Logo
Logo
×

শেষ পাতা

ফাইলবন্দি পর্যটন সম্ভাবনা

অনিশ্চিত মধুমতির কলকাতা যাত্রা

যাত্রী পরিবহণের জাহাজ দিয়ে নৌ-বিহার সম্ভব নয়-বিআইডব্লিউটিসি পরিচালক

Icon

আকতার ফারুক শাহিন, বরিশাল

প্রকাশ: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অনিশ্চিত মধুমতির কলকাতা যাত্রা

চার বছরে আর একবারও কলকাতা যায়নি মধুমতি। অথচ কথা ছিল বাণিজ্যিক ভিত্তিতে নিয়মিত ঢাকা-কলকাতা নৌরুটে যাত্রী পরিবহণ করবে এই জাহাজ। একইভাবে ভারতীয় পতাকাবাহী জাহাজও চলবে একই রুটে। দুই দেশের উচ্চ পর্যায়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত এবং আন্তঃদেশীয় নৌ-প্রটোকলের আওতায় তখন পরীক্ষামূলক যাত্রাও হয়েছিল। তারপর থেমে গেছে সব।

যাত্রী নিয়ে আর চলেনি দুই দেশের জাহাজ। কলকাতা যাত্রার জন্য নতুনভাবে প্রস্তুত করা মধুমতিরও যাওয়া হয়নি ওই শহরে। পুরো বিষয়টির জন্য সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দুষছেন এই রুটে চলাচলে আগ্রহী পর্যটক ও যাত্রীরা। চার বছর আগে মন্ত্রণালয়ে জমা হওয়া এ সংক্রান্ত প্রস্তাবনা আর সুপারিশ সত্ত্বেও কেন এর অগ্রগতি হলো না সেই প্রশ্ন তুলছেন তারা।

এর জবাবে নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ‘বিষয়টি থেমে গেছে এমন নয়। নতুন দুটি ক্রুজ লাইনার নির্মাণের কাজ চলছে। এগুলোর নির্মাণ শেষ হলেওই আবার শুরু হবে ঢাকা-কলকাতা রুটে জাহাজ পরিচালনার কাজ।’

একসময় নিয়মিত জাহাজ চলত কলকাতা-বাংলাদেশের মধ্যে। ১৮৭৪ সালে এই রুটে প্রথম বাষ্পচালিত জাহাজে যাত্রী পরিবহণ শুরু করে ব্রিটিশ আইজিএন-আরএসএন কোম্পানি। সড়ক ও রেলপথের উন্নয়ন এবং দেশ বিভাগের কারণে ১৯৪৮ সালে বন্ধ হয়ে যায় ওই সার্ভিস। দীর্ঘ ৭০ বছর পর ২০১৮ সালে এই রুটে আবার যাত্রীবাহী জাহাজ পরিচালনার উদ্যোগ নেয় দুই দেশের সরকার।

বাণিজ্যিক সম্ভাবনাসহ খুঁটিনাটি দিক পর্যবেক্ষণে সিদ্ধান্ত হয় দুই দেশের জাহাজের বিপরীতমুখী যাত্রার। ঢাকা থেকে কলকাতা এবং কলকাতা থেকে ঢাকা চলাচল করবে ভারত-বাংলাদেশের পতাকাবাহী দু’টি জাহাজ। সে অনুযায়ী ২০১৯-এর ২৯ মার্চ ঢাকা থেকে কলকাতা অভিমুখে যাত্রা করে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহণ করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) জাহাজ এমভি মধুমতি। একই দিনে কলকাতার খিদিরপুর থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসে ভারতীয় জাহাজ আরভি বেঙ্গল গঙ্গা।

সরকারি কর্মকর্তা এবং জাহাজের ক্রু ছাড়াও এমভি মধুমতি চেপে ভারত যাওয়ার উদ্দেশে টিকিট কাটেন ৮৫ যাত্রী। অপরদিকে বেঙ্গল গঙ্গা জাহাজে ক্রু এবং ভারতীয় কর্মকর্তা ছাড়া ছিলেন জনা-পঞ্চাশেক পর্যটক। দুই দেশের নৌ সীমান্ত সুন্দরবনের আংটিহারা এলাকায় দেশ অতিক্রমের সব কাজ সম্পন্ন করে বাংলাদেশ ও ভারতে ঢোকে দুই দেশের জাহাজ। বাংলাদেশে ঢোকার পর আরভি বেঙ্গল গঙ্গা বরিশালে এসে নোঙ্গর করে ওই বছরের ৩ এপ্রিল। পরে সেটি গিয়ে পৌঁছায় ঢাকায়।

অপরদিকে এমভি মধুমতি কলকাতার খিদিরপুরে পৌঁছায় প্রায় একই সময় ৩ এপ্রিল সকালে। সে সময় এই জাহাজ সার্ভিস নিয়ে যেমন ব্যাপক প্রচারণা চলে দুদেশের মিডিয়ায় তেমনি জাহাজে করে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়া নিয়ে আগ্রহও তৈরি হয় মানুষের মধ্যে। পরীক্ষামূলক এই জাহাজ চলাচল বিষয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি সংস্থার চালানো প্রচারণায় ফলাও করে বলা হয় নিয়মিত বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চলবে এই সার্ভিস।

৪ রাত ৫ দিনের এই যাত্রায় নৌ-পথের নৈসর্গিক দৃশ্য এবং সুন্দরবনের অপার সৌন্দর্য দেখতে দেখতে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাবে মানুষ। মূলত পর্যটন খাতের বিষয়টি মাথায় রেখেই তখন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এভাবে জাহাজ চালানোয় আগ্রহী হয়ে উঠেছিল দুই দেশের সরকার। সফল সেই যাত্রার পর কেটে গেছে প্রায় ৪ বছর। আর এগোয়নি নিয়মিত জাহাজ পরিচালনার বিষয়টি। মধুমতিরও যাওয়া হয়নি কলকাতায়।

নৌ যান ও নৌ পথ বিশেষজ্ঞ নাসিম উল আলম বলেন, ‘বাংলাদেশ থেমে গেলেও ভারত কিন্তু এই সার্ভিসের লাভজনক দিকটি ঠিকই বুঝেছে। বাংলাদেশ থেকে কোনো জাহাজ না গেলেও গত ৪ বছর বেশ কয়েকবার পর্যটক নিয়ে বাংলাদেশে এসেছে ভারতীয় জাহাজ। বর্তমানে ভারতীয় ক্রুজ লাইনার ‘গঙ্গা বিলাস’ বিশ্বের দীর্ঘতম নৌ-বিহারে অতিক্রম করছে বাংলাদেশের নদ-নদী।

টাকার অংকে মাথাপিছু প্রায় ১৫ লাখ করে দিয়ে ৫১ দিনের এই দীর্ঘ যাত্রায় ভ্রমণ করছে ২৮ পর্যটক। কেবল গঙ্গা বিলাস-ই নয়, এর আগে ভারতীয় পর্যটকবাহী জাহাজ আরভি মহাবাহু পর্যটক নিয়ে দুবার এসেছে বাংলাদেশে। ভারত থেকে বাংলাদেশ হয়ে আসাম পর্যন্ত নৌ-পথের পর্যটন যে কতটা আকর্ষণীয় আর লাভজনক তা ঠিকই বুঝেছেন ভারতীয় ব্যবসায়ীরা। অথচ নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশের সরকার বা সংশ্লিষ্টরা যেন এ ব্যাপারে পুরোপুরি উদাসীন। তারা এদিকে কোন ভ্রূক্ষেপই করছেন না।’

পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বিআইডব্লিউটিসি’র এক কর্মকর্তা বলেন, ‘২০১৯’র ওই যাত্রার পর বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বাংলাদেশ-ভারত নৌ চলাচলের বিষয়ে বিস্তারিত একটি সার সংক্ষেপ প্রস্তুত করে জমা দেওয়া হয় নৌ-পরিবহণ মন্ত্রণালয়ে। সেখানে এই যাত্রার সমস্যা ও সম্ভাবনাসহ সব বিষয় তুলে ধরে বিআইডব্লিউটিসি। কিন্তু তারপর আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। শুরুতে করোনার কথা বলে কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়। বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও চুপচাপ সব।’

ট্যুরিজম সেক্টর নিয়ে কাজ করা নাসিরউদ্দিন বিপ্লব বলেন, ‘ফি বছর দেশ-বিদেশের লাখ লাখ পর্যটক আমাদের সুন্দরবন দেখতে আসে। তাছাড়া বিদেশিদের কাছে পর্যটনের অন্যতম জনপ্রিয় একটি মাধ্যম নৌ-বিহার। এই যে গঙ্গা বিলাস, এতে যারা ভ্রমণ করছেন তারা কিন্তু সবাই ইউরোপিয়ান। ভারতকে গন্তব্য ধরে বাংলাদেশ থেকে জাহাজ পরিচালনা করা হলে নৌপথে ভ্রমণ ছাড়াও নানা দর্শনীয় স্থান দেখার পাশাপাশি সুন্দরবন ভ্রমণের সুযোগ পাবে যাত্রীরা। শুরু করা সম্ভব হলে এটি যে পর্যটন খাতে কতবড় বিপ্লব আনবে, তা আমরা কল্পনাও করতে পারছি না। তারপরও যে কেন এক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে সরকার সেটাই জিজ্ঞাসা।’

পুরো বিষয়টি নিয়ে আলাপকালে বিআইডব্লিউটিসি’র পরিচালক (বাণিজ্য) আশিকুজ্জামান বলেন, ‘বাংলাদেশ-ভারত নৌপথের যাত্রা যে লাভজনক সেটা আমরাও বুঝি। কিন্তু এই যাত্রার জন্য আমরা প্রস্তুত কি না সেটাও তো ভাবতে হবে। ৪ বছর আগে মধুমতি জাহাজ নিয়ে আমরা কলকাতায় গেছি। এই জাহাজের যাত্রী ধারণক্ষমতা প্রায় ৫শ হলেও কেবিন রয়েছে মাত্র ৬০টি। ৪ রাত ৫ দিনের এই যাত্রায় মোটা অংকের ভাড়া দিয়ে নিশ্চয় কেউ জাহাজের ডেকে শুয়ে যাবেন না। যাত্রী কম হলে যাত্রার খরচ উঠবে না মধুমতির। তাছাড়া ক্রুজ লাইনার ধরনের বিবেচনায় মোটেই উপযোগী নয় এই জাহাজ। এই যে গঙ্গা বিলাস বাংলাদেশে এলো, এটিতে ৫ তারকা মানের হোটেলের সুবিধা রয়েছে। ফলে ৫১ দিনের নৌ-যাত্রায় একঘেয়েমি লাগবে না এর যাত্রীদের। সাধারণ রুটে যাত্রী পরিবহণের জাহাজ দিয়ে তো আর নৌ-বিহার পরিচালনা সম্ভব নয়। মন্ত্রণালয়ে দেওয়া এ সংক্রান্ত প্রস্তাবনা যেমন জমা আছে তেমনি দীর্ঘ এই পথে জাহাজ পরিচালনার প্রক্রিয়াও থেমে নেই। সরকারি উদ্যোগে বর্তমানে কর্ণফুলী ডক ইয়ার্ডে দুটি ক্রুজ লাইনার নির্মাণের কাজ চলছে। চলতি বছরের মধ্যেই ওই দুটি হাতে পাওয়ার কথা আছে বিআইডব্লিউটিসির। এই দুটি জাহাজে যেসব সুযোগ-সুবিধা যুক্ত করা হচ্ছে তা দিয়ে নৌপথে এ ধরনের প্রমোদ বিহার পরিচালনা সম্ভব। জাহাজ হাতে পাওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে দ্বিতীয় পর্যায়ের কার্যক্রম শুরু করব আমরা।’

বাংলাদেশে ভারতের একাধিক পর্যটকবাহী জাহাজের আগমন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এগুলোর কোনোটিই কিন্তু ভারত সরকারের নয়, সেখানকার ব্যবসায়ীদের। আমাদের ব্যবসায়ীরাও যদি এগিয়ে আসতেন তাহলে এ দেশ থেকেও এতদিনে ভারতে পর্যটকবাহী জাহাজ যেত।’

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম