বহির্বিভাগের ৮০ ভাগই ঠান্ডাজনিত রোগী
জাহিদ হাসান
প্রকাশ: ০৮ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বছরের শুরুতেই দেশব্যাপী জেঁকে বসেছে তীব্র শীত। পৌষের ঘন কুয়াশার সঙ্গে উত্তরের হাড় কাঁপানো বাতাসে ঠান্ডাজনিত রোগব্যাধির প্রকোপ বাড়ছে।
সরকারি হাসপাতালের বহির্বিভাগে রোগীদের ৮০ শতাংশই শীতজনিত রোগের কথা বলছে। রোগের ধরন ও তীব্রতা অনুসারে অনেকেই ভর্তি হচ্ছেন। যাদের বেশির ভাগই বয়স্ক ও শিশু।
শনিবার রাজধানী ঢাকা ছাড়াও জেলা-উপজেলার একাধিক চিকিৎসক-নার্স, রোগী ও অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে। চিকিৎসকরা যুগান্তরকে বলছেন, ঋতু পরিবর্তনজনিত ঠান্ডার কারণে রোগের প্রকোপ বাড়ছে। এতে কাঁশি, গলাব্যথা, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট, জ্বর ও ভাইরাল ডায়রিয়া হচ্ছে। বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন নবজাতক, শিশু ও বৃদ্ধরা। এই রোগীদের বড় একটি অংশ উত্তরাঞ্চলের মানুষ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, করোনার জন্য এক ধরনের বিপর্যয় এখনো রয়ে গেছে। এর মধ্যে তীব্র শীত জেকে বসছে। বিশেষ করে রংপুর, রাজশাহী, দিনাজপুর, ফরিদপুরসহ বেশ কিছু জেলায় রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন।
কোনো কোনো হাসপাতালে শয্যার চেয়ে দ্বিগুণ রোগী ভর্তি হচ্ছেন। তীব্র ঠান্ডার কারণে শিশু ও বয়স্কদের শারীরিক অবস্থা জটিল হচ্ছে। সব সরকারি হাসপাতালে প্রয়োজনীয় ওষুধ ও স্যালাইন সরবরাহ আছে। সবার উচিত ব্যক্তিগতভাবে সচেতনতা। স্বাস্থ্যবিধি মানা। শিশু ও বয়স্কদের প্রতি বাড়তি যত্ন নেওয়া।
শনিবার বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালের জরুরি বিভাগে রোগীদের উপচে পড়া ভিড় দেখা যায়। শিশু হাসপাতালের চিকিৎসকরা যুগান্তরকে জানান, শীত শুরুর পর প্রতিদিন বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাজারের বেশি শিশু সেবা নিচ্ছেন। যাদের অধিকাংশই শীতজনিত রোগে আক্রান্ত। হাসপাতালের বহির্বিভাগে দেড় বছর বয়সি এক শিশুর কান্না থামানোর চেষ্টা করছিলেন মা ও দাদি।
কাছে গিয়ে জানতে চাইলে দাদি সালেহা বেগম বলেন, তারা সাভার থেকে এসেছেন। গত কয়েক দিন ঘন কুয়াশা ও ঠান্ডার কারণে প্রথমে নাতির ডায়রিয়া হয়। ওষুধ ও স্যালাইন খাওয়ানোর পর ডায়রিয়া সাড়লেও কাঁশি, সর্দি ও শ্বাসকষ্ট দেখা দিয়েছে। সঙ্গে জ্বরও আছে। স্থানীয় চিকিৎসকের পরামর্শে এখানে নিয়ে এসেছেন।
হাসপাতালের চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম যুগান্তরকে বলেন, শীতের শুরু থেকেই শিশুদের ঠান্ডাজিনত রোগ নিয়ে ছুটে আসছেন। গত কয়েক দিন তীব্র ঠান্ডা পড়ায় বহির্বিভাগে ভিড় বাড়ছে। দৈনিক গড়ে হাজার খানেক রোগী আসছে। যাদের ৮০ শতাংশের মতোই সিজনাল রোগের শিকার। তবে জটিলতা কম থাকায় ভর্তি হচ্ছে কম। সর্দি-কাশি, জ্বর, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, ব্রঙ্কিওলাইটিস দেখা গেছে।
