সারা দেশে ভয়াবহ চিত্র
বিদ্যুতের ভেলকিবাজি অতিষ্ঠ জনজীবন
ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে শিশু ও বৃদ্ধরা বিপাকে
যুগান্তর ডেস্ক
প্রকাশ: ১৯ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলা দাবদাহের সঙ্গে বিদ্যুতের ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। গরিব ও খেটে খাওয়া মানুষদের দুর্ভোগ বেড়েছে। প্রচণ্ড গরমে শিশু ও বয়স্করা চরম বিপাকে পড়েছে। হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোয় রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ভয়াবহ লোডশেডিংয়ে সারা দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব ক্ষেত্রে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।
দফায় দফায় লোডশেডিংয়ে শিল্প-কারখানায় উৎপাদন কমে গেছে। সেচ কাজেও ব্যাঘাত ঘটছে। ঈদবাজারে কেনাকাটায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এ সম্পর্কে ব্যুরো, অফিস ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
রংপুর : রংপুর জেলাসহ বিভাগের আট জেলায় বিদ্যুতের চাহিদা ৮৫০ থেকে ৯০০ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে ৭০০ থেকে ৭৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে। বিদ্যুৎ না থাকায় লাখ লাখ গ্রাহক ভোগান্তিতে পড়েছে। প্রচণ্ড গরমে শিশু ও বয়স্করা সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছে।
প্রচণ্ড গরমের মধ্যেও ইফতার, তারাবি, সেহরিতে নিয়ম মেনে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে না। নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই (নেসকো) বলছে, চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ কম পাওয়ায় এ সমস্যা হচ্ছে। তবে সমস্যা উত্তরণের চেষ্টা চলছে। ব্যবসায়ী ও কারখানার মালিকরা জানান, লোডশেডিংয়ে শিল্প-কারখানায় উৎপাদন কমে যাচ্ছে।
দোকানেও বেচা বিক্রি হচ্ছে না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে তারা জরুরি ব্যবস্থার দাবি জানিয়েছেন। রংপুর চেম্বারের সভাপতি মোস্তফা সোহরাব চৌধুরী টিটু বলেন, আধা ঘণ্টা পরপর বিদ্যুৎ যাওয়া-আসা করায় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ক্রেতার সংখ্যা অনেক কমেছে। নেসকোর রংপুর বিতরণ অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী জাকির হোসেন বলেন, চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ কম পাওয়ায় লোডশেডিং হচ্ছে। অবস্থা উত্তরণের চেষ্টা চলছে।
বরিশাল : বৈশাখের শুরুতে প্রচণ্ড খরতাপে বরিশালের নগরজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিদ্যুতের লোডশেডিং বাড়ছে। নগরজীবনকে লোডশেডিং আরও দুর্বিষহ করে তুলছে। গরমে মানুষের হাঁসফাঁস অবস্থা। দিনে তীব্র গরমের পর রাতেও নেই স্বস্তি। রাতেও প্রচণ্ড গরম অনুভূত হচ্ছে।
বিকালে বঙ্গবন্ধু উদ্যানে পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসা বরিশাল খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এলবার্ট রিপন বল্লভ বলেন, গরমে আর ঘরে থাকতে পারছি না। একটু পরপর লোডশেডিং। এমনকি রাতের বেলায়ও ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। তাই খুব খারাপ অবস্থা। বিদ্যুৎ বিভাগের দাবি-ওভারলোডের কারণে লোডশেডিং বাড়ছে।
সিলেট : দফায় দফায় লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ সিলেট নগরবাসী। বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগের এক প্রকৌশলী জানান, বিদ্যুৎ লাইনের ত্রুটি ও স্থানীয় সমস্যায় মাঝেমধ্যে লোডশেডিং দেওয়া হয়। তবে লোডশেডিং করার কোনো নির্দেশনা নেই। মার্কেটে আলোকসজ্জার নিষেধাজ্ঞা থাকলেও অনেকে তা মানছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, চাহিদার বিপরীতে বিদ্যুৎ ব্যবহার ভোগান্তির সৃষ্টি করছে। চোরাপথে বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে শিগগিরই ব্যবস্থা নেবে পিডিবি।
নেত্রকোনা ও কেন্দুয়া : টানা কয়েকদিনের রোদ ও ভ্যাপসা গরমে সাধারণ মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে লোডশেডিং। গ্রামাঞ্চলে প্রায় ১৫ থেকে ১৬ ঘণ্টা লোডশেডিং দেওয়া হয়। বিদ্যুতের অভাবে কোনো কোনো এলাকায় বোরো জমিতে সেচ কাজ ব্যঘাত হচ্ছে। এ কারণে বিদ্যুতের গ্রাহকরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে। অভিযোগ-একটি উপজেলায় বিশেষ একটি লাইনে লোডশেডিং কিছুটা কম দেওয়া হচ্ছে।
