বরিশাল বিভাগে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড
ভাগ্যে দলীয় মনোনয়ন না জুটলেও দল-অন্তঃপ্রাণ তারা
![Icon](https://cdn.jugantor.com/uploads/settings/icon_2.jpg)
আকতার ফারুক শাহিন, বরিশাল
প্রকাশ: ১০ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
![ভাগ্যে দলীয় মনোনয়ন না জুটলেও দল-অন্তঃপ্রাণ তারা](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2023/04/10/image-663996-1681083333.jpg)
বরিশাল বিভাগের কয়েকজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নিঃস্বার্থভাবে দলীয় কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। শ্রম ও ব্যক্তিগত অর্থ দিয়ে তারা দলীয় কর্মসূচি পালন ও জনসেবা করেন। কিন্তু তাদের ভাগ্যে কখনও সিটি করপোরেশন অথবা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন জোটে না। তবে তারা কখনও দলবিমুখ হন না। তারা এলাকা ছেড়েও যান না। বছরের পর বছর ধরে তারা চেষ্টায় লেগে আছেন।
বরিশালের বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ডজনখানেকের বেশি নেতা দলের জন্য দিন-রাত পরিশ্রম করছেন। ছোট দলগুলোতেও আছেন এমন কয়েকজন নেতা। মামলা-হামলার মুখেও তারা এলাকা ছেড়ে যান না। সাধারণ মানুষের বিপদে-আপদে তারা সহযোগিতা, দান-খয়রাত করেন। বিত্তশালীরা মসজিদ-মন্দির করে দেন। নিজের গাঁটের টাকায় তারা টিউবওয়েল রাস্তা ও কালভার্ট করে দিচ্ছেন। তবু তাদের ভাগ্যে দলীয় মনোনয়ন জোটে না।
রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মী-সমর্থকদের মতে, রাজনীতির নানা মারপ্যাঁচে দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত নেতারা অনেকটা বিনা স্বার্থে মানুষের পাশে থাকেন। চাইলে তারা এলাকা ছেড়ে যেতে পারেন। কিন্তু দল আর মানুষের প্রতি ভালোবাসার কারণে তারা এলাকায় পড়ে থাকেন। এমন কয়েকজন নেতার মধ্যে রয়েছেন-বরিশালে বিএনপি নেতা এবায়েদুল হক চান ও যুবলীগ নেতা মাহমুদুল হক খান মামুন, পিরোজপুরে আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিন মহারাজ, ঝালকাঠীতে আওয়ামী লীগ মনিরুজ্জামান মুনির। বরিশাল (দক্ষিণ) জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি এবায়েদুল হক চান বর্তমানে দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য। বরিশাল বিএনপির সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত নেতা হিসাবে তাকে সবাই এক নামে চেনে। মেয়র ও এমপি পদে দলীয় মনোনয়ন চেয়েও তিনি পাননি। তার প্রতি বিএনপির দরদ দেখা যায়নি। তরুণ বয়স থেকে এখন পর্যন্ত দল করে সেই অর্থে তিনি কিছুই পাননি। কথা প্রসঙ্গে ৬৫ বছর বয়স্ক এবায়েদুল হক চান বলেন, দল মূল্যায়ন না করলে কি করব বলুন? তাই বলে তো আর দল ছেড়ে যেতে পারি না।
একই অবস্থা যুবলীগ নেতা মাহমুদুল হক খান মামুনের। বরিশাল মহানগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মামুন বিএম কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বয়স ৬০-এর কোঠা পেরুনো মামুন বাবার রেখে যাওয়া জমি বিক্রির টাকায় রাজনীতি করেন। বিভিন্ন সামাজিক ও সেবামূলক কার্যক্রমে তিনি নিজেকে জড়িয়ে রাখেন। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি এমপি নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাননি। এমনকি উপজেলা চেয়ারম্যান ও সিটি মেয়র পদেও তিনি দলীয় মনোনয়ন পাননি। মাহমুদুল হক খান মামুন বলেন, ৪৩ বছর ধরে রাজপথে আছি। চোখের সামনে অনেকে তরতর করে উপরে উঠে গেল। কিন্তু আমার কপালে জুটল না কিছুই। তবুও দলের পেছনে পড়ে আছি। হয়তো কখনও দল মূল্যায়ন করবে।
চান-মামুনের মতোই অবস্থা পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও দলের কেন্দ্রীয় উপকমিটির সাবেক সহসম্পাদক মহিউদ্দিন মহারাজের। পিরোজপুর-৩ আসনে দলীয় মনোনয়নের আশায় পড়ে আছেন বহু বছর। মাঝে তিনি একবার ছিলেন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান। বিদ্রোহী হিসাবে তিনি জয়ী হন। সর্বশেষ জেলা পরিষদ নির্বাচনে তার বিজয় নিশ্চিত থাকলেও দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশে তিনি সরে দাঁড়ান। করোনাভাইরাস মহামারিকালে নির্বাচনি এলাকা মঠবাড়িয়ায় তিনি উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড, দরিদ্র