স্বাগতম মাহে রমজান
সিয়াম সাধনায় জিন্দা হয় মরা আত্মা
মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী
প্রকাশ: ২৫ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আলহামদুলিল্লাহ! খুব সুন্দরভাবে প্রথম সিয়ামটি আমরা শেষ করেছি। সিয়াম কীভাবে মানুষের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে? কীভাবে মানুষকে আল্লাহপ্রাপ্তি ঘটায়? দুটি বিপরীত শক্তির প্রচণ্ড সংঘর্ষ নিয়ে তৈরি মানব সত্তা। মানুষের মাঝে ফেরেশতার শক্তি যেমন আছে, আছে শয়তানি শক্তিও। ফেরেশতা চায় তাকে আল্লাহর কাছে নিয়ে যেতে। আর শয়তান চায় তাকে ওপর থেকে টেনে নিচে নামাতে। এত নিচে যে, পশুও যে স্তরে নামতে ভয় পায়। শয়তানি যে শক্তি মানুষের মাঝে আছে তাকে বলে নফস। আর ফেরেশতা সত্তাকে বলে রুহ। যখন নফস শক্তিশালী হয়, তখন রুহ দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন আর তার কাছে, ভালো ও সুন্দর কিছু মজা লাগে না। যত অসুন্দর, যত নোংরা সবকিছু তার কাছে অমৃতের মতো মনে হয়। এ কথাই কুরআন এভাবে বলছে, ‘মানুষের ভেতর লুকিয়ে থাকা নফস যখন শক্তিশালী হয়, তখন পার্থিব জগৎ ও পাপকাজ তার চোখে সুন্দর ও আকর্ষণীয় মনে হয়।’
আমাদের ভেতর থাকা রুহ যখন শক্তিশালী হয়, তখন আবার নফস দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন কোনো খারাপ কাজ মানুষের কাছে ভালো লাগে না। এ কথাও কুরআন বলছে, ‘পৃথিবীর চাকচিক্য তাদের আকর্ষণ করে না।’ তাহলে দেখা যাচ্ছে, সফলতার জন্য অবশ্যই একজন মানুষের ভেতর থাকা রুহকে শক্তিশালী করতে হবে। তবেই তার নফস আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে আসবে।
এখন প্রশ্ন হলো, রুহকে শক্তিশালী করতে হয় কীভাবে? উত্তর খুবই সহজ। নফসকে দুর্বল করলেই রুহ শক্তিশালী হয়ে উঠবে। ইমাম গাজালী (রহ.) বলেন, নফসের সম্পর্ক মাটির দেহের সঙ্গে। আর রুহের সম্পর্ক নুরানি সত্তা আল্লাহতায়ালার সঙ্গে। নফস চায় মাটির খাবার। মাটি থেকে উৎপন্ন খাবার খেলে নফস শক্তিশালী হয়ে ওঠে। একই খাবার খেলে আমাদের দেহও হয় পরিপুষ্ট। তখন আমাদের ভেতর কাম-ক্রোধ জেগে ওঠে।
রুহের সম্পর্ক নূরের সঙ্গে। সে চায় নুরের খাবার। নুরের খাবার হলো ইবাদত-বন্দেগি। তো কেউ যখন খানাপিনা করে এবং ইবাদতও চালিয়ে যায়, তখন একই সঙ্গে নফস ও রুহ তাদের খাবার পায়। দুটিই শক্তিশালী হতে থাকে। কিন্তু আমরা যদি নফসের খাবার বন্ধ করে রুহের খাবার দিতে থাকি তবে একই সঙ্গে আমাদের রুহ শক্তিশালী হবে এবং নফস দুর্বল হয়ে পড়বে। ঠিক এজন্যই আল্লাহতায়ালা সিয়াম সাধনাকে বান্দার জন্য ফরজ করেছেন। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে বান্দা নফসকে দুর্বল করবে। আর তারাবিহ, তাহাজ্জুদ, দান-সদকার মাধ্যমে রুহকে করবে শক্তিশালী। এভাবে যখন একটি মাস নিয়মিত রুহ ও নফসের দ্বন্দ্বে রুহ বিজয় হতে থাকবে, নফস হয়ে পড়বে দুর্বল তখন বান্দা তাকওয়ার একটি পর্যায়ে পৌঁছে যাবে। সিয়াম শেষ হয়ে গেলেও তাকওয়ার রেশ থেকে যাবে জীবনে। যে তাকওয়ার শক্তিতেই সে নিজেকে মুক্ত রাখবে সব পাপ-অন্যায় থেকে।
আমরা যদি শুধু না খেয়ে থাকার সিয়াম করি, তবে আমাদের মাঝে তাকওয়া তো আসবেই না, বরং সিয়ামের প্রেমময় প্রভাবও আমরা উপলব্ধি করতে পারব না। তাই দেখা যায়, আমরা সিয়ামও করি, একই সঙ্গে পাপের জগতে নিজেদের হারিয়ে ফেলি। এর একমাত্র কারণ হলো, আমাদের ভেতরে থাকা শয়তানি শক্তি ‘নফস’ বড় বেশি শক্তিশালী হয়ে পড়েছে। আমাদের রুহ সেই নফসের সঙ্গে পেরে উঠছে না। এখন আমাদের একটি জিহাদে নামতে হবে। শপথ করতে হবে, যে করেই হোক আমাদের ভেতরে থাকা নফসকে দুর্বল করে রুহকে শক্তিশালী করতে হবে। আরবি সিয়াম শব্দের অর্থ বিরত থাকা। আমরা শিখেছি, সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খাওয়া ও যৌন কাজকর্ম থেকে বিরত থাকার নাম সিয়াম। শুধু এতটুকু বিরত থাকাই কি সিয়াম? না, রাসুল (সা.) আমাদের যে সিয়াম শিখিয়েছেন তাতে আরও বলা আছে, শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এবং মনের প্রতিটি কোণে গোনাহ ঝেড়ে ফেলাই হলো আসল সিয়াম। রাসুল (সা.)-এর ভাষায়-‘রোজা বান্দার জন্য ঢালের মতো। তোমাদের কেউ যদি রোজা রাখে, সে যেন অশ্লীল কথা না বলে। আল্লাহর নিষেধ করা কোনো কাজ না করে। মূর্খের মতো কথা না বলে। কেউ যদি তাকে গালি দেয়, সে যেন বলে, আমি রোজাদার।’
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি