পাঁচ বছরে অব্যবহৃত এডিপির ৫১ হাজার কোটি টাকা
বরাদ্দ ও ব্যয়ে নেই জবাবদিহি
জবাবদিহি থাকলেও তা অদৃশ্য-পরিকল্পনামন্ত্রী * অতিরঞ্জিত বাজেট বরাদ্দের বদঅভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসতে হবে-ড. জাহিদ হোসেন
হামিদ-উজ-জামান
প্রকাশ: ১৪ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
উন্নয়ন প্রকল্পের বিপরীতে অতিবরাদ্দ নিচ্ছে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো। অর্থবছর শুরুর আগেই খেয়ালখুশিমতো একধরনের চাপ দিয়ে বরাদ্দ বাড়িয়ে নিলেও কাঙ্ক্ষিত ব্যয় করতে পারছে না। ফলে অর্থবছরের মাঝপথে কাটছাঁট করতে হচ্ছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)।
সংশোধিত এডিপিতে যা বরাদ্দ ধরা হচ্ছে, সেটিও শেষ পর্যন্ত পুরোপুরি ব্যয় হচ্ছে না। ফলে সার্বিক উন্নয়ন কার্যক্রমের বাস্তবায়ন কম হচ্ছে। এসব কারণে গত পাঁচ অর্থবছরের এডিপিতে অব্যবহৃত ৫১ হাজার ২৩৪ কোটি টাকা। বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায় এমন চিত্র। এক্ষেত্রে বরাদ্দ ও খরচের মধ্যে জবাবদিহি না থাকায় এমনটা হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, জবাবদিহি নেই, এ কথাটা পুরোপুরি সঠিক নয়। খরচ যে হয় না, সেটি দৃশ্যমান। কিন্তু বিভিন্ন পর্যায়ে যে জবাবদিহিতা হয়, সেটি অদৃশ্যমান থাকে। তবে আমি বলতে পারি, খুব ঘটা করে না হলেও জবাবদিহির একটা বিষয় আছে। যেমন আপনি আমাকে বিষয়টি জিজ্ঞাসা করলেন, এটিও একধরনের জবাবদিহির মধ্যেই পড়ে।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ঢালাওভাবে না দেখে বলা যায়, ধাপে ধাপে জবাবদিহির প্রয়োজন। সচিব মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসাবে মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীর কাছে জবাবদিহি করবেন। আবার মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী দায়বদ্ধ থাকবেন কেবিনেটের কাছে। আর সচিবের কাছে দায়বদ্ধ থাকবেন প্রকল্প পরিচালক এবং বিভিন্ন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা। এভাবে যদি জবাবদিহি প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে বেশি বরাদ্দ নিয়ে খরচ করতে না পারার ঘটনা কমে যেত। আবার অর্থবছরের শুরুতেই বাজেটকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখার একটা রাজনৈতিক প্রবণতা থাকে। এজন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ও দায়ী। অতিরঞ্জিত বাজেট বরাদ্দের বদভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
আইএমইডির প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত ২০২১-২২ অর্থবছরের মূল এডিপির আকার ছিল ২ লাখ ৩৬ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। অর্থবছরের মাঝপথে এসে সংশোধিত এডিপিতে ১৭ হাজার ১৯০ কোটি টাকা ছেঁটে ফেলে বরাদ্দ ধরা হয় ২ লাখ ৯ হাজার ৬০৩ কোটি টাকা। শেষে ব্যয় হয়েছিল আরও কম। অর্থাৎ ২ লাখ ৩ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা। সংশোধিত এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে ৯২ দশমিক ৮০ শতাংশ।
এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরের মূল বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ১৪ হাজার ৬১১ কোটি টাকা। সেখান থেকে ৫ হাজার ৩৩৯ কোটি টাকা বাদ দিয়ে সংশোধিত বরাদ্দ ধরা হয় ২ লাখ ৯ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত খরচ হয়েছিল ১ লাখ ৭১ হাজার ৮৩৬ কোটি টাকা, যা মোট সংশোধিত এডিপি বরাদ্দের ৮২ দশমিক ১১ শতাংশ।
আরও দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে মূল বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ১৫ হাজার ১১৪ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে ১৩ হাজার ৯১৫ কোটি টাকা বাদ দিয়ে সংশোধিত বরাদ্দ দেওয়া হয় ২ লাখ ১ হাজার ১৯৯ কোটি টাকা। শেষ পর্যন্ত খরচ হয় ১ লাখ ৬১ হাজার ৭৪১ কোটি টাকা, যা বরাদ্দের ৮০ দশমিক ৩৯ শতাংশ।
এছাড়া ২০১৮-১৯ অর্থবছরের মূল বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ৮০ হাজার ৮৬৯ কোটি টাকা। মাঝপথে এসে ৪ হাজার ২৪৯ কোটি টাকা বাদ দিয়ে সংশোধিত বরাদ্দ ধরা হয় ১ লাখ ৭৬ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। শেষ পর্যন্ত খরচ হয় ১ লাখ ৬৭ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা, যা সংশোধিত বরাদ্দের ৯৪ দশমিক ৬৬ কোটি টাকা।
২০১৭-১৮ অর্থবছরের এডিপিতে বরাদ্দ দেওয়া হয় ১ লাখ ৬৪ হাজার ৮৫ কোটি টাকা। মাঝপথে ছয় হাজার ৪৯১ কোটি টাকা কমিয়ে সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ দেওয়া হয় ১ লাখ ৫৭ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা। অর্থবছর শেষে খরচ হয় ১ লাখ ৪৮ হাজার ১৭৬ কোটি টাকা, যা সংশোধিত বরাদ্দের ৯৪ দশমিক ০২ শতাংশ।
২০১৬-১৭ অর্থবছরের এডিপিতে মূল বরাদ্দ দেওয়া হয় ১ লাখ ২৩ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। সংশোধিত এডিপিতে ৪ হাজার ৫০ কোটি টাকা কমিয়ে বরাদ্দ ধরা হয় ১ লাখ ১৯ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। শেষ পর্যন্ত খরচ হয়েছিল ১ লাখ ৭ হাজার ২২৯ কোটি টাকা, যা সংশোধিত বরাদ্দের ৮৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ।
জানতে চাইলে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, ওইভাবে সরাসরি জবাবদিহি হয়তো হয় না। তবে বাড়তি বরাদ্দ নেওয়ার একটা প্রবণতা প্রতিবছরই থাকে। কেননা তারা জানেই মাঝপথে কমাতে হবে। আবার কম বরাদ্দ থাকলে পরবর্তী সময়ে বরাদ্দ বাড়ানোটা ঝামেলার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়া বরাদ্দ পুরোপুরি খরচ করতে না পারার অনেক যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত কারণও আছে। হয়তো মন্ত্রণালয়গুলো মনে করে প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন কাজ বাস্তবায়ন করবে। বাস্তব অবস্থায় দেখল অনেক কম্পোনেন্ট প্রয়োজন নেই। তখন ওই টাকা ফেরত দেয়। আবার দেখা গেল পরিকল্পনা ছিল অনেক কিছুই করার; কিন্তু নানা জটিলতায় সেটি হয় না। এভাবেও অনেক টাকা বেঁচে যায়।
আইএমইডির সর্বশেষ প্রকাশিত এক অগ্রগতি পর্যালোচনা প্রতিবেদনে দেখা যায়, বেশি বরাদ্দ পাওয়া খাতগুলোই কম অর্থব্যয় করেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের এডিপিতে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয় ৭টি খাতে। এগুলোয় বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ৭৪ হাজার ৮২০ কোটি ৯৫ লাখ টাকা, যা মোট এডিপির ৮৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ। কিন্তু অর্থবছর শেষে হিসাব কষে দেখা যায়, এই সাত খাতে অব্যয়িত ছিল ২৯ হাজার ৬১০ কোটি টাকা, যা মোট এডিপি বরাদ্দের ১৪ দশমিক ১৫ শতাংশ। সর্বোচ্চ বরাদ্দ নেওয়া হলেও খাতভিত্তিক বাস্তবায়নের হার অনেক কম। যেমন পরিবহণ খাতে বাস্তবায়নের হার ছিল ৮৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ।
এছাড়া ভৌত পরিকল্পনা, পানি সরবরাহ ও গৃহায়ন খাতে ব্যয় হয় বরাদ্দের ৭৪ দশমিক ৯৯ শতাংশ। বিদ্যুৎ খাতে ৮৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ, শিক্ষা ও ধর্ম খাতে ৮২ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং পল্লি উন্নয়ন ও প্রতিষ্ঠান খাতে ৮৭ দশমিক ২৭ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। স্বাস্থ্য, পুষ্টি, জনসংখ্যা ও পরিবার কল্যাণ খাতে ৬০ দশমিক ৩৪ শতাংশ। তবে ওই অর্থবছর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে ব্যতিক্রম ছিল বিজ্ঞন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাত। এ খাতে ব্যয় হয়েছিল বরাদ্দের ১০০ দশমিক ৪৫ শতাংশ।
সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, সার্বিকভাবে মন্ত্রণালয়ের সচিবরা মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে অ্যানুয়েল পারফরম্যান্স অ্যাগ্রিমেন্ট স্বাক্ষর করে। বছর শেষে সেটির মূল্যায়ন হয়। তাহলে তার জবাবদিহিতা যখন হয়, স্বাভাবিকভাবেই তিনি নিচের দিকে জবাবদিহি করেন। তবে অনেক সময় বাস্তব কারণে শতভাগ প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। যেমন: এখন বিটুমিন এবং পাথর আমদানি করা যাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেশি। ফলে ঠিকাদাররা কাজ করতে পারছেন না। এখানে চাপ দিয়ে তো লাভ নেই। তবে আমলাদের মন্ত্রণালয়ের আরএডিপি বাস্তবায়ন হার ৯৯ শতাংশ থাকে।