ফিরোজবিরোধী বিক্ষোভ
নেতৃত্বে একাধিপত্যের বলি বাউফল আ.লীগ
শুক্রবারের সংঘর্ষের ঘটনায় আড়াইশ জনের বিরুদ্ধে পুলিশের মামলা
আকতার ফারুক শাহিন ও আরেফিন সহিদ, বাউফল (পটুয়াখালী) থেকে
প্রকাশ: ১৯ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
উপজেলা চেয়ারম্যান মোতালেব হাওলাদারকে কুপিয়ে জখম করার ঘটনায় বাউফলে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
শনিবার পৌর এলাকার দোকান, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুললেও অন্যান্য দিনের মতো ছিল না জনসমাগম। মোতালেব হাওলাদারকে কুপিয়ে জখমের ঘটনায় এদিন সংবাদ সম্মেলন করেন তার ছেলে যুবলীগের জেলা সাংগঠনিক সম্পাদক মাহমুদ হাসান। তিনি মোতালেবের নিজ ইউনিয়ন বগার চেয়ারম্যানও।
সংবাদ সম্মেলনে হামলার জন্য তিনি এমপি আ স ম ফিরোজকে দায়ী করে তার বিচার দাবি করেন। এরপর সন্ধ্যায় হামলার বিচার ও এমপি ফিরোজের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল হয় বগা বন্দরে।
এদিকে শুক্রবারের সংঘর্ষের ঘটনায় অজ্ঞাতনামা প্রায় আড়াইশ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে বাউফল থানা পুলিশের এসআই মনিরুজ্জামান। মামলায় সরকারি কাজে বাধা ও পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগ আনা হয়েছে।
যে কারণে শুক্রবারের সংঘর্ষ : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০৩তম জন্মবার্ষিকী পালনে দেশজুড়েই ছিল প্রস্তুতি। তবে পটুয়াখালী-২ নির্বাচনি এলাকা বাউফলের পরস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেখানে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনকে সামনে রেখে চলে আধিপত্য বিস্তারের লড়াই। ক্ষমতাসীন দলের বিবদমান ৩ গ্রুপ আয়োজন করে পৃথক কর্মসূচির।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, ‘বহুদিন ধরেই এখানে আওয়ামী লীগে ছিল দুই গ্রুপ। এর একটি নিয়ন্ত্রণ করেন পৌর মেয়র জিয়াউল হক জুয়েল। অপরটির নেতা সাবেক চিফ হুইপ সংসদ সদস্য আ স ম ফিরোজ। এই দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বে প্রায়ই হয় সংঘাত-সংঘর্ষ।
সম্প্রতি উপজেলা চেয়ারম্যান উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ. মোতালেব হাওলাদারের মঙ্গে বিরোধ বাধে ফিরোজের। বিভক্ত আওয়ামী লীগে তৈরি হয় তৃতীয় গ্রুপ। শুরু থেকেই এমপি ফিরোজের পালটাপালটি নানা কর্মসূচি পালন করে আসছিলেন মোতালেব। সর্বশেষ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনকে ঘিরে শুরু হয় শোডাউনের প্রস্তুতি। একইদিনে মেয়র জুয়েলও ঘোষণা দেন পৃথক র্যালি সমাবেশের।
কর্মসূচি ঘোষণা করে এমপি ফিরোজ গ্রুপও। বাউফল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আল মামুন বলেন, ‘সংঘাত এড়ানোর চেষ্টা ছিল আমাদের। ৩ পক্ষের সঙ্গে আলাদাভাবে যোগাযোগও করেছি। বেঁধে দেওয়া হয় কর্মসূচি পালনের সময়সূচি। কোনোভাবেই যাতে তারা মুখোমুখি না হন সেজন্য র্যালির রুটও ঠিক করে দেওয়া ছিল। চেয়ারম্যান পক্ষের সঙ্গে হওয়া কথা অনুযায়ী র্যালি নিয়ে উপজেলা পরিষদ পর্যন্ত আসবে তারা। সেখানে পুলিশ বাধা দিলে সমাবেশ করে ফিরে যাবে। কেননা উপজেলা পরিষদ থেকে খানিকটা সামনে জনতা ভবনে ছিল এমপি সাহেবের প্রোগ্রাম।
সবকিছু ঠিক করা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা মানেনি উপজেলা চেয়ারম্যান ও তার লোকজন। জোর করে ব্যারিকেট ভেঙে সামনে এগোতে গিয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় পুলিশের সঙ্গে। গুলিবর্ষণ ও লাঠিচার্জ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেই আমরা। পুলিশ যখন পরিস্থিতি সামলানোয় ব্যস্ত সে সময় ব্যারিকেট এড়িয়ে জনতা ভবন চত্বরের দিকে যান উপজেলা চেয়ারম্যান। তখনই প্রতিপক্ষের হামলার শিকার হন তিনি।’
