‘রেললাইন বাঁকা হয়ে যাওয়া’
রক্ষণাবেক্ষণই দায়ী রোদের তাপে নয়!
এমন দুর্ঘটনা মূলত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে হচ্ছে-ড. এম শামসুল হক * রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ঘটলে সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে-রেলপথ সচিব
শিপন হাবীব
প্রকাশ: ০৪ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রোদের তাপে ‘রেল লাইন বাঁকা’ হচ্ছে। এর পক্ষে-বিপক্ষে উঠছে নানা যুক্তি। কর্তৃপক্ষ বলার চেষ্টা করছে নেপথ্য কারণ রোদের তাপ। আর বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্টদের দাবি-রক্ষণাবেক্ষণের কারণেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রেললাইন এলাকায় বসবাসরত মানুষের প্রশ্ন-হাওড়-বিল ঘিরে চলা উন্মুক্ত লাইন বাঁকা হচ্ছে না
। কিন্তু দুপাশে সবুজ গাছপালা ঘেরা রেললাইন কেন বাঁকা হচ্ছে? সারা দেশে প্রায় ৪ হাজার কিলোমিটার রেলপথ। অর্ধেকেরও বেশি পশ্চিমাঞ্চলে বাকি লাইন পূর্বাঞ্চলে। সাধারণত পশ্চিমাঞ্চলে তাপমাত্রা যখন ৪২-৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস, তখন পূর্বাঞ্চলে থাকে ৩৭-৩৮ ডিগ্রি। অথচ লাইন ‘বাঁকা’র ঘটনা ঘটছে শুধু পূর্বাঞ্চল রেলে। পাশাপাশি বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য-পূর্বাঞ্চল রেল সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। জরাজীর্ণ রেলে ঊনিশ থেকে বিশ হলেই লাইনচ্যুত-দুর্ঘটনা ঘটছে। পাথরস্বল্পতা, লাইনে নড়বড়ে স্লিপার, ক্ষয়প্রাপ্ত লাইন, নাট-বল্টু, ক্লিপ, হুক ও ফিশপ্লেট পদে পদেই খোলা থাকে। রক্ষণাবেক্ষণ হয় না বছরের পর বছর। যার কারণেই মূলত রেললাইন বাঁকা হয়ে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শীত অথবা গরমকালে কোনো দুর্ঘটনার (লাইনচ্যুত) পর ২০০-৩০০ ফুট লাইন আঁকাবাঁকা হয়ে যায়। কর্তৃপক্ষের অজুহাত, গরম কালে ‘রোদের তাপে লাইন বাঁকা’ হয়ে পড়ছে। বাঁকা লাইনে ট্রেন লাইনচ্যুত হচ্ছে। কিন্তু যে লাইন ‘রোদে বাঁকা’ হচ্ছে, ওই লাইন ঘেঁষেই অন্য একটি লাইন সমান্তরালে চলে। পাশের লাইনটিতেও একই রোদের তাপ পড়ছে-কিন্তু বাঁকা হচ্ছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক যুগান্তরকে বলেন, রেললাইনে দুর্ঘটনা কিংবা লাইন বাঁকা হওয়ার ঘটনায় অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা রয়েছে। মূলত এরকম ঘটনা রক্ষণাবেক্ষণ ও ত্রুটির কারণেই হচ্ছে। আমাদের দেশ নাতিশীতোষ্ণ। তীব্র তাপমাত্রার কোনো দেশ নয় বাংলাদেশ। আমাদের রেলে সবচেয়ে বড় ঘাটতি হচ্ছে রক্ষণাবেক্ষণের অভাব। অনিয়ম-দায়িত্বহীনতা। রেলপথকে যথাযথ রাখতে হলে পুরো পথের লোহার লাইনের দুপাশে পর্যাপ্ত পাথর, হুক, ক্লিপ, ফিশপ্লেট, স্লিপার শত ভাগ নিশ্চিত করতে হবে। পথ শতভাগ নিশ্চিত হবে, এজন্যই তো অর্থ বরাদ্দ হয়। কিন্তু, সেই অর্থ বরাদ্দের সুফল কি পাওয়া যাচ্ছে?
