Logo
Logo
×

শেষ পাতা

ছিনতাই তেজগাঁওয়ে বেশি, খুন ডাকাতি ওয়ারীতে

Icon

সিরাজুল ইসলাম

প্রকাশ: ০১ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ছিনতাই তেজগাঁওয়ে বেশি, খুন ডাকাতি ওয়ারীতে

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) আটটি অপরাধ বিভাগের মধ্যে ওয়ারীতে খুনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে। সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যাও এখানে বেশি। এই বিভাগের থানাগুলো হলো-ওয়ারী, ডেমরা, শ্যামপুর, যাত্রাবাড়ী, গেণ্ডারিয়া এবং কদমতলী। অপরদিকে চুরি-ডাকাতি আর ছিনতাইয়ের ঘটনা বেশি ঘটে তেজগাঁও বিভাগে। এ বিভাগের থানাগুলো হলো-তেজগাঁও, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, মোহাম্মদপুর, আদাবর শেরেবাংলা নগর এবং হাতিরঝিল। চাঁদাবাজিতে এগিয়ে মিরপুর বিভাগ। পুলিশ আক্রান্তের ঘটনাও এখানে তুলনামূলক বেশি। নারী নির্যাতনের ঘটনা বেশি ঘটে মতিঝিলে। বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের বেশি মামলা হচ্ছে লালবাগ বিভাগে। ডিএমপির ৫০টি থানা নিয়ে গঠিত আটটি বিভাগের কোন এলাকায় কী ধরনের অপরাধ বেশি ঘটে যুগান্তরের পক্ষ থেকে তা বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

রাজধানীর থানাগুলোর অপরাধ পরিসংখ্যান ঘেঁটে জানা যায়, গত ১৫ মাসে সর্বোচ্চ ৪৩টি খুনের ঘটনা ঘটেছে ওয়ারী বিভাগে। এখনে প্রায়ই চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। ৩ এপ্রিল ও ১৩ মার্চ ডেমরা থানার আমুলিয়া মডেল টাউন এলাকায় ঘটে স্পর্শকাতর দুটি খুনের ঘটনা। নিহত দুজনই ছিলেন অটোচালক।

ডেমরার স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আবদুস সালাম যুগান্তরকে বলেন, গত দেড় বছর ধরে এই এলাকায় একের পর এক লাশ ফেলে যাচ্ছে খুনিরা। বেশ কয়েকজন নারীর লাশও আছে। কোনো কোনো সময় লাশের পরিচয়ও মিলছে না। এতে এলাকায় আমরা আতঙ্কে আছি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) জিয়াউল আহসান তালুকদার যুগান্তরকে বলেন, অনেক সময় অন্য এলাকায় খুনের পর লাশ আমার এলাকায় ফেলে যাচ্ছে। কখনো দেখা যাচ্ছে, লাশ অন্য এলাকা থেকে ভেসে ডেমরার নিচু এলাকায় আসছে। আবার কখনো আত্মহত্যা হলেও বাদীর চাপের কারণে হত্যা মামলা নিতে হচ্ছে। এই কারণে আমার এলাকায় খুনের মামলা তুলনামূলক বেশি হচ্ছে। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ১৫ মাসে দস্যুতা বা ছিনতাইয়ের সর্বোচ্চ ৪৪টি ঘটনা ঘটেছে তেজগাঁও বিভাগে। নির্ধারিত সময়ে এই বিভাগে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে আটটি। যা অন্যান্য বিভাগের চেয়ে বেশি। এক বছরে ডিএমপির এক হাজার ৬০৩টি চুরির মামলার মধ্যে তেজগাঁও এলাকায় হয়েছে ৩৫৯টি। মাদক, চোরাচালান, অস্ত্র এবং বিস্ফোরক উদ্ধারের ঘটনাও তেজগাঁওয়ে ঘটছে বেশি। এ সংক্রান্ত ১৬ হাজার ৪০০ মামলার মধ্যে তেজগাঁও বিভাগে হয়েছে দুই হাজার ৭৮৬টি। কে কখন ছিনতাইয়ের শিকার হন, তা নিয়ে আতঙ্কে থাকেন এই এলাকার বাসিন্দারা।

জানা গেছে, ডিএমপিতে সংরক্ষিত পরিসংখ্যানই রাজধানীর অপরাধের প্রকৃত চিত্র নয়। প্রকৃত ঘটনা আরও অনেক বেশি। যেসব ঘটনায় মামলা হয়েছে সেসব ঘটনাই শুধু এই পরিসংখ্যানে এসেছে। এর বাইরের ঘটনাগুলো এই পরিসংখ্যানে উঠে আসেনি।

তেজগাঁও বিভাগের হাতিরঝিল থানার মহানগর আবাসিক এলাকার বাসিন্দা জহিরুল ইসলাম বিপ্লব যুগান্তরকে বলেন, এই এলাকায় সাম্প্রতিক সময়ে সিরিজ চুরির ঘটনা ঘটছে। গত এক মাসে চারটি চুরির ঘটনা আমাদের আতঙ্কের মধ্যে ফেলেছে। পুলিশের কাছে সিসি ক্যামেরা ফুটেজসহ মামলার এজাহার নিয়ে গেলেও পুলিশ মামলা নিচ্ছে না। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক কয়েকটি চুরির ঘটনায় ৮ নম্বর রোডের বাসিন্দা এসকে ওসমান, ৮৭ নম্বর রোডের বাসিন্দা আব্দুল হাই, ২ নম্বর রোডের কাজল বেগম এবং ৮ নম্বর রোডের মনির হোসেন এজাহার দাখিল করলেও পুলিশ মামলা রেকর্ড করেনি। এখন তারা মামলা রেকর্ডের জন্য উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।

মোহাম্মদপুর থানার রায়ের বাজার এলাকার বাসিন্দা আব্দুল ওহাব জানান, মাদকের টাকা জোগাড় করতে অনেকেই চুরি-ডাকাতিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। ঢাকা উদ্যান এলাকার বাসিন্দা আবুল হাসমত মিয়া জানান-সুনিবিড় হাউজিং, তুরাগ হাউজিং, নবোদয় হাউজিং, ঢাকা উদ্যান হাউজিং, নবীনগর হাউজিং এবং চাঁদ উদ্যানসহ বিভিন্ন স্থানে ছিনতাই যেন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। ঈদের ছুটিতে এখানে বেশ কয়েকটি চুরির ঘটনাও ঘটেছে। মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকার বাসিন্দা আবু বকর সিদ্দীক জানান, মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড ও বসিলা এলাকায় সকাল-সন্ধ্যায় মানুষ ছিনতাইয়ের কবলে পড়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন।

এ বিষয়ে পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) এএইচএম আজিমুল হক যুগান্তরকে বলেন, তেজগাঁও বিভাগের মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকায় ভাসমান লোক বেশি থাকে। অন্য এলাকা থেকে অপরাধীরা এখানে এসে অপরাধ করে পালিয়ে যায়। অনেক আগে থেকেই এলাকাটি অপরাধপ্রবণ। গত ছয় মাসে এখানকার অপরাধ অনেকটা কমে এসেছে। অন্যান্য বারের চেয়ে গত রমজানে এখানে অপরাধ কম হয়েছে। তিনি আরও বলেন, কোনো ঘটনা ঘটলে অবশ্যই মামলা হবে। অপরাধ ঘটার পরও যদি কোনো থানা মামলা না নেয় তাহলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ডিএমপির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রাজধানীতে মামলার সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। বাড়ছে পুলিশ আক্রান্তের সংখ্যাও। তবে গ্রেফতারের সংখ্যা তুলনামূলক কমছে। ২০২২ সালে মোট মামলা হয়েছে ২৮ হাজার ৭৪৯টি। ২০২১ সালে ছিল ২৭ হাজার ৪৬১টি। পরিসংখ্যান বলছে, রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি মামলা হয় মাদকসংক্রান্ত বিষয়ে। এর পরে রয়েছে ডাকাতি ও চুরির ঘটনা। ২০২১ সালে ডাকাতির ঘটনায় মামলা হয়েছে ১৬৮টি। একই অপরাধে ২০২২ সালে মামলা হয় ১৭২টি। ২০২১ সালে চুরির ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৯৮৬টি। আর ২০২২ সালে হয় ২ হাজার ৩১৬টি মামলা।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন অপরাধে ২০২২ সালে ডিএমপি প্রায় ৫০ হাজার আসামিকে গ্রেফতার করে। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে গ্রেফতার করে ৪২ হাজার ৩৬৯ জনকে। ডিএমপির হিসাব বলছে, রাজধানীতে অপরাধ দমন করতে গিয়ে ২০২১ সালে ৬৯ পুলিশ আক্রান্ত হয়েছে। ২০২২ সালের দুষ্কৃতকারীদের হামলার শিকার হন ৮৮ জন পুলিশ সদস্য। তথ্য বলছে, ২০২২ সালে ডিএমপিতে মাদক ও উদ্ধারজনিত ঘটনায় ১৬ হাজার ৪০০টি মামলা হয়েছে। এছাড়াও ডাকাতির ঘটনায় ১৭২টি, হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ১৭৩টি, দ্রুত বিচারে ১৬৫টি, দাঙ্গা সংক্রান্ত আটটি, নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় ২ হাজার ১২টি, অপহরণ সংক্রান্ত ৪৯টি, চুরির ঘটনায় ২ হাজার ৩১৬টি ও অন্যান্য ঘটনায় ৭ হাজার ৩৬৬টি মামলা হয়।

ডিএমপি সদর দপ্তর থেকে প্রাপ্ত চলতি বছরের প্রথম ৩ মাসের অপরাধ চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এই সময়ে রাজধানীতে মোট মামলা হয়েছে ৪ হাজার ৩৩৯টি। এর মধ্যে অস্ত্র আইন, মাদক এবং চোরাচালান উদ্ধারজনিত মামলা হয়েছে ২ হাজার ৪৯৯টি। চুরির মামলা হয়েছে ২৩০ টি। পুলিশ আক্রান্তের ঘটনা ঘটেছে ১০টি। নারী ও শিশু নির্যাতনে ঘটনায় মামলা হয়েছে ২৪৮টি।

২০২২ সালের অপরাধ চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ডাকাতির সর্বোচ্চ পাঁচটি মামলা হয়েছে তেজগাঁও বিভাগে। ওই মাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চারটি ডাকাতির মামলা হয়েছে উত্তরা বিভাগে। উত্তরা বিভাগের থানাগুলো হলো-উত্তরা পশ্চিম, এয়াপোর্ট, তুরাগ, উত্তরখান, দক্ষিণখান এবং উত্তরা পূর্ব থানা। গত বছর ডিএমপিতে দস্যুতা বা ছিনতাইয়ের সর্বোচ্চ ৩৯টি মামলা হয় তেজগাঁও বিভাগে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৩টি ছিনতাইয়ের মামলা হয় মতিঝিল বিভাগে। মতিঝিল বিভাগের থানাগুলো হলো-মতিঝিল, সবুজবাগ, খিলগাঁও, পল্টন, রামপুরা, মুগদা এবং শাহজাহানপুর। ওই বছর ছিনতাইয়ের তৃতীয় সর্বোচ ২২টি মামলা হয়েছে রমনা বিভাগে। এই বিভাগের থানাগুলো হলো-রমনা মডেল, ধানমন্ডি, শাহবাগ, নিউমার্কেট, হাজারীবাগ এবং কলাবাগান। মিরপুর মডেল, পল্লবী, কাফরুল, শাহ আলী, দারুস সালাম, রূপনগর এবং ভাষানটেক থানা নিয়ে গঠিত মিরপুর বিভাগ। এই বিভাগে গত বছর ছিনতাইয়ের ২০টি মামলা হয়েছে। এছাড়া নির্ধারিত বছরে ওয়ারীতে ১৫, উত্তরায় ১১, লালবাগে ৮ এবং মিরপুরে ৭টি ছিনতাইয়ের মামলা হয়েছে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, গত বছর ওয়ারী বিভাগে খুনের মামলা হয়েছে ৩৭টি। মিরপুরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩১ এবং মতিঝিল ও গুলশানে তৃতীয় সর্বোচ্চ ২১টি করে খুনের মামলা হয়েছে। গুলশান বিভাগের থানাগুলো হলো-গুলশান, ক্যান্টনমেন্ট, বাড্ডা, খিলক্ষেত, বনানী এবং ভাটারা। ওই বছর উত্তরা এবং লালবাগ বিভাগে ১৭টি করে খুনের মামলা হয়। লালবাগ বিভাগের থানাগুলো হলো-লালবাগ, কোতোয়ালি, বংশাল, কামরাঙ্গীরচর, চকবাজার এবং সূত্রাপুর। এছাড়া গত বছর রমনায় ১৬টি এবং তেজগাঁওয়ে ১৩টি খুনের মামলা হয়েছে। ৫৯টি চাঁদাবাজির মামলার মধ্যে মিরপুর বিভাগেই হয় ৩৬টি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৩টি চাঁদাবাজির মামলা হয়েছে ওয়ারীতে। দ্রুত বিচার আইনের ১৬৫টি মামলার মধ্যে মিরপুরেই হয়ে ৫০টি। এই আইনে তেজগাঁওয়ে ৩৪, উত্তরায় ৩০ এবং ওয়ারীতে ২৭টি মামলা হয়েছে।

পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে জানা যায়, নারী নির্যাতনের ঘটনায় ২০২২ সালে হওয়া ৪০৫টি মামলার মধ্যে ৯৭টিই হয়েছে মতিঝিল বিভাগে। এ সংক্রান্ত উত্তরা বিভাগে সবচেয়ে কম ৯টি মামলা হয়েছে। অপহরণের ৪৯টি মামলার মধ্যে ১০টিই হয়েছে মিরপুর বিভাগে। পুলিশ আক্রান্তের ৮৮টি ঘটনার মধ্যে ২০টি হয়েছে মিরপুরে। বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের ১২৬টি মামলার মধ্যে ৬১টিই হয়েছে লালবাগ বিভাগে। ৩৭১টি সড়ক দুর্ঘটনার মধ্যে ওয়ারীতে সর্বোচ্চ ৬২টি ঘটনা ঘটেছে। গুলশান এবং মতিঝিলে ৫৬টি করে দুর্ঘটনা ঘটেছে। রমনায় ৪৬টি এবং ৪৪টি করে ঘটনা ঘটেছে তেজগাঁও ও মিরপুর বিভাগে। এছাড়া উত্তরায় ৪২টি এবং লালবাগে ২১টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে।

প্রতিবছর সারা দেশে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক গরু চুরির ঘটনা ঘটে। রাজধানীতে সে অনুযায়ী গরু চুরির ঘটনা না ঘটলেও প্রতিবছরই বেশ কয়েকটি করে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। ২০২২ সালে ছয়টি গবাদি পশু চুরির ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় গুলশানে তিনটি, উত্তরায় দুটি এবং ওয়ারীতে একটি মামলা হয়েছে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম