু সাইদ মো. দেলোয়ার রহমানসহ তার অফিসের কয়েকজন অসাধু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে।
নৌ-অধিদপ্তরের মহাপরিচালক দপ্তর সূত্রে জানা যায়, কোরিয়ান ওই ২ নাগরিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে ব্যবস্থা নিতে তাদের প্রতিষ্ঠানকে পত্র লেখেন মহাপরিচালক কমোডর মো. নিজামুল হক। পাশাপাশি পিডিকে প্রতিস্থাপনের জন্য মন্ত্রণালয় বরাবর চিঠিও পাঠান। মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে পিএসসি সভা আহ্বান করে ৩ এপ্রিল। ১০ দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত জানানোর কথা। কিন্তু এখনো কোনো সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি। ইতোমধ্যে গেল ২৫ এপ্রিল পিডি আবু সাইদ মো. দেলোয়ার রহমান নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন।
ইমিগ্রেশন সূত্রে জানা যায়, কোরিয়ান ওই ২ নাগরিক ২০১৯ সাল থেকে ভিসা জালিয়াতি করে ট্যাক্স ও ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশে অবৈধভাবে অবস্থান করছেন। এ বিষয় জানিয়ে তাদের পাসপোর্টসহ ইমিগ্রেশনে হাজির করতে অতিরিক্ত মহাপুলিশ পরিদর্শকের কাছে (এসবি) পত্র দেওয়া হয়।
অনুসন্ধান বলছে, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সিল ও লোগো জালিয়াতি করে ভুয়া অনুমোদনের মাধ্যমে আগারগাঁওয়ের ১১তলা ভবনে ‘ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম’ বসানো হয়। যেখানে কোরিয়ান ২ নাগরিক, সিনার্জি লজিস্টিকসের গফফার সম্পৃক্ত। পিডি আবু সাঈদ মো. দেলোয়ার রহমানের সঙ্গে বিপ্লব জলিল ও প্রতীক প্রবণ দাস জড়িত বলে জানা গেছে।
জিওবি তহবিলের কোনো বিল-ভাউচার জমা করেন না পিডি। ১৪ জুলাই বালুর স্থলে ড্রেজিংয়ের কাদা-মাটি দিয়ে জমি ভরাট করে ৬ কোটি ৫৭ লাখ টাকার একটি বিল মহাপরিচালকের অনুমোদন ছাড়া গোপনে প্রকল্প পরিচালক নিজে অনুমোদন দিয়ে পাশ করিয়ে নেন। এছাড়া ডিপিপি-এর জিসিসি ও এসসিসি-এর অধিকাংশ কন্ট্রাক্ট ক্লজ ভঙ্গ করে প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এদিকে শতকোটি টাকার অনিয়ম যখন দৃশ্যমান হয়, তখন পিডি আবু সাইদকে অপসারণ ও নতুন পিডি নিয়োগের জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠান মহাপরিচালক কমোডর নিজামুল হক। কিন্তু এখনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পদত্যাগপত্র দিয়েও বহাল তবিয়তে পিডি।
এ বিষয়ে কমোডর নিজামুল যুগান্তরকে বলেন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ১২১ কোটি টাকা জিওবি থেকে খরচ হয়েছে। যেখানে অধিকাংশের বিল ভাউচার নেই। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৭ কোটি টাকার মতো খরচ করেছেন পিডি। সরকারি তহবিলের টাকা খরচের হিসাব বছর অনুযায়ী। ২২-২৩ অর্থবছরে সাড়ে ৫ কোটি টাকার একটি ব্যয়ে আমার অনুমোদন আছে। ১২ কোটি পিডি করেছেন। বাকি সব অনুমোদন পিডি কীভাবে খরচ করেছেন, আমার জানা নেই। খরচের ভাউচার জমা দিতে বললে এখনো জমা দেননি।
তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালক, পরামর্শক প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পিআইসি সভায় উত্থাপন করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। তবে কোরিয়ান নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের চার সদস্যকে প্রকল্প থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।
তবে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোস্তাফা কামাল যুগান্তরকে বলেন, এ প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি হয়নি। এর চেয়ে বেশি যদি জানতে চান, তাহলে প্রকল্প পরিচালকের সঙ্গে কথা বলুন।
অভিযোগ প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক আবু সাইদ মো. দেলোয়ার রহমানের কাছে জানতে চাইলে প্রতিবেদকের পরিচয় পাওয়ার পর কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করে দেন। পরে এক ব্যক্তি নিজের পরিচয় গোপন রেখে ০১৭১২২২২৫৯৬ নম্বর থেকে প্রতিবেদকের ব্যক্তিগত হোয়াটসঅ্যাপে কল করে নৌপরিবহণ প্রতিমন্ত্রী ও সচিবের ভয় দেখিয়ে সংবাদ প্রকাশে বিরত থাকতে বলেন। অন্যথায় সমস্যা হবে বলে হুমকি দেন।