বরিশালে মাঠে নেই সাদিক সমর্থকরা
লাঙ্গল-হাতপাখার নজর এখন বিএনপির ভোটে
আকতার ফারুক শাহিন, বরিশাল
প্রকাশ: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জয়পরাজয়ের ফ্যাক্টর বিএনপির ভোটে নজর এখন বরিশালের লাঙ্গল আর হাতপাখার প্রার্থীর। তাদের বক্তব্য আর কর্মকাণ্ডে ক্রমেই পরিষ্কার হয়ে উঠছে তা। নির্বাচনি প্রচার-প্রচারণা প্রশ্নে তাদের দুজনের মুখেই এখন আওয়ামী লীগবিরোধী বক্তব্য।
বিএনপির ভোটারদের পক্ষে আনতেই এমন কৌশল বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। অবশ্য তাতে ভোটারদের আস্থা কতটা মিলবে বলা মুশকিল। তবে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপির ভোটেই জয়পরাজয় নির্ধারণ হবে, সেটা নিশ্চিত। কেননা এখানে বিএনপির ভোট অন্য সব রাজনৈতিক দলের মোট ভোটের চেয়েও বেশি।
এদিকে দলীয় মনোনয়ন ঘোষণার দুই সপ্তাহ পরও নৌকার পক্ষে মাঠে নামেননি বর্তমান মেয়র মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাদিক আব্দুল্লাহর অনুসারীরা। যদিও এ নিয়ে মাথাব্যথার কোনো লক্ষণ নেই নৌকার প্রার্থী খোকন সেরনিয়াবাতের মধ্যে।
বরিশালের সর্বস্তরের মানুষ সাথে আছেন এমনটাই বিশ্বাস তার। এখন পর্যন্ত সাদিকবিরোধী বলয় নিয়েই নৌকার নির্বাচনি প্রচারণা চালাচ্ছেন তিনি।
২০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এ পর্যন্ত বরিশাল সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হয়েছে চারবার। এর মধ্যে তিন নির্বাচনেই নিজেদের ভোট ব্যাংকের কারিশমা দেখিয়েছে বিএনপি। ২০০৩-এর নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন বিএনপির দুই নেতা সাবেক মেয়র আহসান হাবিব কামাল এবং এবায়েদুল হক চান। নির্বাচনে তারা দুজন পান ৩৭ হাজার ভোট।
দলীয় প্রার্থী সাবেক মেয়র মজিবর রহমান সরোয়ারের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৪১ হাজার। বিএনপির এ তিন নেতার সম্মিলিত ভোট ছিল যেখানে ৭৮ হাজার, সেখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী অ্যাডভোকেট এনায়েত পীর খান ৩৭ হাজার ভোট পেয়ে পরাজিত হন সরোয়ারের কাছে। ২০০৮ এর নির্বাচনেও প্রমাণ মেলে বিএনপির ভোটের কারিশমার। সেবার বিএনপি নেতা সরফুদ্দিন সান্টুকে মাত্র ৫৮৮ ভোটে হারিয়ে মেয়র হন আওয়ামী লীগের শওকত হোসেন হিরন।
সবচেয়ে কঠিন লড়াই হিসাবে বিবেচিত ২০১৩-এর ভোটে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শওকত হোসেন হিরনকে ১৬ হাজারের বেশি ভোটে হারিয়ে মেয়র হয়েছিলেন বিএনপির আহসান হাবিব কামাল। এছাড়া বিভিন্ন সময় অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনগুলোতেও আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা ৪০ থেকে ৫০ হাজার ভোটের ব্যবধানে হেরেছেন বিএনপির কাছে।
এক কথায় বরিশাল আগাগোড়াই বিএনপির ভোটের ঘাঁটি। আর এ কারণেই হয়তো সিটি নির্বাচনে নিজেদের জয় নিশ্চিত করতে বিএনপির ভোটারদের পক্ষে আনার চেষ্টা করছেন জাতীয় পার্টি ও ইসলামী আন্দোলনের দুই মেয়র প্রার্থী। অনেকে এও বলছেন, বিএনপি ভোটে নেই বলেই এবার জয়ের স্বপ্ন দেখছেন তারা।
