এমপি নদভীর বক্তব্যে চট্টগ্রামে তোলপাড়
সভাপতি মোতালেবের সঙ্গেও দ্বন্দ্ব চরমে * মনোনয়ন খোয়ানোর শঙ্কা! * আ.লীগ কর্মীকে চড় মারার ভিডিও ভাইরাল

শহীদুল্লাহ শাহরিয়ার, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ২৩ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে বিষোদগারমূলক বক্তব্য দিয়েছেন চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) সংসদীয় আসনের এমপি ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দিন নদভী।
১১ মার্চ একটি অনুষ্ঠানে দেওয়া তার এ বক্তব্য নিয়ে দক্ষিণ চট্টগ্রামে তোলপাড় চলছে। বইছে সমালোচনার ঝড়। এমপি নদভীর ওই বক্তব্যকে শিষ্টাচারবহির্ভূত, ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও অরাজনৈতিক বলে মন্তব্য করছেন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা।
অরাজনৈতিক ব্যক্তি বা বহিরাগত কেউ এমপি নির্বাচিত হওয়ার কারণেই এমন চিত্র দেখতে হচ্ছে। এদিকে ওই বক্তব্য দিয়ে কেন্দ্র থেকেও প্রচণ্ড চাপের মুখে পড়েছেন এমপি নদভী।
এমন বক্তব্যের খেসারত হিসাবে তাকে আগামী সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন খোয়াতে হতে পারে বলেও জানান সংশ্লিষ্টরা। এমপি নদভী বলছেন, তাকে বাদ দিয়ে তার এলাকায় কোনো প্রকল্পের নামফলক বসানোটাই রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত, বেআইনি। এ জন্য দলের সাধারণ সম্পাদকের কাছে তিনি বিচার দিয়েছেন। এমপি নদভীর আওয়ামী লীগের এক কর্মীকে চড় মারা ও শাসানোর একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কয়েক দিন ধরে ভেসে বেড়াচ্ছে। সাত বছর আগের একটি ঘটনা এখন কেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এলো, এর নেপথ্যে রহস্য কী-এমন প্রশ্ন তুলেছেন নদভী।
জানা গেছে, ১০ মার্চ সাতকানিয়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের চিববাড়ি এমএ মোতালেব কলেজের আইসিটি ভবনের উদ্বোধন করা হয়। সেখানে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ও বিপ্লব বড়ুয়া অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন। স্থানীয় সংসদ-সদস্য নদভী আমন্ত্রিত ছিলেন না। অভিযোগ, তার ডিও লেটারেই শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের আওতায় আইসিটি ভবন নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। অথচ সেখানে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এ কারণেই তিনি ক্ষেপে যান বিপ্লব বড়ুয়ার ওপর। পরদিন উপজেলার পদুয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান এসআই চৌধুরীর স্মরণ সভায় বক্তব্য দিতে গিয়ে বিপ্লব বড়ুয়াকে উদ্দেশ করে নদভী বলেন, ‘আপনি এমপি নির্বাচন করার আগে সাতকানিয়া সদর ইউনিয়নে একটু চেয়ারম্যান নির্বাচন করুন। আপনি যদি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন, আমি আপনাকে ক্যাশ ৫০ লাখ টাকা দেব।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিপ্লব বড়ুয়া সাহেব এ ধরনের প্রকল্প যদি উদ্বোধন করতে চান ভবিষ্যতে, তাহলে নির্বাচন করেন। এমপি হয়ে আসেন। তারপর উদ্বোধন করেন।’ এমপির এ বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ভাইরাল হয়।
বিপ্লব বড়ুয়ার বিরুদ্ধে এমন বক্তব্য দেওয়ার পর সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগসহ দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীর মধ্যে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। একজন এমপি কিভাবে প্রধানমন্ত্রীর একজন বিশেষ সহকারী ও আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদকের বিরুদ্ধে এমন বক্তব্য দিতে পারলেন তা নিয়ে সৃষ্টি হয় নানা প্রশ্ন। বিষয়টি গড়ায় কেন্দ্র পর্যন্ত। এমপি নদভীর বিরুদ্ধে সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করে। কিন্তু পরে কেন্দ্রের নির্দেশে তা বাতিল করা হয়।
দলীয় সূত্রগুলো জানায়, দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দলীয় এমপির বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করে কাদা ছোড়াছুড়ি না করার জন্য নির্দেশ দেন স্থানীয় নেতাদের। পাশাপাশি এমপি নদভীকেও তিনি শাসিয়ে দেন। প্রধানমন্ত্রীও বিষয়টিকে ভালোভাবে নেননি বলে সূত্র জানায়। এমন বেফাঁস বক্তব্যের কারণে আগামী নির্বাচনে এমপি নদভীকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন খোয়াতে হবে- এটা অনেকটা নিশ্চিত বলেই জানিয়েছেন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কেউ কেউ।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, এমপি নদভী প্রকাশ্যে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা শিষ্টাচারবহির্ভূত, অরাজনৈতিক। ত্যাগী নেতাদের অবমূল্যায়ন করলে যা হয় তার নমুনা সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় আমরা দেখতে পাচ্ছি। রাজনীতিবিদদের হাতেই রাজনীতি থাকা উচিত। সংসদ-সদস্য তারাই হতে পারেন যারা সংসদের মর্যাদা, সংসদ-সদস্য পদের মর্যাদা রক্ষা করতে পারেন। রাজনীতি করেননি অথচ দলের টিকিট নিয়ে যারা এমপি হয়েছেন তাদের হাতে দলের কর্মীরা লাঞ্ছিত, অপমানিত হবে সেটা কাম্য নয়। এটা দুঃখজনক। দলের জন্য বিব্রতকর। বিপ্লব বড়ুয়ার জন্মস্থান সাতকানিয়া। তিনি সেখানে বেড়ে উঠেছেন। শিশু-কিশোর সংগঠন থেকে শুরু করে ছাত্র রাজনীতি করে আজকের অবস্থানে গেছেন। তার জন্মস্থানে গিয়ে কোনো প্রকল্প উদ্বোধন করার এখতিয়ার তার আছে। এটা নিয়ে কটু কথা বলা, রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত বক্তব্য দেওয়া কাম্য নয়।
এদিকে এমপি নদভী যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি যে এলাকার এমপি সেই এলাকায় আমাকে না বলে, আমার ডিও লেটারে হওয়া প্রকল্প যিনি বা যারা উদ্বোধন করেছেন বরং তারাই রাজনৈতিক শিষ্টাচার লংঘন করেছেন। আমি দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাহেবকে ওই প্রকল্প উদ্বোধনের বিষয়ে আগের রাতে জানিয়েছিলাম। তিনিও আমার সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন। তিনি ওই অনুষ্ঠান বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আয়োজকরা সেই নির্দেশ মানেননি। উপজেলায় এলজিইডি, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, সড়ক ও জনপথ, টিআর, কাবিখাসহ সরকারি যত ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন হয় সব স্থানীয় এমপির আওতায়। এমপির ডিও লেটারেই এসব হয়। দুই মেয়াদে আমি অন্তত ৫০টি ভবন উদ্বোধন করেছি। ফলক তৈরি করেছে বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ। কলেজের আইসিটি ভবনের ফলকে শিক্ষা উপমন্ত্রী নওফেল ও বিপ্লব বড়ুয়ার নাম দেওয়া হয়েছে। অথচ আমি এমপি। আমাকে দাওয়াতও দেওয়া হয়নি। আমার নামও নেই।
জামায়াত থেকে অনুপ্রবেশ করে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছেন এমপি নদভী- এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আমাকে দু’দুবার আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দিয়েছেন। এখন আমাকে জামায়াত বলে লাভ নেই। তাছাড়া আমি বিদেশে লেখাপড়া করেছি। জামায়াত বা শিবিরের প্রাথমিক সদস্যপদ কখনো আমার ছিল না।’ এমএ মোতালেব কীভাবে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়েছেন তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি। মোতালেবের ছোট ভাই মাহমুদুল হক দক্ষিণ জেলা জামায়াতের রোকন পর্যায়ের নেতা। আমার পরিবারে ৯ জন মুক্তিযোদ্ধা। আর মোতালেব-আমিনের পরিবারে কতজন জামায়াত আছে তা আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখেন। বিপ্লবের পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড কী তাও খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন।’ নদভী বলেন, ‘সাতকানিয়া সদর ইউনিয়নে রাজাকারপুত্র সেলিমকে চেয়ারম্যান বানানোর জন্য আমাকে বিপ্লব বড়ুয়া চাপ দেন। আমি শর্ত দিয়েছিলাম ৯ জন মেম্বার যাতে আওয়ামী লীগ থেকে বানানো হয়। পরে দেখা গেছে, আটজনই বিএনপি-জামায়াতের লোক।’
সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এমএ মোতালেব যুগান্তরকে বলেন, ‘কলেজের অপর একটি অনুষ্ঠানে এমপি সাহেবকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। তিনি আসেননি। তিনি আমার সালামও নেন না। কলেজের ভবন উদ্বোধনের জন্য শিক্ষা উপমন্ত্রীর শিডিউল নিয়েছি। কিন্তু এমপি সাহেব দেশের বাইরে থাকায় তাকে আমন্ত্রণ জানাতে পারিনি। জানালেও তিনি আসতেন না। এটা আমি নিশ্চিত। আমি উপজেলা চেয়ারম্যান। ১৭টি ইউনিয়নের নেতৃত্ব দিই। অথচ আমি যে ইউনিয়নের বাসিন্দা সেই ইউনিয়নে তিনি আমাকে দাওয়াত না দিয়ে, ইউপি চেয়ারম্যানকে দাওয়াত না দিয়ে সুধী সমাবেশ করে আসেন। আমাদের বিরুদ্ধে অশ্লীল ভাষায় কথা বলে আসেন। সেটা কী রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত কাজ নয়।’ এমএ মোতালেব আরও বলেন, ‘কলেজ ভবন উদ্বোধনের জন্য যে নামফলক তৈরি করেছিলাম, আগের রাতে মুখোশ পরে গিয়ে সেই নামফলক ভেঙে দেওয়া হয়। ফাঁকা গুলি করে ভীতি সৃষ্টি করা হয়। নিশ্চয় এসব এমপির লোকজনের কাজ। এটা পরিষ্কার।’
সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করে জানান, ড. আবু রেজা নদভী ব্যক্তিগতভাবে কখনো আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তিনি জামায়াত ঘরানার লোক হিসাবেই সমধিক পরিচিত ছিলেন। ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর পৃষ্ঠপোষক। তার শ্বশুর মোমিনুল হক চৌধুরী চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতের রোকন ছিলেন। তার স্ত্রী রিজিয়া রেজা চৌধুরী ছিলেন জামায়াতের নারী সংগঠন ছাত্রী সংস্থার চট্টগ্রাম নগর শাখার সভানেত্রী। এর পরও ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বাগিয়ে নিয়ে এমপি হন নদভী। পরবর্তী মেয়াদেও তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বাগিয়ে নেন। যদিও তার এই মনোনয়ন পাওয়া নিয়ে শুরু থেকে দলের সাধারণ নেতা-কর্মীদের মধ্যে চরম অসন্তোষ ছিল।
নদভীর চড় মারার ভিডিও ভাইরাল : সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, এক কর্মীকে চড় মারছেন এবং শাসাচ্ছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৯ সালে লোহাগাড়ায় একটি সড়ক-সেতু নির্মাণ প্রকল্প পরিদর্শনে যান এমপি নদভী। সেখানে জসিম উদ্দিন চৌধুরী নামে এক আওয়ামী লীগ কর্মী প্রকল্পের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, ‘যেখানে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু দিতে হবে। তবেই রোড মজবুত হবে। তারা আসে। কিন্তু যে পরিমাণ দরকার সেই বরাবর দেয় না।’ তখন এমপি নদভী জসিম উদ্দিনের গালে চড় মারেন। তাকে শাসিয়ে বলেন, ‘এখনো মানুষ চিনিস নাই। কথা বেশি বলিস। আমি কথা শেষ করেছি? আমি এখন প্রধান প্রকৌশলীর সঙ্গেই কথা বলতাম। আমাকে চিনিস নাই বেয়াদব। আমি যা করতে পারব সেটা তোরা করতে পারবি, তাই না? ফালতু কোথাকার। আমি কতটা গরম সেটা জানিস না। একেবারে জ্যান্ত পুঁতে ফেলব। অমুক আওয়ামী লীগের নেতা এসব আমার এখানে চলবে না। আমার এখানে চলবে বাস্তবতা।’ ওই সময় তৎকালীন লোহাগাড়া উপজেলা চেয়ারম্যান জিয়াউল হক বাবুলও উপস্থিত ছিলেন।
এ বিষয়ে এমপি নদভী বলেছেন, সাত বছর আগের একটি ঘটনা এখন কেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এলো। কারা এটি করছে তা তার অজানা নয়। অন্যায়ভাবে কেউ কথা বললে তাকে শাসানো বা যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করা এমপি হিসাবে তার দায়িত্ব। এগুলো করে একটি পক্ষ জল ঘোলা করতে চাচ্ছে।