Logo
Logo
×

শেষ পাতা

উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টর

আবাসিক প্লটে অবৈধ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান

আবাসিক পরিবেশ বিনষ্ট * রাজউকের কাছে অভিযোগ দিয়ে প্রতিকার মিলছে না * রাজউক ও উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে ট্যাক্স নির্ধারণ করতে পারছে না ডিএনসিসি

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ২৬ মে ২০২২, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আবাসিক প্লটে অবৈধ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান

রাজধানীর উত্তরার ১০নং সেক্টরের ১৩ নম্বর সড়কের একটি আবাসিক এলাকায় প্লটের জায়গায় বেআইনিভাবে গড়ে ওঠা গাড়ির গ্যারেজ। বুধবার তোলা -যুগান্তর

রাজধানীর উত্তরা আবাসিক এলাকার ১০ নম্বর সেক্টরে অবৈধভাবে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চলছে। আইনগত সুযোগ না থাকলেও এখানে শত শত মোটর গ্যারেজ, ওয়ার্কশপ, হোটেল খুলে বসেছেন অনেকে। এসব দেখেও নির্বিকার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। আইনের মারপ্যাঁচে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন অবৈধভাবে বাণিজ্য কার্যক্রম পরিচালনাকারীরা।

উচ্চ আদালত ও রাজউক থেকে নিষেধাজ্ঞা থাকায় ওইসব ভবনে বাণিজ্যিক হারে ট্যাক্স নির্ধারণ ও ট্রেড লাইসেন্সের অনুমোদন দিতে পারছে না ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হওয়ায় আইনি লড়াই শুরু করেছে ডিএনসিসি।

জানা যায়, উত্তরা আবাসিক এলাকাকে অভিজাত আবাসিক এলাকা হিসাবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখিয়েছিল রাজউক। সে কারণেই খ্যাতিমান অনেক ব্যক্তি ১০ নম্বর সেক্টরে প্লট বরাদ্দ নিয়েছিলেন। সেসব প্লটে তারা যথাযথ নিয়ম মেনে ভবন নির্মাণ করে বসবাসও করছেন। তবে প্লট বরাদ্দ পাওয়ার দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও এখনো ভবন নির্মাণ করেননি অনেক প্লট গ্রহীতা।

ওইসব প্লটে কেউ গ্যারেজ করে ভাড়া দিয়েছেন। আবার কেউ বস্তিঘর তুলেও ভাড়া বাণিজ্য করছেন। এসব অবৈধ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কারণে সেখানে নির্বিঘ্নে বসবাস করতে পারছে না ভবন নির্মাণ করে বসবাসকারী ব্যক্তিরা। রাজউকের কাছে এসব বিষয় জানিয়েও কোনো প্রতিকার পাচ্ছে না তারা।

রাজউকের তথ্যমতে, উত্তরা আবাসিক প্রকল্পের প্লটগুলো ১৯৯৭ সালে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। লিজ দলিলের শর্ত অনুযায়ী পরবর্তী ৪ বছরের মধ্যে ইমারত নির্মাণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এছাড়া ওই প্লটে আবাসিক ছাড়া অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না। যদি কোনো গ্রহীতা রাজউকের লিজ দলিলের শর্ত ভঙ্গ করে তাহলে রাজউক তার প্লট বাতিল করতে পারবে। এ ক্ষমতা থাকার পরও কর্তৃপক্ষ নির্বিকার।

জানতে চাইলে স্থপতি ও নগর বিশেষজ্ঞ ইকবাল হাবিব বলেন, বরাদ্দপত্রের শর্তে যা থাকুক না কেন, রাজউকের বিদ্যমান আইন, বিধিবিধান এবং লিজ দলিল পর্যালোচনা করে আবাসিক প্লটের বরাদ্দ বাতিল করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে রাজউকের বোর্ড সভা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে।

তিনি বলেন, দুই দশকেরও বেশি সময় আগে যারা প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন, তারা এখনো ভবন নির্মাণ না করে ফেলে রেখেছেন। তাদের আসলে ওই প্লটের কোনো প্রয়োজন নেই। আমার মতে, ওই প্লটের বরাদ্দ বাতিল করে সেখানে ফ্ল্যাট নির্মাণ করে বরাদ্দ দেওয়া যেতে পারে। স্বল্প আয়ের মানুষের আবাসনের ব্যবস্থা করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে সরকার।

এ প্রসঙ্গে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. শহীদ উল্লা খন্দকার বলেন, রাজউকের আবাসন প্রকল্পে যারা আবাসিক প্লট পেয়েছেন, তাদের সেখানে আবাসিক কার্যক্রম করতে হবে। কেউ এর ব্যত্যয় ঘটালে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বিদ্যমান আইন অনুযায়ী এটা করা সম্ভব। প্রয়োজনে আবাসিক পরিবেশ বিনষ্টকারীদের প্লট বাতিল করা হবে।

তিনি বলেন, উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টরের আবাসিক প্লট গ্রহীতারা বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করলে তাদের বিরুদ্ধে রাজউক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। শর্তভঙ্গের বিষয়গুলো বিবেচনা করে প্রয়োজনে বরাদ্দ বাতিলও করতে পারে। এ ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে রাজউককে নির্দেশনা দেওয়া হবে।

এ প্রসঙ্গে রাজউক চেয়ারম্যান এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, গ্রাহকদের বসবাসের জন্য প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সেখানে গ্যারেজ, ওয়ার্কশপ, বস্তিঘর বা অন্যান্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা অবৈধ।

তিনি বলেন, যারা আবাসিক প্লট বা ভবনে অবৈধ বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে তাদের বিরুদ্ধে রাজউক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। প্রায়ই উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয়। এসব অভিযানে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকে। শিগগিরই উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টর এলাকার অবৈধ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অপসারণে অভিযান পরিচালনা করা হবে।

ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা বলেন, উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টরসহ ডিএনসিসির আওতাভুক্ত অন্যান্য আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমরা ট্যাক্স নির্ধারণ করতে চাই। এছাড়া আবাসিক প্লটে বা ভবনে যারা ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করছেন তাদের ট্রেড লাইসেন্সও দিতে চাই। কিন্তু রাজউক ও উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে আমরা এ কাজগুলো করতে পারছি না। এতে ডিএনসিসি বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আর রাজউক আবাসিক এলাকার বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ না করায় অবৈধ বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনাকারীরা লাভবান হচ্ছেন। এতে ডিএনসিসি রাজস্ব হারাচ্ছে এবং আবাসিকের বাসিন্দারা অস্বস্তিতে রয়েছেন।

সরেজমিন দেখা যায়, উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টরসহ আশপাশের সেক্টরে মোটর গ্যারেজ, সিএনজি মেরামত কারখানা, অটোরিকশার কারখানা, খাবার হোটেল, টায়ার টিউবের দোকান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ক্লিনিক, অফিস, বায়িং হাউজ, কাঁচা বাজার, মুদি মনোহারির দোকান এবং ভ্যারাইটিজ স্টোর গড়ে উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, রাজউকের কতিপয় অসাধু লোক সুবিধা নিচ্ছে আর সমস্যা সমাধানে টালবাহানা করছে। এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দেওয়া হলেও রাজউকের দায়িত্বপ্রাপ্তরা ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন না।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ১০ নম্বর সেক্টরের ১ নম্বর রোডের ২ এবং ৪ নম্বর বাড়িতে দোকানপাট এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। ২ নম্বর রোডের শুরুর প্লটে ডজনখানেক দোকান তৈরির কাজ চলছে। ওই দোকানগুলো ভাড়া দেওয়া হবে বলে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ রোডের ৩৯ নম্বর প্লট কবরস্থানের অংশ হলেও তা অবৈধভাবে দখল করে সেমিপাকা স্থাপনা তৈরির কাজ চলছে। ৪৬ নম্বর প্লটের পুরোটায় একাধিক দোকানপাট রয়েছে। ৩, ৪ ও ৫ নম্বর সড়কের একাধিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।