তিনি বলেন, নিউমোনিয়ায় নভেম্বর মাসে ৩০৯ জন, ডিসেম্বরে ৪৩৩ জন এবং চলতি জানুয়ারির শুক্রবার আন্তঃবিভাগে ৯ জন নিউমোনিয়া রোগী ভর্তি হয়েছে। জানুয়ারির পাঁচ দিনে ৮২ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। ঋতু পরিবর্তনের কারণে শীতকালে ৮০ ভাগ শিশু ভাইরাসজনিত রোগের শিকার হয়। ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ রোগী ঢাকা ও আশপাশের এলাকার। এর বাইরে বিভিন্ন জেলা ও বিভাগীয় শহর থেকেও অসংখ্য শিশু ভর্তি হচ্ছে। দৈনিক গড়ে ১৫ জন শিশু ভর্তি হচ্ছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. ইফফাত আরা শামসাদ যুগান্তরকে বলেন, সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, হাঁপানি, টনসিলাটাইসিস, ব্রঙ্কিওলাইটিস, সাইনোসাইটিস, সমস্যা দেখা দেয়। এবার ডেঙ্গির পরেই শিশুরা শীতজনিত রোগে ভুগছে। প্রতিদিন ঢাকা মেডিকেলের শিশু বহির্বিভাগে গড়ে ৫০০ মতো রোগী আসছে। তাদের মধ্যে অধিকাংশই ঠান্ডাজনিত রোগের কথা বলছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে চিকিৎসা দিয়ে বাড়ি পাঠানো হচ্ছে। যাদের মধ্যে নিউমোনিয়াজনিত জটিলতা বেশি তাদের ভর্তি করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, খারাপ নিউমোনিয়া থেকে শিশুদের রক্ষায় সরকারের ইপিআই কর্মসূচিতে প্রতিষেধক টিকা আছে। যেগুলো নিয়মিত নিতে হবে। নিউমোনিয়া মারাত্মক আকার ধারণ করে ছোট শিশুদের। এ ক্ষেত্রে মায়ের বুকের দুধ পান করলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো থাকে। ফলে জšে§র পরপরই শাল দুধ দিতে হবে। এভাবে ছয় মাস শুধু বুকের দুধ খাওয়ানো এবং ছয় মাস পর বুকের দুধের সঙ্গে স্বাভাবিক খাদ্য খাওয়াতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কনট্রোল রুমসংশ্লিষ্টরা শনিবার যুগান্তরকে জানিয়েছেন, ১৪ নভেম্বর থেকে ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত ঢাকা বিভাগে ১০ হাজার ৮৮৪ জন ঠান্ডা কাশিজিনত শ্বাসতন্ত্রের জটিলতা নিয়ে ভর্তি হয়েছেন। এছাড়া ২ লাখ ২৮ হাজার ১৩৮ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে এসেছে।
এ সময় ময়মনসিংহে এআরআই রোগী চিকিৎসা নিয়েছে ৩ হাজার ৩৯৩ জন এবং ডায়রিয়ার চিকিৎসা নিয়েছেন ১২ হাজার ২৮৮ জন। চট্টগ্রামে এআরআই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ১৭ হাজার ৪৫৭ জন এবং ডায়ারিয়া আক্রান্ত হয়েছেন ২৯ হাজার ১৯ জন। রাজশাহীতে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৭৪৪ জন এবং ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়েছেন ১২ হাজার ৫৩৬ জন। রংপুরে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ২৮১ জন এবং ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়েছেন ৭ হাজার ৯১৩ জন।
খুলনাতে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে আক্রান্ত হয়েছেন ৬ হাজার ৩৪৩ জন এবং ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়েছেন ১৬ হাজার ৪ জন। বরিশালে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে আক্রান্ত হয়েছেন ৩ হাজার ২০৯ জন এবং এবং ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়েছেন ১০ হাজার ৯০ জন। সিলেট বিভাগে বিভাগে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে আক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার ৭২২ জন এবং ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়েছেন ৬ হাজার ৬২৩ জন।
আট বিভাগে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে আক্রান্ত হয়েছেন ৪৭ হাজার ৩৩ জন এবং ৬৯ জরে মৃত্যু হয়েছে। ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়েছেন ৩ লাখ ২২ হাজার ৬১১ জন ও ১৩ জন মারা গেছেন।