কক্সবাজারের ইয়াবা ডন সাইদুলের আয়নাবাজি
আত্মসমর্পণ করে কারাগারে শাহাজাহান * কৌশলে জাতীয় পরিচয়পত্রে ছবি পরিবর্তন * কারাগারে সাইদুলের ১৩ মাদক বহনকারী
মুহাম্মদ আবুল কাশেম, ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৬ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
এ যেন আয়নাবাজি। আসামি একজন আর জেল খাটছেন আরেকজন। কক্সবাজারে এমন খেল দেখালেন ইয়াবা ডনখ্যাত সাইদুল হোসেন (২৮) ওরফে সাইদ্যা।
সেখানে তার পরিবর্তে জেলে গেছেন মো. শাহাজাহান নামে এক ব্যক্তি। অভিযোগ উঠেছে, টাকার বিনিময়ে তাকে জেলে পাঠিয়ে এলাকায় বীরদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি।
কয়েক বছর ধরে সাইদুল ইয়াবার বড় বড় চালান পার করেছেন। বিভিন্ন সময় তার ইয়াবার চালান নিয়ে ১৩ মাদক বহনকারী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে গেলেও সাইদুল থেকে যান পর্দার আড়ালে তবে শেষ রক্ষা হয়নি তার।
সর্বশেষ গ্রেফতার হওয়া সাইমনের দেওয়া জবানবন্দিতে ফেঁসে যান সাইদুল। এসব বিষয়ে জানতে রামুর চাকমারকুলে সাইদুলের মুখোমুখি হয় যুগান্তর। এ সময় তিনি অভিযোগ স্বীকার করে সংবাদ না করার জন্য প্রতিবেদককে ঘুসের প্রস্তাব দেন।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ৭ জুলাই রাতে রামু উপজেলার মরিচ্যা যৌথ চেকপোস্টে বিজিবির হাতে ১৯ হাজার ৬৫০ পিস ইয়াবাসহ গ্রেফতার হন চাকমারকুল ইউনিয়নের পশ্চিম ৯নং ওয়ার্ডের মৃত মকতুল হোসেনের ছেলে সাইমন।
ওই রাতেই সাইমনকে আসামি করে মামলা করেন ৩০ বিজিবির হাবিলদার খলিলুর রহমান। মামলার তদন্তের দায়িত্ব পান রামু থানার পুলিশ পরিদর্শক এসআই মোহাম্মদ আমির হোসেন। পরে আসামি সাইমনকে দুদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। সাইমনের ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দি অনুযায়ী সাইদুলকে মামলার ২ নম্বর আসামি করা হয়। এছাড়া সদরের খরুলিয়া ঝিলংজা ডেইঙ্গাপাড়ার রশিদ আহামদের ছেলে আমিনকে ৩ নম্বর আসামি করে ৩১ জানুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা।
অভিযোগপত্র ও আসামির স্বীকারোক্তি মতে, সাইদুল সিএনজি অটোরিকশা ক্রয় করে অন্য কারও নামে এটির মালিকানার কাগজপত্র তৈরি করেন। পরে ওই সিএনজি অটোর মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকায় ইয়াবা পাচার করেন। সাইদুলের কথামতো ওইদিন সাইমন কক্সবাজার সদরে ইয়াবার চালানটি পৌঁছানোর চেষ্টা করেন। তবে তার আগেই সাইমন বিজিবির হাতে ধরা পড়েন। সাইদুলের বদলি হিসাবে জেলে যাওয়া শাহাজাহান তারই (সাইমন) আপন ভাই। ১৬ মার্চ সাইদুল সেজে কক্সবাজারের একটি আদালতে আত্মসমর্পণ করেন শাহাজাহান। এর আগে সাইদুলের জাতীয় পরিচয়পত্রে ছবি পরিবর্তন করে নিজের ছবি জুড়ে দিয়েছিলেন তিনি। ওইদিন থেকেই শাহাজাহান কক্সবাজার জেলা কারাগারে। তার হাজতি নাম্বার ২৩৫৩/২৩। বর্তমানে তাকে যে কোনো মূল্যে জামিনে মুক্ত করতে চেষ্টা করছেন ইয়াবা ডিলার সাইদুল।