গ্রামাঞ্চলে সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং দেওয়া হচ্ছে। এরমধ্যে কেন্দুয়া উপজেলায় সবচেয়ে বেশি। এখানে বিদ্যুতের চাহিদা ২০ মেগাওয়াট হলেও ৮ মেগাওয়াট সরবরাহ হচ্ছে। গ্রামাঞ্চলের গ্রাহকদের অভিযোগ, দিনরাতে ১৫ থেকে ১৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। শুধু কেন্দুয়ায় নয় একই অবস্থা কলমাকান্দা, বারহাট্টা, পূর্বধলাসহ জেলার ১০টি উপজেলার।
কেন্দুয়া পৌর সদরে কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টার ‘রঙিন বাড়ি আইটি’ প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার রাফিউল ইসলাম রাফি বলেন, ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে কোনো কাজই করা যাচ্ছে না। শিক্ষার্থীরাও কেন্দ্রে আসে না। পল্লী বিদ্যুতের কেন্দুয়া আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক মুজিবুর রহমান বলেন, সরবরাহ কম থাকায় লোডশেডিং দেওয়া হচ্ছে। ১ নম্বর লাইনের আওতায় হাসপাতাল, অফিস আদালত থাকায় লোডশেডিং কিছুটা কম করা হচ্ছে।
সব স্থানে সমপরিমাণ বিদ্যুৎ সরবরাহ না করার অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, সমহারে সর্বত্র বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। নেত্রকোনা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মহাব্যবস্থাপক বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, চাহিদার তুলনায় কম বিদ্যুৎ পাওয়ায় ঘন ঘন লোডশেডিং দিতে হচ্ছে। মঙ্গলবার ১০৫ মেগাওয়াট চাহিদা থাকলেও ৬০ মেগাওয়াট সরবরাহ করা হয়েছে।
শরীয়তপুর : প্রচণ্ড দাবদাহের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জেলার ছয় উপজেলায় লোডশেডিং বাড়ছে। দিন-রাতে ৪-৫ ঘণ্টাও বিদ্যুৎ থাকে না। এতে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে। স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ব্যাহত হচ্ছে। ফ্রিজের মাছ-মাংসসহ কাঁচা পণ্য নষ্ট হচ্ছে। লোডশেডিংয়ে বিসিকের শিল্পকারখানার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
এ অবস্থায় ফুঁসে উঠছে সাধারণ মানুষ। শরীয়তপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) জুলফিকার রহমান বলেন, তীব্র দাবদাহে বিদ্যুৎ চাহিদা বেড়ে গেছে। ফলে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
টেকেরহাট (মাদারীপুর) : এক সপ্তাহ ধরে দিন-রাত মিলিয়ে ১০-১২ ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকায় ভোগান্তি বেড়েছে। সবচেয়ে দুর্ভোগ হচ্ছে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক কাজকর্মও ব্যাহত হচ্ছে। মাদারীপুর সদর, শিবচর, কালকিনি ও রাজৈর উপজেলাসহ সর্বত্র একই অবস্থা।
ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ওজোপাডিকো) মাদারীপুরের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান জানান, সারা দেশে লোডশেডিং হচ্ছে। তবে আশা করছি দুই-একদিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
সোনাগাজী (ফেনী) : সোনাগাজীতে দিনে ১০-১৫ বার বিদ্যুৎ যাওয়া-আসা করায় জনজীবনে দুর্ভোগ নেমে এসেছে। পরীক্ষার্থীরাও বিপাকে পড়েছে। ক্ষোভে ফুঁসে উঠছে সর্বস্তরের মানুষ। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে উপজেলার প্রধান কার্যালয়সহ চারটি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। পাশাপাশি বিদ্যুৎ অফিস ও উপকেন্দ্রগুলো ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা পাহারা দিচ্ছে।
রায়পুর (লক্ষ্মীপুর) : রায়পুরে তিন দিন ধরে অস্বাভাবিক লোডশেডিং চলছে। এতে জনমনে চরম ক্ষোভ ও অসন্তোষ বাড়ছে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের দাবিতে রায়পুরসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে গ্রাহকরা নানা কর্মসূচি পালনের পরিকল্পনা করছেন বলে জানা গেছে।
পাকুন্দিয়া (কিশোরগঞ্জ) : পাকুন্দিয়া উপজেলায় দৈনিক ১৭-১৯ ঘণ্টা লোডশেডিংয়ে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। বিদ্যুৎ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন ভুক্তভোগীরা। প্রতিদিন ২০-২৫ বার করে বিদ্যুৎ আসা-যাওয়া করছে। ১৭-১৯ ঘণ্টা লোডশেডিং দেওয়া হচ্ছে। বিদ্যুতের দাবিতে সোমবার রাতে পুলেরঘাট উপশহরের ব্যবসায়ী ও পাকুন্দিয়া উপজেলাবাসী মিছিল করেছেন।
নাচোল (চাঁপাইনবাবগঞ্জ) : বিদ্যুতের ভেলকিবাজিতে সাধারণ মানুষের নাকাল অবস্থা। বিদ্যুৎ না থাকায় ঈদ মৌসুমে বিপাকে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। বোরো ধানখেতে পর্যাপ্ত পানি দিতে পারছেন না কৃষকরা।
রানীনগর (নওগাঁ) : রানীনগর উপজেলায় ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোডশেডিং দেওয়া হচ্ছে। অসহ্য গরমে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে জনজীবন। দিন-রাতের প্রায় অর্ধেক সময়ই বিদ্যুৎ থাকছে না।