ঘটনাস্থলের এক দোকান মালিক বলেন, ‘পুলিশি ব্যারিকেট এড়িয়ে ৮-১০ গজ সামনে পুরোনো বিএনপি অফিসের সামনে যাওয়ার পরপরই হামলা হয় মোতালেবের ওপর। সেখানে আগে থেকেই লাঠিসোঁটা আর ধারালো অস্ত্র নিয়ে ছিল এমপি ফিরোজের অনুসারীরা। পরে পুলিশসহ অন্যরা উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায় তাকে। ঘটনার সময় জনতা ভবন চত্বরে চলছিল এমপি গ্রুপের জমায়েত। আ স ম ফিরোজ উপস্থিত ছিলেন সেখানে।’
বাউফলের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০৮-এ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই মূলত শুরু হয় সংঘাতময় পরিবেশ। প্রথমে জুয়েল এবং পরে মোতালেব বিভক্ত আওয়ামী লীগের তিন খণ্ডে প্রায়ই ঘটে সংঘর্ষ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সামনেও সংঘর্ষ হয়েছে ফিরোজ ও জুয়েল গ্রুপের। ২০১৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ঘটে ওই ঘটনা। ২০২০ সালের ২৪ মে এই দুই গ্রুপের সংঘর্ষে নিহত হন যুবলীগ নেতা তাপস। সর্বশেষ সংঘর্ষ হলো এমপি এবং উপজেলা চেয়ারম্যান গ্রুপে। উপজেলার বিভিন্ন পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, ‘প্রথমে ২ এবং পরে ৩ গ্রুপের এই দ্বন্দ্বে নাভিশ্বাস দশায় আছেন দলের নেতাকর্মীরা। কেবল সংঘর্ষই নয়, একে-অপরকে দমাতে মামলা-পালটা মামলায় আসামি করা হয় হাজার হাজার নেতাকর্মীকে। কে কার লোক, এই মারপ্যাঁচে চরম দুর্ভোগে আছেন নেতাকর্মীসহ সাধারণ জনগণ।’
এমপি ফিরোজের একাধিপত্যে খণ্ড-বিখণ্ড দল : ৪০ বছর ধরে বাউফল উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে আছেন একসময়ের তুখোর ছাত্রনেতা আ স ম ফিরোজ। পটুয়াখালী-২ (বাউফল) আসনে সপ্তমবারের মতো আছেন সংসদ-সদস্যের দায়িত্বে। বাউফলের সাধারণ মানুষসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে আলাপ করে একটি বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, ভোটের রাজনীতি প্রশ্নে এখনো এই আসনে অপ্রতিদ্বন্দ্বী তিনি। তবে সমস্যা অন্যত্র। বিপুল জনসমর্থনের পাশাপাশি দলেও একক আধিপত্য ধরে রেখেছেন ফিরোজ। টানা ৪০ বছর সভাপতির পদ আঁকড়ে রাখার পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে সাধারণ সম্পাদক পদে বসিয়েছেন আস্থাভাজনদের। যে মোতালেবের সঙ্গে তার এত দ্বন্দ্ব, তিনিও ছাত্রজীবন থেকে তারই হাতে গড়া। পরপর দুবার দলের সাধারণ সম্পাদক করেছেন তাকে। কেবল মোতালেবই নন, বাউফলে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের প্রায় সব পদেই রয়েছে ফিরোজের অনুসারী। আগাগোড়া পছন্দের লোকজন দিয়েই তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন দল। তার এই একক অধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রথম প্রকাশ্য প্রতিবাদ করেন মেয়র জুয়েল। ফিরোজের বিরোধিতা সত্ত্বেও বিদ্রোহী প্রার্থী হিসাবে মেয়র নির্বাচিত হন তিনি। পরে অবশ্য দলীয় মনোনয়নেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মেয়র হন জুয়েল।
হামলা-সংঘর্ষে আহত হওয়ার কিছুদিন আগে যুগান্তরকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ফিরোজের সঙ্গে বিরোধের কারণ নিয়ে কথা বলেছিলেন মোতালেব। তখন তিনি বলেন, ‘৪০ বছর ধরে এমপি ফিরোজ সভাপতি। এমপি হয়েছেন সাতবার। এরপরও আমরা কখনো কথা বলিনি। এখন তিনি এই ধারা বজায় রাখতে চাইছেন ছেলেকে দিয়ে। এটা নিয়েই মূলত বিরোধের শুরু। তার ছেলে রায়হান সাকিব আওয়ামী লীগের কেউ নন। অথচ হঠাৎ দেখি নিজে সভাপতি আর ছেলেকে সিনিয়র সহসভাপতি করে ঘোষণা করেছেন কমিটি। যদিও সেই কমিটির অনুমোদন দেয়নি কেন্দ্র। এমপি ফিরোজ একজন ঋণখেলাপি। খেলাপির দায়ে যদি মনোনয়ন বাতিল হয়, সেই ভয়ে নিজের পাশাপাশি ছেলেকে দিয়ে একবার দাখিল করালেন জাতীয় নির্বাচনের মনোনয়নপত্র। এর মানে হচ্ছে-ওনার পর তার ছেলের আনুগত্যে চলতে হবে। তাহলে এই যে আমরা যুগ যুগ আওয়ামী লীগ করছি, এর কোনো মূল্যায়ন নেই?’
বাউফলের ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলেও মিলেছে প্রায় একই তথ্য। কালিশুরী এলাকার বাসিন্দা এলেম মুন্সী বলেন, ‘এখানে মোট ৮ জন চাইছেন দলীয় মনোনয়ন। হিসাব করলে দলে গ্রুপও আছে ৮টি। তবে প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব ৩ গ্রুপে। ফিরোজ সাহেব যদি পুরো দলকে পকেটে না রেখে কিছুটা হলেও নেতৃত্বের ভাগ দিতেন, তবে আজ এই অবস্থা হতো না। আওয়ামী লীগের মতো বড় দলে যোগ্য নেতার অভাব নেই। সেখানে টানা ৪০ বছর যদি তিনি দলকে কুক্ষিগত করে রাখেন, তাহলে বিদ্রোহ-বিক্ষোভ হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক।’
যা বললেন এমপি আ স ম ফিরোজ : একাধিপত্যের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে এমপি ফিরোজ বলেন, ‘কমিটি হয় তো সম্মেলনের মাধ্যমে। কেন্দ্রীয় ও জেলা নেতারা ছাড়াও উপস্থিত থাকেন কাউন্সিলররা। আমি তো কাউকে সভাপতি হতে নিষেধ করিনি। কাউন্সিলে প্রার্থী হয়ে ভোটে জিতে যে কেউ সভাপতি হতে পারেন। আমার প্রশ্ন হচ্ছে-কেউ প্রার্থী হয় না কেন? তখন তো সম্মেলনজুড়ে রব উঠে যে আমাকেই সভাপতি থাকতে হবে। আমি সাতবার এমপি হয়েছি। এর মধ্যে একবার স্বতন্ত্র এবং ছয়বার নৌকা প্রতীকে। জনসমর্থন না থাকলে নিশ্চয়ই জননেত্রী শেখ হাসিনা আমায় মনোনয়ন দিতেন না।’
শুক্রবারের সংঘর্ষ আর উপজেলা চেয়ারম্যানের ওপর হামলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘৪০ বছর ধরে বাউফল আওয়ামী লীগের কার্যালয় জনতা ভবন। সেখানে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিই আমরা। মোতালেব সাহেব তো দেড়-দুই বছর ধরে জনতা ভবনে আসেন না। হঠাৎ তিনি কেন সেই জনতা ভবনেই কর্মসূচি দিলেন? ইচ্ছে করে তিনি এটা করেছেন গোলমাল বাধানোর জন্য। আমরা তো প্রশাসনের বেঁধে দেওয়া সময় আর রুট ধরে র্যালি-সমাবেশ করেছি। আমার দলের কারও সঙ্গে তো সংঘর্ষ হয়নি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা পুলিশের সঙ্গে হয়েছে। তারা ছড়াচ্ছেন যে আমার সামনে নাকি হামলা হয়েছে, প্রশ্নই ওঠে না। ঘটনার সময় আমি ছিলাম জনতা ভবনে। আর হামলা হয়েছে রাস্তায় পুরোনো বিএনপি অফিসের সামনে। আমার নাম জড়িয়ে মোতালেব ও তার লোকজন রাজনৈতিক ফায়দা নিতে চাচ্ছে।’
উত্তরসূরি হিসাবে ছেলেকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টার প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এমপি মন্ত্রীর ছেলে-মেয়েরা কি রাজনীতি করবে না? মোতালেব কি তার নিজের ছেলেকে নিজ ইউনিয়নে চেয়ারম্যান বানায়নি? যুবলীগের নেতা বানায়নি? তাহলে আমার ছেলেকে নিয়ে প্রশ্ন উঠবে কেন? আমার ছেলের যদি যোগ্যতা থাকে, তাহলে সে অবশ্যই রাজনীতি করবে। না থাকলে করবে না। এটা নিয়ে তো কোনো কথা হতে পারে না।’