অভিযোগ আছে, কোটি টাকার বিনিময়ে থানা পুলিশ ও আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে আদালতের সঙ্গে প্রতারণা করে তার বদলি আসামি হিসাবে শাহাজাহানকে আত্মসমর্পণ করিয়েছেন সাইদুল। অন্যদিকে টাকার বিনিময়ে এতে সহযোগিতা করেন কক্সবাজার জেলা জজকোর্টের ৩১৫নং সদস্য আইনজীবী নজিবুল আলম নজীব। তবে তিনি অভিযোগ অস্বীকার করে যুগান্তরকে বলেন, অন্য সব আসামির মতো শাহাজাহানও আদালতে আত্মসমর্পণ করেছেন। তার কাছে জাতীয় পরিচয়পত্র চাইলে তিনি তা দেখান। জাতীয় পরিচয়পত্রে ছবি পরিবর্তনের বিষয়টি জানতেন না বলে জানান তিনি।
গ্রেফতার শাহাজাহানের স্ত্রী সাদিয়া আক্তার যুগান্তরকে জানান, তার স্বামী শাহাজাহান কারাগারে আছেন। তবে কি মামলায় সেটা তিনি নিশ্চিত করে বলতে পারেননি। কতদিন ধরে কারাগারে আছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, মাসখানেক ধরে তিনি জেলে।
জানা যায়, সাইদুলের অধীনে কক্সবাজারে শতাধিক ইয়াবা বহনকারী রয়েছে। তার ইয়াবার চালান নিয়ে গ্রেফতার হয়ে বর্তমানে কক্সবাজার কারাগারে আছেন ১৩ জন। এদের মধ্যে রয়েছেন-বাদশা মিয়া, পিতা-গুরা মিয়া, হাজতি নং ৫৯১০/২১। তোফায়েল, পিতা-আমিনুল হক হাজতী নং-৫৮৮৩/২১। নুরুল আলম, পিতা-মৃত সুলতান আহাম্মদ, হাজতি নং-৫৯০৯/২১। জসিম উদ্দিন ওরফে পেরাক জসিম, পিতা-আবুল কাশেম হাজতি নং-৮১১৭/২১। জসিম উদ্দিন, পিতা নূরুল ইসলাম, হাজতি নং-২১২৫/২১। শাহাজাহান, পিতা-ফুরুক আহমদ, হাজতি নং-৫৯০৮/২১। এসব আসামিকে কারাগারে দেখভালের দায়িত্বে আছেন পেরাক জসিম। কারাগারের বাইরে থেকে অর্থের জোগান দিচ্ছেন সাইদুল।
মিয়ানমারের নাগরিক ইয়াবা কারবারি নবী হোসেন ও আরসারের আনাগোনা রয়েছে সাইদুলের বাড়িতে। স্থানীয়দের দাবি, রোহিঙ্গা ইয়াবা কারবারিদের ঘাঁটিতে পরিণত হয় তার বাড়ি।
অভিযোগ স্বীকার করে যা বললেন সাইদুল : ইয়াবা ডন সাইদুল রামু উপজেলার চাকমারকুল ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের ডেইঙ্গাপাড়ার মৃত মুহাম্মদ মোস্তাফার ছেলে। চাকমারকুলে তার সঙ্গে কথা হয় যুগান্তর প্রতিবেদকের।
বদলি হিসাবে শাহাজাহানকে জেলে পাঠানোর বিষয়টি স্বীকার করে সাইদুল বলেন, সে নিজে থেকে খুশি মনে কারাগারে গেছে। এ গর্হিত কাজ কেন করলেন জানতে চাইলে রামু থানার ওসি ও আইনজীবীর পরামর্শে এ কাজ করেন বলেন জানান তিনি।
বিগত নির্বাচনে সব জনপ্রতিনিধিদের টাকা দেওয়ার পর একজন চেয়ারম্যান প্রার্থীর কারণে জেলার শীর্ষ ইয়াবা কারবারি হিসাবে পরিচিত হয়েছেন দাবি করে সাইদুল বলেন, আমি মাদকের সঙ্গে জড়িত নই।
বদলি আসামি হিসাবে অন্যজনকে জেলে পাঠানোর বিষয়ে রামু থানার ওসি আনোয়ার হোসেন এবং পুলিশ সুপার জানেন দাবি করে তিনি বলেন, স্থানীয় সংসদ-সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল তাকে ডিও লেটার দিয়েছেন সেটা তিনি পুলিশ সুপার মাহাফুজুর রহমানকে দিয়েছেন। এ কারণে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করছে না বলেও দাবি করেন সাইদুল। তিনি আরও বলেন, এমপি কমল রামু থানার ওসি আনোয়ার হোসেনকে অন্তত তিনবার এমপির বাড়িতে ডেকে নিয়ে আমাকে গ্রেফতার ও হয়রানি না করতে বলেছেন। আমাকে মামলা থেকে বাদ দিতে বলেছিলেন। কারণ এমপি জানেন যে আমি নির্দোষ।
বাড়িতে রোহিঙ্গাদের ঘাঁটি করার বিষয় অস্বীকার করেন সাইদুল এবং তার ১৩ জন মাদক বহনকারী কারাগারে থাকার বিষয়টিও এড়িয়ে যান। একপর্যায়ে এ বিষয়ে প্রতিবেদন না করার জন্য প্রতিবেদককে ঘুসের প্রস্তাব দেন সাইদুল।
তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করে এমপি সাইমুম সরওয়ার কমল যুগান্তরকে বলেন, আমি কোনোদিন কখনো মাদক কারবারিদের পক্ষে ওসিকে বাসায় ডাকিনি এবং ডিও দেইনি। এমনকি সাইদুল হোসেন নামে আমি কাউকে চিনিও না।
এ বিষয়ে জেলা পুলিশ সুপার মুহাম্মদ মাহফুজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, একজনের পরিবর্তে আরেকজন কারাগারে যাওয়ার বিষয়টি আপনাদের মাধ্যমে আজই জানলাম। সাইদুল নামে আসলে আমি কাউকে চিনতাম না। আর আমাকে এমপি মহোদয় ফোনও করেননি, কোনো ডিও লেটারও দেননি। সাইদুলকে যারা সহযোগিতা করে তাদের সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রামু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি আনোয়ারুল হোসাইন যুগান্তরকে বলেন, কেউ অন্যায় আবদার করলেও আমি তা রাখিনি। শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসাবে আলোচিত সাইদুলের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, কয়েক মাস ধরে তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা করে যাচ্ছি। সাইদুলের পরিবর্তে আরেকজনকে আত্মসমর্পণ করিয়ে কারাগারে পাঠানোর বিষয়টি জানা নেই বলেও দাবি করেন ওসি।
নিজ বাড়ি অবস্থানের পরও পুলিশ সাইদুলকে কেন খুঁজে পাচ্ছে না জানতে চাইলে ওসি বলেন, হাজার তিনেক আসামি, পুলিশ তো আর একজনের পেছনে পড়ে থাকে না।
এ ব্যাপারে মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা মুহাম্মদ আমির হোসাইন যুগান্তরকে জানান, সাইদুল হোসেনের পরিবর্তে অপর একজনকে বদলি আসামি হিসাবে আদালতে আত্মসমর্পণ করিয়ে জামিন নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে অবগত হয়েছি। আমাকে বিষয়টি ওসি স্যারও জানিয়েছেন। আমরা তাকে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করছি।
এদিকে স্থানীয়দের দাবি, নির্ভয়ে মাদকের ব্যবসা চালিয়ে যেতে স্থানীয় ইউপি সদস্য ছৈয়দ নুর ও চেয়ারম্যান নুরুল ইসলামকে নিয়মিত মোটা অঙ্কের টাকা দেন ইয়াবা ডন সাইদুল। চেয়ারম্যানকে দামি গাড়িও উপহার দিয়েছেন।
এ কারণে তার পক্ষে সাফাই গেয়ে চরিত্রের সার্টিফিকেট দেন তারা। এ বিষয়ে ইউপি সদস্য ছৈয়দ নুরের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাইদুল খুব ভালো ছেলে। তার মতো ছেলে হয় না। তবে তার সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই।
চাকমারকুল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বলেন, সাইদুল ইয়াবা কারবারি নয়। এছাড়া তাকে দামি গাড়ি উপহার দেওয়ার বিষয়টি গুজব বলে দাবি করেন তিনি।