জাতীয় পার্টির প্রার্থী দলের চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা ইকবাল হোসেন তাপস বলেন, একটা সময় ছিল যখন আমাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা পল্লীবন্ধু এরশাদকে নানা মামলায় আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছিল আওয়ামী সরকার। সেই পরিস্থিতি এখন আর নেই। জনগণের মতামতের প্রতিফলন হতে রাজনীতির মাঠে কাজ করছে জাতীয় পার্টি। আমাদের চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের বিভিন্ন সময়ের বক্তব্যই তার প্রমাণ। তাছাড়া রাজনৈতিকভাবে আমার নীতিগত অবস্থান এ নগরের সবাই জানেন। স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষমতাসীন দলের অন্যায়, অপকর্মের বিরুদ্ধে সবসময়ই সোচ্চার আমি। হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসা কেউ নই, আমার জন্ম বেড়ে ওঠা সবই এখানে। এমনো নয় যে, আমি রাজনীতিতে নতুন কিংবা মামা-খালুর পরিচয়ে দলীয় মনোনয়ন নিয়েছি। এখানে ক্ষমতাসীন দলের যে পরিবারতন্ত্র চলছে, দাদার পর বাবা-ছেলে আবার এখন ভাই। মানুষের অধিকার কুক্ষিগত করা, বরিশাল নগরকে স্বৈরতন্ত্রের বেড়াজালে আটকে রাখার যে পদ্ধতি-আমি তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি। কেবল বিএনপি কেন, বরিশালের সর্বস্তরের মানুষ আমার পাশে আছেন। আমার বিশ্বাস, নগরবাসী এবার পরিবর্তন চায়।
হাতপাখা প্রতীক নিয়ে ভোটযুদ্ধে নামা ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী দলের নায়েবে আমির মুফতি ফয়জুল করীম বলেন, বরিশাল সিটিতে জয়ী হওয়ার মতো দলীয় ভোট আমাদের রয়েছে। অন্যান্য স্থানীয় নির্বাচনেও আমাদের দলের নেতারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হয়েছেন। বিএনপির ভোটাররা আপনাদের ভোট দেবে এরকম কোনো সম্ভাবনা দেখছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আর যাই হোক বিএনপির লোকজন তো নৌকায় ভোট দেবেন না। আওয়ামী লীগবিরোধী মানসিকতার ভোটাররা আমাদের ভোট দিতেই পারেন। আশা করছি, নৌকার বাইরে থাকা সব শ্রেণির মানুষ আমাদের সাথে থাকবেন।
বিএনপির ভোট নিয়ে লাঙ্গল আর হাত পাখার যখন এ নীরব লড়াই তখন পুরোদমে প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ত নৌকার প্রার্থী খোকন সেরনিয়াবাত। নগরের সদর রোড সার্কিট হাইজের সামনে শুক্রবার নৌকা প্রতীকের প্রধান নির্বাচনি অফিস উদ্বোধন করেছেন তিনি। তবে শোডাউন এবং নির্বাচনি অফিস উদ্বোধনের এসব কর্মসূচিতে তার বিপুলসংখ্যক অনুসারী উপস্থিত থাকলেও ছিলেন না মনোনয়নবঞ্চিত মেয়র সাদিকের মাঠপর্যায়ের কর্মী-সমর্থকরা। এমনকি খোকনের বাসভবন নগরের আলেকান্দা এলাকাতেও দেখা যায় না তাদের।
মূলত তার সাথে আছেন সাবেক মেয়র শওকত হোসেন হিরনের অনুসারী আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং সাদিক বিরোধীরা। যাদের অধিকাংশই প্রায় ৯ বছর ধরে আওয়ামী লীগের স্থানীয় রাজনীতিতে অবহেলিত। মেয়র সাদিকের সাথে বিরোধ থাকা ১০ ওয়ার্ড কাউন্সিলরও আছেন খোকনের সাথে। যদিও তাদের কারোরই দলীয় কোনো পদ-পদবি নেই।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে আওয়ামী লীগের একটি সূত্র জানায়, খোকন-আব্দুল্লাহকে কেন্দ্র করে রাজনীতির মাঠে নিজেদের অবস্থান ফেরাতে চাইছেন কোণঠাসা এসব নেতাকর্মী।
নির্বাচনের বিষয়ে খোকন সেরনিয়াবাত যুগান্তরকে বলেন, বরিশালের মানুষ গত সাড়ে ৪ বছরের অনিয়ম আর অবহেলার জবাব দেবেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে মনোনয়ন দিয়েছেন। বরিশালের সর্বস্তরের মানুষ আছেন আমার সাথে। তারাই আমার সম্মান রক্ষা করবেন।