ও অসহায় মানুষকে আর্থিক সহযোগিতা করেছেন। এলাকায় তিনি বহু স্কুল-কলেজ-মসজিদ নির্মাণ করেছেন। এক প্রশ্নের জবাবে মহিউদ্দিন মহারাজ বলেন, দলের জন্য আমার যে পরিশ্রম ও চেষ্টা তাতে দলীয় সভাপতি আমাকে বিমুখ করবেন না। মহারাজের মতোই এলাকায় পড়ে আছেন ঝালকাঠী-১ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক কেন্দ্রীয় উপকমিটির সদস্য মনিরুজ্জামান মুনির। করোনাকালে মাসের পর মাস হাজার হাজার মানুষের খাবারের সংস্থান করেছেন তিনি। এলাকার উন্নয়নে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এলাকার মানুষের জন্য কাজ করলেও তার দলীয় স্বীকৃতি জোটেনি। এরপরও তিনি এলাকা ছেড়ে যাননি।
বরিশাল-৬ আসনে দলীয় মনোনয়নের আশায় প্রায় দুই যুগ ধরে মাঠে আছেন জাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. মোহসীন। ছোট দলের নেতা হয়েও তিনি এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। সচিবালয়ে ঘুরে তদবির লবিং করে এলাকার জন্য ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণসহ ব্যাপক উন্নয়ন বরাদ্দ এনেছেন। বরিশাল-২ আসনে বহু বছর ধরে জাসদ (আম্বিয়া-প্রধান) নেতা আনিসুজ্জামান আনিচ মাঠে আছেন। দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আনিচ এলাকার মানুষের জন্য দিয়ে যাচ্ছেন শ্রম।
বরগুনার দুটি আসনে মনোনয়নের আশায় বছরের পর বছর ধরে মাঠে আছেন আওয়ামী লীগের দুই নেতা। তারা হলেন-যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সুভাষ চন্দ্র হাওলাদার এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপকমিটির সাবেক সহসম্পাদক মশিউর রহমান শিহাব। যথাক্রমে বরগুনা-১ ও ২ আসনে দলীয় মনোনয়ন চাইছেন তারা। তাদের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েনি। এরপরও তারা এলাকায় পড়ে আছেন। তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা জানান, দরিদ্র মানুষকে তারা দু’জনই সাধ্যমতো সাহায্য-সহযোগিতা দেন। নিজেদের টাকায় মসজিদ-মাদ্রাসা-মন্দির নির্মাণ থেকে শুরু করে গরিব মানুষকে ঘর করে দেওয়া, টিউবওয়েল স্থাপন এমনকি মেধাবী শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার ব্যবস্থাও করেন তারা। যুগান্তরকে তারা বলেন, সাধারণ মানুষ জানে কে তাদের আপনজন। করোনাসহ নানা বিপর্যয়ে কে তাদের পাশে ছিল। এক সময় দলও নিশ্চই মূল্যায়ন করবে। সেই আশাতেই রয়েছি।
পটুয়াখালী-২ (বাউফল) আসনে দলীয় মনোনয়নের আশায় যুগের পর যুগ ধরে মাঠে আছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের সাত নেতা। স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ ক্যাপ্টেন শামসুল আলম বীর উত্তমের ছেলে আওয়ামী লীগ নেতা হাসিব আলম তালুকদারের ভাগ্যে কিছুই জোটেনি। এলাকার উন্নয়ন-ধর্মীয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণসহ সাধারণ মানুষের কল্যাণে বহু বছর ধরে তার পরিবার কাজ করে গেলেও দলীয়ভাবে হাসিব আলমের ভাগ্যে কিছুই জোটেনি। বাউফলে কয়েকদিন আগে বিশাল নৌ-র্যালির মাধ্যমে বর্তমান সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরা হাসিব বলেন, কি পাব বা না পাব সেটা দেখার জন্য তো নেত্রী আছেন। আমার কাজ আমি করে যাচ্ছি।
কিছু পাওয়া না পাওয়ার হিসাব পেছনে ফেলে বছরের পর বছর ধরে নির্বাচনি এলাকায় পড়ে থাকা নেতাদের মধ্যে আরও রয়েছেন-পটুয়াখালী জেলা বিএনপির সদস্যসচিব স্নেহাংশু সরকার কুট্টি (পটুয়াখালী-১), বাকেরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির হারুন অর রশিদ সিকদার (বরিশাল-৬), তজুমদ্দিন উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান (ভোলা-৩), আওয়ামী লীগ নেতা আতিকুর রহমান (বরিশাল-৩), বিএনপির কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুল হক নান্নু (ঝালকাঠী-২), একই পদে থাকা আরেক বিএনপি নেতা আকন কুদ্দুসুর রহমান (বরিশাল-১), ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক আওয়ামী লীগ নেতা মঞ্জুরুল হক মঞ্জু (বরিশাল-৬), স্বরূপকাঠী উপজেলা বিএনপির সভাপতি ফখরুল আলম (পিরোজপুর-১), ভাণ্ডারিয়া উপজেলা বিএনপির সভাপতি আহম্মেদ মঞ্জুর সোহেল (পিরোজপুর-১) এবং বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সোবাহান (বরিশাল-১)।