ড. এম শামসুল হক বলেন, লাইনের জয়েন্টসহ গুরুত্বপূর্ণ ফিটিংগুলোই নড়বড়ে। আবার কোনো এলাকায় খালি চোখে সব ঠিক আছে দেখা গেলেও হয়তো কার্যকর নেই। রোদের তাপ বিষয়ে যদি রেল কর্তৃপক্ষ বলে থাকেন, তাহলে তাদের বুঝতে হবে রেলপথকে রোদ প্রতিরোধে প্রস্তাব করা, তা কী করা হচ্ছে। লাইন যখন সম্প্রসারিত হওয়ার জায়গা পায় না তখনই লাইন বাঁকা হয়। সেটি রোদের তাপ ছাড়াও হবে। পুরাতন লাইনের টেম্পার না থাকলেও এমনটা হয়।
সরেজমিন দেখা যায়-সিলেট, ভৈরব, আখাউড়া লাইনে ‘রোদে লাইন বাঁকা’ হওয়ার ঘটনা সবচেয়ে বেশি। এক যুগ ধরেই এসব এলাকায় এমন ঘটনা ঘটছে। যতদিন যাচ্ছে এসব স্থানের রেলপথ আরও জরাজীর্ণ হচ্ছে। আখাউড়া-সিলেট লাইনের অধিকাংশ স্থানে পাথরস্বল্পতায় রেলপথের মধ্যস্থানে ঘাস উঠে আছে। পাশাপাশি কোনো কোনো স্থানে হুক, ক্লিপ, ফিশপ্লেট খোলা আছে। একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে ভৈরব থেকে আখাউড়া এবং আখাউড়া থেকে কুমিল্লা রেলপথে। ২৭ এপ্রিল ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট রেলপথে ব্রাহ্মণবাড়িয়া দাড়িয়াপুর এলাকায় একটি মালবাহী ট্রেনের ৭টি বগি লাইনচ্যুত হয়। পাশেই আরেকটি লাইন ছিল, ওই লাইন দিয়ে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক ছিল। স্থানীয় সূত্র বলছে, পাশের লাইনটি কিছুটা ভালো রয়েছে। যে লাইনে লাইনচ্যুত হয়েছে, সেটি জরাজীর্ণ ছিল। ৩০ এপ্রিল একই স্থানে আবারও লাইন আঁকাবাঁকা হয়। স্থানীয় সূত্র এটাও বলছে, জরাজীর্ণ লাইনে রোদের তাপও আঘাত আনতে পারে।
পূর্বাঞ্চল রেলের এক প্রকৌশলী যুগান্তরকে জানান, পূর্বাঞ্চল রেলে ৩০-৪০ বছর আগেরও লাইন রয়েছে। রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে, কিন্তু পরিপূর্ণভাবে করা সম্ভব হচ্ছে না। শুধু রোদে নয়, নানা কারণেই লাইনচ্যুত হচ্ছে। পাশের লাইনটি বাঁকা না হয়ে ডাউন লাইনটি ‘বাঁকা; হলো কেন? যে লাইনে লাইনচ্যুত হয়েছে, নিশ্চয় সিটি দুর্বল ছিল। যথাযথ ফিটিং এবং শতভাগ রক্ষণাবেক্ষণ থাকলে এমন দুর্ঘটনা এড়ানো যেত। দুর্ঘটনার কারণ জানতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত রিপোর্টে নিশ্চয় প্রকৃত কারণ বেরিয়ে আসবে।
এদিকে ‘রোদে লাইন বাঁকা’ বিষয়ে সম্প্রতি রেলভবনে বিশেষ বৈঠক ডাকা হয়েছিল। ওই বৈঠকে রেলপথমন্ত্রী, সচিব, রেলওয়ে মহাপরিচালক উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে জরাজীর্ণ রেললাইন এবং দায়িত্ব অবহেলাসহ নানা বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বৈঠকে উপস্থিত এক কর্মকর্তা জানান, পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী তার নির্ধারিত এলাকা নিয়ে কথা বলেন। তিনি জানিয়েছেন, পশ্চিমাঞ্চল রেলের বেশ কয়েকটি জেলায় তাপমাত্রা ছিল ৪২ থেকে ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। ওই এলাকায় থাকা রেললাইন বাঁকা হয়নি। রেললাইন বাঁকা হয়ে কোনো ট্রেন লাইনচ্যুতির ঘটনাও ঘটেনি।
পূর্বাঞ্চল রেলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (রেলপথ) মোহাম্মদ আরমান যুগান্তরকে বলেন, দুর্ঘটনার পর আমরা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় লোকবল রেখেছি। রোদ কিংবা যে কোনো কারণে লাইন বাঁকা কিংবা ঝুঁকির মধ্যে পড়লে, তাৎক্ষণিকভাবে মেরামতের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আপৎকালীন যন্ত্রাংশ কিংবা মালামাল রেলে রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি লাইনকে নিরাপদ করতে। ঝুঁকির স্থানগুলোতে গতি কমিয়ে ট্রেন চালানো হচ্ছে।’
ওই বৈঠকে উপস্থিত পশ্চিমাঞ্চল রেলের প্রধান প্রকৌশলী আসাদুল হক যুগান্তরকে বলেন, লাইন বাঁকা কিংবা দুর্ঘটনা রোধে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। পশ্চিমাঞ্চলে রোদের তাপ সবচেয়ে বেশি। ঈশ্বরদী, চুয়াডাঙ্গা, কালীগঞ্জসহ বিভিন্ন রেল এলাকায় সারা বাংলাদেশের চেয়ে তাপমাত্রা বেশি ছিল। ওই সময় তাপমাত্রা ছিল ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি। ওই এলাকায় রেললাইন আছে, কোনো রেললাইন বাঁকা কিংবা লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটেনি।
এদিকে রেলভবনে বসা রেল পরিকাঠামোর ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, গরমে নয়, শীতেও লাইন বাঁকা হয়ে লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটছে। কারণ, চলমান অধিকাংশ লাইনের নির্ধারিত স্থানে যে ফাঁকা অংশ রয়েছে, তা যথাযথ নয়। ফাঁকা অংশ ট্রেনের চাকার ঘর্ষণে ভরাট হয়ে পড়ছে। আবার কোনো কোনো ফাঁকা অংশে পাথর পড়ে আছে। লোহার লাইনে দীর্ঘদিন ট্রেন চলাচল করলে স্বাভাবিক নিয়মেই সামান্য লম্বা হয়। লম্বা হবে এ কারণেই লাইনের নির্ধারিত স্থান পরপর ফাঁকা রাখা হয়। তাছাড়া ফাঁকার সঙ্গে সিপ্লার, হুক, ক্লিপ, ফিশপ্লেটও যথাযথ থাকতে হয়। রেললাইনে মাইলের পর মাইল ক্ষণেক্ষণেই এসব গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশগুলো খোলা থাকে।
রেলপথ মন্ত্রণালয় সচিব ড. মো. হুমায়ুন কবীর যুগান্তরকে বলেন, এমন দুর্ঘটনা নিশ্চয় উদ্বেগের। তবে বিষয়টি যেহেতু টেকনিক্যাল, তাই এ বিষয়ে পুরোপুরি না জেনে বলতে চাচ্ছি না। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এমনটা হলে নিশ্চয় সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহি করতে হবে। আমরা বিষয়টি দেখছি।