১৩ নম্বর সড়কে শতাধিক প্লট এবং বাড়ি পুরোপুরি গ্যারেজ, হোটেল, টায়ারের দোকান, কার ওয়াশ, কাঁচাবাজার, সিএনজি মেরামত কারখানা, অটোরিকশা ও গাড়ি স্টেশন হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ সড়কের ৩৯, ৪৭ এবং ৫১ প্লটে অসংখ্য দোকানপাট রয়েছে। ৬৭ নম্বর প্লটে বড় মাপের গাড়ি মেরামত কারখানা, ৮৭ নম্বর প্লটে কাঠ বাঁশের ব্যবসার পাইকারি গোডাউন, ৯১ নম্বর প্লটে অনেকগুলো দোকান, ৯৯ নম্বর প্লটে টায়ারের দোকান, ১২৭ নম্বর প্লটে কারওয়াশিং এবং গাড়ি মেরামত কারখানা, ১৩৫ নম্বর প্লটে বড় মাপের গাড়ির গ্যারেজ, ১৪১ নম্বর প্লটে হোন্ডার গ্যারেজ এবং খাবার হোটেল।

এছাড়া ১২ নম্বর রোডের বেশিরভাগ বাড়ির নিচতলায় দোকান পাট রয়েছে। ৭৯, ৮১ এবং ৮৩ নম্বর প্লটে পাইকারি কাঁচামালের আড়ত। ১৬ নম্বর রোডের শুরুর একাধিক প্লটে হোটেল, ফার্নিচারের দোকান, ফলমূলের দোকান। ১৭ নম্বর রোডে কাঠবাঁশের দোকান, ১৮ নম্বর রোডে ঢুকতেই সিএনজির বড় মেরামত কারখানা, ১ নম্বর প্লটে চা-পানের দোকান এবং খাবার হোটেল। এখানে বখাটেদের আড্ডা এবং তাদের গাঁজা সেবন নিত্যকার ঘটনা। ৩ নম্বর প্লটে গাড়ি মেরামত কারখানা। এখানে মেরামতের জন্য আনা গাড়িগুলো সারি সারি রাস্তার ওপর দিনের পর দিন রেখে দিয়ে বাসিন্দাদের চলাচলে বিঘ্ন ঘটানো হয়।

গাড়ি মেরামতের বিকট শব্দে বাসিন্দাদের শান্তি বিনষ্ট করছে প্রতিনিয়ত। ৯ নম্বর প্লটে একাধিক বস্তিঘর আবাসিক পরিবেশ বিনষ্ট করছে। ১৯ নম্বর রোডের ২ নম্বর প্লটে সিএনজি মেরামত কারখানা, ১৩ এবং ১৫ নম্বর প্লটে ডজনখানেক বস্তিঘর। ২০ ও ২১ নম্বর রোডে অর্ধশতাধিক বেদে বস্তি। ২২, ২৩ ও ২৪ নম্বর সড়কে রয়েছে একাধিক বাণিজ্যিক স্থাপনা।

১০ নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা কবির উদ্দিন বলেন, এ সেক্টরের প্রতিটি সড়কে একাধিক প্লটে বাণিজ্যিক স্থাপনা বানিয়ে গ্যারেজ এবং দোকানপাট ভাড়া দিয়েছে। এসব গ্যারেজে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত উচ্চ শব্দে কাজ হয়। এ কারণে বাসায় থাকা দুষ্কর। বাচ্চাদের পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটছে। অসুস্থ এবং বয়স্কদের স্বাভাবিক জীবন বিষিয়ে উঠেছে। আবাসিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে এ সমস্যার দ্রুত সমাধান চাই।

এই সেক্টরের আরেক বাসিন্দা নাজমা বেগম বলেন, এখানে বখাটে ছেলেদের আড্ডায় মেয়ে বা মহিলাদের একাকী বাইরে যাওয়া দুরূহ হয়ে উঠেছে। সন্ধ্যার পর তো ভয়ে বাইরেই যাই না।

তিনি বলেন, এই সেক্টরে গাড়ির গ্যারেজ, হোটেল, রকমারি দোকান রয়েছে। এছাড়া পাশে ভার্সিটি থাকায় আবাসিক বাড়িতে ব্যাচেলর ভাড়া দেওয়ার হিড়িক পড়েছে। এসব কারণে এখানে বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

১০ নম্বর সেক্টর ওয়েলফেয়ার সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক ইনসাফ আলী ওসমানী বলেন, এখানে অবৈধভাবে শত শত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। বাণিজ্যিক স্থাপনা, দোকানপাট, গ্যারেজ, খাবার হোটেল উচ্ছেদ করে আবাসিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে রাজউককে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কয়েক মাস পেরিয়ে গেলেও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি রাজউক।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম