একতরফা নির্বাচন নিয়ে বিশিষ্ট আইনজ্ঞদের অভিমত
সুপ্রিমকোর্ট বারের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ
দুটি আইনজীবী সমিতি করা দরকার : ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম * বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা পরিকল্পিতভাবে এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে : ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন * সংকট নিরসনে জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের উদ্যোগ নেওয়ার তাগিদ : ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ * দক্ষ আইনজীবীর খুবই অভাব : ড. শাহদীন মালিক
আলমগীর হোসেন
প্রকাশ: ১৯ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনকে ঘিরে যা ঘটেছে তা সুপ্রিমকোর্ট বারের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এসব ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক, হতাশাজনক এবং অনাকাঙ্ক্ষিত।
ঘটনাগুলো আইনজীবীদের ইমেজ সংকট তৈরি হয়েছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। বিএনপির প্রতিবাদের মুখে সুপ্রিমকোর্টে সরকার সমর্থক আইনজীবীদের একতরফা নির্বাচন ও পরবর্তী কার্যক্রমের বিষয়ে দেশের বিশিষ্ট আইনজীবীরা এভাবেই তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তারা বলেছেন, এ অবস্থা থকে আইনজীবী সমিতিকে যে কানো উপায়ে রক্ষা করতে হবে।
বিশিষ্ট সংবিধান বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যা দুঃখজনক। এর আগে সুপ্রিমকোর্ট বারে এমন ঘটনা কখনো ঘটেনি। এসব ঘটনায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি যারাই জড়িত থাকুক না কেন এটা খুবই অপ্রত্যাশিত।
তিনি বলেন, সাম্প্রতিককালে যেসব ঘটনা ঘটেছে তাতে সুপ্রিমকোর্ট বারের ইমেজ নষ্ট হয়েছে। বারে অযোগ্য লোকদের উপস্থিতি বাড়ছে। তিনি বলেন, জুনিয়র আইনজীবী সমিতি এবং সিনিয়র আইনজীবী সমিতি গঠনের মাধ্যমে বারকে আলাদা করা দরকার।
দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নেই, এই বার্তা দেওয়ার জন্য বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা পরিকল্পিতভাবে এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে বলে মনে করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সুপ্রিমকোর্ট বারের সাবেক সভাপতি ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন। তিনি বলেন, বার নির্বাচন ঘিরে যা ঘটেছে, তা দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক। ঢাকা বারের নির্বাচনেও বিএনপিপন্থিরা একই অবস্থা করেছিল। তখনই আমি অনুমান করেছিলাম, এরা সুপ্রিমকোর্ট বারেও বিশৃঙ্খলা করবে। এসব করে তারা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মেসেজ দিতে চায় যে, এখানে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নেই। তাদের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়ে গেছে।
বর্তমান সংকট নিরসনে জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের উদ্যোগ নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। তিনি যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচন নিয়ে যা ঘটেছে তা একেবারে কাম্য নয়। সুপ্রিমকোর্ট হচ্ছে জনগণের শেষ আশ্রয়স্থল। সাধারণ মানুষের মাঝে এর একটা মর্যাদা আছে। এখানের আইনজীবীদেরও একটা ব্যক্তিত্ব রয়েছে। কিছু সংখ্যক আইনজীবীর কারণে সুপ্রিমকোর্ট বারের ভাবমূর্তি নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও বারের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার মনসুরুল হক চৌধরী পদত্যাগ করায় সংকট তৈরি হয়। আমরা চেষ্টা করেছিলাম নির্বাচন কমিশন গঠন করার। কিন্তু আওয়ামী লীগপন্থি আইনজীবীদের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাইনি। পরে তারা পুলিশের বেষ্টনীতে একতরফা নির্বাচন করল। তিনি বলেন, আমার জীবনে এমন নির্বাচন আর দেখিনি। অবিলম্বে এই ফলাফল বাতিল ও পুনঃতারিখ ঘোষণা করে নির্বাচন দিতে হবে।
মানসন্মত আইনজীবীর সংকট দিন দিন বাড়ছে বলে মনে করছেন বিশিষ্ট সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক। তিনি যুগান্তরকে বলেন, দেশে মামলা বাড়ছে কিন্তু মানসম্মত আইনজীবী তৈরি হচ্ছে না। আইনজীবীরা একে অপরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন। দক্ষ ও যোগ্য আইনজীবীর খুবই অভাব। তিনি বলেন, বারকে দলীয়করণ করা হয়েছে। দেশে গণতন্ত্র নেই দীর্ঘদিন। জাতীয় নির্বাচনের অব্যবস্থাপনার প্রতিফলন হচ্ছে সুপ্রিমকোর্ট বারের নির্বাচন।
সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরশেদ যুগান্তরকে বলেন, অতীতে যারা সুপ্রিমকোর্ট বারের দায়িত্বে ছিলেন তারা এভাবে বারকে বিতর্কিত করেননি। এমন পরিস্থিতি কখনো তৈরি হয়নি, এতে সুপ্রিমকোর্ট বারের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। বারে এখন যারাই নেতেৃত্ব দিচ্ছেন তারা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। অবস্থা এমন যে, জোর যার মুল্লুক তার। সত্য কথা বলতে কেউ সাহস পান না। রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলে সবাই ব্যস্ত। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে আরও খারাপ অবস্থা হবে। তাই দ্রুত এর লাগাম ধরতে হবে।
১৫ ও ১৬ মার্চ অনুষ্ঠিত বারের নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা হয় ২৩ ফেব্রুয়ারি। এরপর বিএনপি ও আওয়ামী লীগপন্থিরা দুটি নির্বাচন উপ-কমিটি ঘোষণা করে। অ্যাটর্নি জেনারেল ও সিনিয়রদের বৈঠকের পর জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মুনসুরুল চৌধুরীকে প্রধান করে কমিটি গঠন করা হয়। উভয় পক্ষ এ কমিটিকে মেনে নেয়।
কিন্তু নির্বাচনের আগের দিন মুনসুরুল চৌধুরী পদত্যাগের খবর আসায় সংকটের সৃষ্টি হয়। ফের দুই পক্ষ দুটি কমিটি গঠনের কথা জানায়। আওয়ামীপন্থিরা মো. মনিরুজ্জামানকে ও বিএনপিপন্থিরা এএসএম মোক্তার কবির খানকে আহ্বায়ক করেন।
এমন পরিস্থিতিতে গত বুধবার নির্বাচনের প্রথম দিনের ভোট চলাকালে সাদা (সরকার সমর্থক) ও নীল (বিএনপি সমর্থক) দলের দিনভর দফায় দফায় ধাওয়া-পালটা ধাওয়া, হাতাহাতি, হামলা, ভাঙচুর ও পুলিশের লাঠিপেটার ঘটনা ঘটে। এতে আইনজীবী, সাংবাদিকসহ অন্তত ২৫ জন আহত হন। পরদিনও দুদলের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি হয়। পুলিশি প্রহরায় ওইদিন নির্বাচন সম্পন্ন হয়। নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পায় আওয়ামী লীগপন্থি আইনজীবী প্যানেলের প্রার্থীরা।