Logo
Logo
×

শেষ পাতা

কমিশন বাণিজ্যে মন্ত্রণালয়ের সিন্ডিকেট

ছাগলের টিকা কেনায় নানা কূটকৌশল

পছন্দের ঠিকাদারকে সুযোগ দিতে শর্ত পরিবর্তন করে পুনঃদরপত্র * একই কাজে পুনঃদরপত্রে ৯ কোটি টাকা কম দর দুই প্রতিষ্ঠানের

Icon

মাহবুব আলম লাবলু

প্রকাশ: ২৫ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ছাগলের টিকা কেনায় নানা কূটকৌশল

ছাগলের পিপিআর রোগ নির্মূলে ৩৮ কোটি ৪১ হাজার টাকার ভ্যাকসিন কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের আওতায় চলমান প্রকল্পের অধীনে এই ভ্যাকসিন কেনা নিয়ে চলছে নানান কূটকৌশল। অভিযোগ উঠেছে, পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দিতে মরিয়া মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট।

ঠিকাদারের প্রয়োজনীয় যোগ্যতা না থাকায় অংশ নেওয়া সব কোম্পানিকে নন-রেসপনসিভ দেখিয়ে দরপত্র বাতিল করা হয়। এরপর পছন্দের ঠিকাদারকে সুযোগ দিতে তার সুবিধামতো শর্ত দিয়ে আহ্বান করা হয়েছে পুনঃদরপত্র। কাজ দেওয়ার বিনিময়ে অন্তত ৩ কোটি টাকা সিন্ডিকেট হোতার পকেটে যাবে বলে অভিযোগ আছে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, পছন্দের ঠিকাদার নেপাল থেকে কম দামে নিম্নমানের ভ্যাকসিন এনে সরবরাহের দুরভিসন্ধি চূড়ান্ত করেছে। এ কারণেই প্রথম দরপত্রের তুলনায় পুনঃদরপত্রে সোয়া নয় কোটি টাকা কম দর দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বিষয়টি জেনেও টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটি ওই কোম্পানির জমা দেওয়া টিকার নমুনা রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য পাঠিয়েছে। দরপত্রসংক্রান্ত নথির সূত্র ধরে যুগান্তরের অনুসন্ধানে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য জানা গেছে।

জানতে চাইলে গবাদিপশুর খুরারোগ প্রতিরোধ ও ছাগলের পিপিআর রোগ নির্মূল প্রকল্পের পরিচালক অমর জ্যোতি চাকমা যুগান্তরকে বলেন, ‘নিয়ম-কানুনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোনো কোম্পানিকে কাজ দেওয়া হবে না। দরপত্রের শর্ত মোতাবেক যোগ্য কোম্পানি না পাওয়া গেলে প্রয়োজনে ফের দরপত্র আহ্বান করা হবে।’

একটি কোম্পানি সুযোগ করে দিতে দরপত্রের শর্ত শিথিল করা হয়েছে কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি ঠিক নয়। প্রথম দরপত্রে মাত্র চারটি কোম্পানি অংশ নেয়। চারটিই নন-রেসপনসিভ হয়। তাই বেশিসংখ্যক প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতেই শর্ত শিথিল করা হলেও পিপিআরের নিয়ম লঙ্ঘন হয়নি।’

মন্ত্রণালয়ের সিন্ডিকেটের চাপে একটি কোম্পানিকে সুবিধা দিতেই টেন্ডার শর্ত পরিবর্তন, নিম্নমানের ভ্যাকসিন সরবরাহের চেষ্টা চলছে কিনা-এর জবাবে তিনি বলেন, ‘সবই তো বুঝেন। এসব নিয়ে কথা বলতে চাই না। তবে এটা নিশ্চিত করতে চাই কোম্পানিগুলো যে দরই দিক না কেন, কোনো অবস্থাতেই নিম্নমানের ভ্যাকসিন দিতে পারবে না। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরই ভ্যাকসিন নেওয়া হবে। তাছাড়া ভ্যাকসিন ছাগলের গায়ে প্রয়োগের পর কাজ না হলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে টাকা ফেরত নেওয়ার শর্তও দরপত্রে রয়েছে।’

জানা গেছে, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের আওতায় চলমান গবাদিপশুর খুরারোগ প্রতিরোধ ও ছাগলের পিপিআর রোগ নির্মূল প্রকল্পের অধীনে টিক কেনা হচ্ছে। গত বছরের ২৭ অক্টোবর ৩৮ কোটি ৪১ হাজার টাকা ব্যয়ে পিপিআর ভ্যাকসিন কেনার দরপত্র আহ্বান করা হয়। সে বছরের ১০ নভেম্বর ছিল দরপত্র জমার শেষ দিন।

এতে অংশ নেয় চারটি কোম্পানি। এর মধ্যে টেকনো ড্রাগস লিমিটেড ৩২ কোটি ৭৭ লাখ ৫৪ হাজার ৯৩২ টাকা দর দেয়। জেনটেক ইন্টারন্যাশনাল সর্বোচ্চ ৩৭ কোটি ৮৮ লাখ ৭৩ হাজার ১১০ টাকা, বাংলাদেশ সায়েন্স হাউজ ৩২ কোটি ৭১ লাখ ৩৭ হাজার ৩৩৩ টাকা ও স্টারলিংক মাল্টি টেকনোলজিস লি. ৩১ কোটি ৮৩ লাখ ৪৮ হাজার ৪২৭ টাকা দর দেয়।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, দরপত্র আহ্বানের পর থেকেই টেকনো ড্রাগস লিমিটেড নামের কোম্পানি প্রতিনিধির মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ের সিন্ডিকেটের সঙ্গে যোগাযোগ করে। দুপক্ষের আলোচনার পর ৬ কোটি টাকায় কাজটি টেকনো ড্রাগসকে পাইয়ে দেওয়ার মৌখিক চুক্তিও হয়। চুক্তির অন্তত অর্ধেক অর্থ চেকের মাধ্যমে জামানত হিসাবে নেয় সিন্ডিকেটের এক সদস্য। কিন্তু টেকনো ড্রাগস দরপত্রে উল্লিখিত অভিজ্ঞতার শর্ত পূরণ করতে না পারায় দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি ওই প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে অপারগতা জানায়। ফলে সিন্ডিকেট সদস্যরা চাপ দিয়ে অন্য তিনটি প্রতিষ্ঠানের দরপত্রও নন-রেসপনসিভ দেখিয়ে পুরো দরপত্র প্রক্রিয়া বাতিল করাতে সক্ষম হয়।

জানা গেছে, দরপত্রে অভিজ্ঞতার শর্ত ছিল, প্রাণীর ওষুধ ও ভ্যাকসিন বা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে সংশ্লিষ্ট ক্যাটাগরির ৩০ কোটি টাকার মালামাল তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ দুই কার্যাদেশে সরবরাহের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের সিন্ডিকেটের পছন্দের প্রতিষ্ঠান টেকনো ড্রাগসের এ ধরনের কোনো অভিজ্ঞতার সনদ নেই। ফলে মূল্যায়ন কমিটি তাদের দরপত্র বাতিল করে। এরপর অন্য তিনটি কোম্পানির দরপত্রও নন-রেসপনসিভ করা হয়।

৮ ফেব্রুয়ারি আহ্বান করা হয় পুনঃদরপত্র। তাতে পছন্দের ঠিকাদারকে সুবিধা পাইয়ে দিতে প্রাণিসম্পদের ওষুধ ও ভ্যাকসিনের পাশাপাশি ফার্মাসিউটিক্যাল বা বায়োলজিজের অভিজ্ঞতা সংযুক্ত করা হয়েছে। পিপিআর লঙ্ঘন করে শিথিল করা হয়েছে কাজের অভিজ্ঞতার শর্ত।

এক্ষেত্রে বলা হয়েছে, দুই কার্যাদেশের পরিবর্তে ৩ বছরের মধ্যে ৩০ কোটি টাকার কাজের অভিজ্ঞতা থাকলেই চলবে। অথচ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রেগুলেশনের (পিপিআর) আইটিটি ক্লজ ১৫(১বি)-এর অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে বলা আছে, ন্যূনতম কার্যাদেশ সংখ্যা, টাকার অঙ্ক ও সময়কাল উল্লেখ থাকতে হবে।

জানা গেছে, পুনঃদরপত্র আহ্বানের পরও আগের চারটি প্রতিষ্ঠানই তাতে অংশ নেয়। তবে এক্ষেত্রে দরে দেখা গেছে বিস্তর ফারাক। ডলারের মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধির পরও চারটির মধ্যে তিনটি প্রতিষ্ঠানই তাদের দর না বাড়িয়ে উলটো কমিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৯ কোটি ২৬ লাখ ৩৯ হাজার ৮২০ টাকা কমিয়ে দর দিয়েছে টেকনো ড্রাগস লিমিটেড। জেনটেক ইন্টারন্যাশনাল দর কমিয়েছে ৮ কোটি ৯০ লাখ ২৯ হাজার ২৪৩ টাকা। বাংলাদেশ সায়েন্স হাউজ কমিয়েছে প্রায় কোটি টাকা। তবে স্টারলিংক মাল্টি টেকনোলজিজ লিমিটেড আগের চেয়ে ৫ কোটি ৬৪ লাখ ৩৯ হাজার ২৯ টাকা বাড়িয়ে দর দিয়েছে।

দুদফা দরপত্র নন-রেসপনসিভ হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে জেনটেক ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ধীরেন দাস যুগান্তরকে বলেন. ‘সব শর্ত মেনেই দরপত্র জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু কী কারণে দরপত্র নন-রেসপনসিভ করা হয়েছে তা জানতে পারিনি। কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চাইলেও জানায়নি। যেহেতু আমরা ব্যবসা করি তাই এ নিয়ে আর ঘাঁটাঘাঁটি করিনি।’

জানতে চাইলে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সভাপতি ডা. রিয়াজুল হক যুগান্তরকে বলেন, ‘ব্যবসায়িক স্বার্থে কোম্পানিগুলো নানা প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। কিন্তু আমরা তাদের স্বার্থ প্রাধান্য না দিয়ে জনস্বার্থেই সব সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি। এই দরপত্রের ক্ষেত্রেও তাই হবে।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, টেকনো ড্রাগস লিমিটেডের অস্বাভাবিক দর কমানোর পেছনে রয়েছে দুরভিসন্ধি। তারা কম দামে নেপালের হেস্টা কোম্পানির তৈরি নিম্নমানের ভ্যাকসিন এনে সরবরাহের পরিকল্পনা করেছে। দরপত্রে ভ্যাকসিনের মান ‘টেন টুগেদার থ্রি’ চাওয়া হয়েছে।

অথচ হেস্টা কোম্পানির ওয়েবসাইট তালাশে দেখা গেছে, তারা টেন টুগেদার থ্রি মানের ভ্যাকসিন উৎপাদনই করে না। তাদের উৎপাদিত ভ্যাকসিনের মান ‘টেন টুগেদার টু পয়েন্ট ফাইভ’।

অভিযোগ উঠেছে, হেস্টা কোম্পানির টেন টুগেদার থ্রি মানের ভ্যাকসিন সরবরাহের একটি সনদ নেপালি একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এনে দরপত্র জমা দেয় টেকনো লিমিটেড। এরপরও মূল্যায়ন কমিটি তাদের দরপত্র বাতিল না করে কাজ দেওয়ার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিচ্ছে। টেকনো ড্রাগসের এই জালিয়াতি জানার পরও জমা দেওয়া ভ্যাকসিনের নমুনা দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি গ্রহণ করেছে। এরই মধ্যে তা পাঠানো হয়েছে রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য। আর এসবই হচ্ছে সিন্ডিকেটের প্রভাবে। জানা গেছে, আগের দরপত্রে ৬ কোটি টাকা কমিশন বাণিজ্যের কথা থাকলেও এবার দর কমিয়ে দেওয়ায় বাণিজ্যের অঙ্কও অর্ধেক।

জানতে চাইলে টেকনো ড্রাগস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘সবাই ব্যবসা করতে চায়। আমিও ব্যবসার অংশ হিসাবেই প্রথম দরপত্রে বাড়িয়ে দর দিয়েছিলাম। কিন্তু দরপত্র বাতিল হয়ে যাওয়ায় দরের গোপনীয়তা ফাঁস হয়ে যায়। ফলে কাজটি পেতে পুনঃদরপত্রে দর অনেক কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। যাতে অন্য কেউ কাজ নিতে না পারে। এতে আমার ব্যবসায়িক ক্ষতি হলে হবে। তাতে কিছু যায় আসে না। আমি দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী ভ্যাকসিন সরবরাহ করলে কারও কিছু বলার থাকবে না। আমি আওয়ামী লীগ করি। দরকার হলে দেশের জন্য ফ্রি ভ্যাকসিন সরবরাহ করব।’

তবে মন্ত্রণালয়ের সিন্ডিকেটের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে কাজ বাগিয়ে নেওয়ার তৎপরতার কথা তিনি অস্বীকার করেন।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম