Logo
Logo
×

যুগান্তরের বিশেষ আয়োজন

সাধারণদের আমি আর কোথাও দেখি না

Icon

কুদরত-ই-হুদা

প্রকাশ: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সাধারণদের আমি আর কোথাও দেখি না

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে মওলানা ভাসানী অংশগ্রহণ করেননি। তার এ সিদ্ধান্ত নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা আছে। ইতিহাসে তা হবেই; হতেই পারে। কিন্তু ওইসব বহুবিচিত্র মত-পথ সরিয়ে রেখে, এখন এ লেখার প্রয়োজনে, খোঁজ করা যেতে পারে সে কথাটির, যে কথাটি বলে ভাসানী সত্তরের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেন না। ভাসানীর সোজাসাপটা কথাটি ছিল, ‘ভোটের আগে ভাত চাই’। তিনি বরাবর বলে এসেছেন, এসব নির্বাচন-টির্বাচন দিয়ে কোনো লাভ নাই। এর ভেতর দিয়ে এক বুর্জোয়া শ্রেণি সরে গিয়ে আরেক বুর্জোয়া শ্রেণি গদিতে বসে। শাসকের খাসলতে, শ্রেণিচরিত্রে ও রাষ্ট্রের মৌল চরিত্রে কোনো বদল ঘটে না। ফলে সাধারণ মানুষ যে না-খাওয়া না-খান্দা সেই ভুকা-নাঙা না-খান্দাই রয়ে যায়। ভাসানীর ধারণা ছিল, ১৯৭০-এর নির্বাচনের মাধ্যমে এর বাইরে কিছু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাই এ নামকাওয়াস্তে নির্বাচনে অংশগ্রহণের কিছুই নেই।

এ নির্বাচনই শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতাযুদ্ধকে অনিবার্য করে তুলেছিল। পাকিস্তানি শাসকদের বিদ্বেষী ও আধিপত্যবাদী মনোভঙ্গি উদোম করে দিয়েছিল। এ নির্বাচন স্পষ্ট করে দিয়েছিল যে, পাকিস্তানের পাঞ্জাবি আর সিন্ধি অভিজাতদের শাসন করার অধিকার কমজাত বাঙালি রাখে না। এ সুযোগ তাদের দেওয়া চলে না। এদিক থেকে এ নির্বাচন ছিল অবিভক্ত পাকিস্তানের টিকে থাকা না-থাকার প্রশ্নে একটা লিটমাস টেস্টের মতো।

কিন্তু একথাও সত্য যে, এ নির্বাচনের প্রত্যক্ষ পরম্পরায় পাকিস্তান-রাষ্ট্র ভেঙে যে নতুন বাংলাদেশ রাষ্ট্র তৈরি হলো সেই নতুন রাষ্ট্রের খাসলতের খুব একটা পরিবর্তন হলো না। নতুন রাষ্ট্রের পরিচালনায় থাকা স্থায়ী-অস্থায়ী শাসকশ্রেণির শ্রেণিচরিত্র আগের মতোই রইল। স্বজাতি আর বিজাতির মামলা। স্বাধীনতাপ্রাপ্তির অভাবিত আনন্দ-অভিভূতি ও স্বপ্নাবিষ্টতা, দেশ স্বাধীন হওয়াজনিত স্বাভাবিক কিছু সুযোগ-সুবিধা তৈরি হওয়া ছাড়া সাধারণ মানুষের ভাগ্যের বড় কোনো বদল হলো না। স্বাধীনতার পর শুধু বলছি কেন, ১৯৭১ থেকে আজ তক সাধারণ মানুষের ভাগ্যের বড় কোনো বদল ঘটেছে কি! শাসকশ্রেণির কোনো শ্রেণিবদল ঘটেছে! রাষ্ট্রের চরিত্রের মৌলিক কোনো রূপান্তর কখনো কি ঘটেছে! রাষ্ট্রটা বরাবরই ওই বুর্জোয়া শ্রেণির ‘বড়লোক’দের করায়ত্বে থেকেছে। ফলে ভাসানী দার্শনিকভাবে খুব ভুল কিছু বলেছিলেন বলে মনে হয় না।

গভীরভাবে লক্ষ করলে দেখবেন, এ রাষ্ট্রটা আসলে বরাবরই বড়লোকদের দ্বারা এবং বড়লোকদের জন্য চালিত হয়েছে। এক কথায় এটি বড়লোকদের দখলে চলে গিয়েছে। রাষ্ট্র ব্যাপারটা হয়তো তাই-ই। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, সাধারণ মানুষের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক এখানে মূলত কাগুজে আর সুভাষণমূলক। বাস্তবে সম্পর্কটা ভয়মূলক এবং অলঙ্ঘ্য দূরত্বমূলক। রাষ্ট্রে যারা বিভিন্ন দায়িত্বে থাকেন তাদের সাধারণ মানুষ বাঘের চেয়ে ভয়ংকর আর ঈশ্বরের চেয়ে শক্তিধর মনে করে। ফলে দেশের সাধারণ মানুষ এ রাষ্ট্রকে নিজের ভাবতে পারে না। রাষ্ট্র পরিচালনায় নিযুক্ত স্থায়ী (সরকারি আমলা) ও অস্থায়ী (রাজনৈতিক আমলা) সরকারি বেতনভোগী কারও সঙ্গেই তারা একাত্মবোধ করে না। তারা মনে করে, বেতনভোগী এসব মানুষ রাগী, খেয়ালি এবং হিংস্র। কাছে গেলে যে কোনো সময় কামড়ে দিতে পারে। কোনো ভুলচুক হয়ে গেলে কী মুসিবতে পড়ি তার ঠিক ঠিকানা নেই। কাছে না যাওয়াই ভালো। এরচেয়ে ঢের নিরাপদ সব পৌরুষ, যৌবন-জরদ আর দরদ দিয়ে সন্তান ও ফসল উৎপাদন করা; ভ্যান-রিকশার প্যাডেল মারা, গুণটানা, দাঁড়টানা, ‘বড়দের’ জন্য রাস্তাঘাট-ইমারত, টানেল, এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের বিনিময়ে পাওয়া খাদ্যে নিজের জৈব অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা। আর মোটামুটি অর্থনৈতিক সচ্ছলতা থাকলে পরিবার-পরিজন নিয়ে গৃহকোণে নিজের মতো করে একটা নিরীহ বাঙালিসুলভ নিরুপদ্রব জীবনযাপন করাই শ্রেয়।

কখনো কখনো এ সাধারণ শ্রেণির সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনায় নিযুক্তদের ক্ষীণ হলেও একটা সম্পর্ক ছিল। এর নাম দেওয়া যায় ভোটমূলক সম্পর্ক। কিন্তু এটি কখনো স্থায়ী হয়নি। শুরু থেকেই নানা ফন্দি-ফিকিরের মাধ্যমে সে সম্পর্ক ক্ষীণ করতে করতে বর্তমানে সেটা প্রায় নাই করে ফেলা হয়েছে। সাধারণের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে কার আর ভালো লাগে! হোক সেটা দিন কয়েকের তুচ্ছতা; তবু তা তো মেনে নেওয়া যায় না! ‘অসাধারণ’ আর ‘বড়’র মর্যাদা তাতে ক্ষুণ্ন হয় বৈ কি!

শুধু ভোটের অধিকার থেকে সাধারণ মানুষের উচ্ছেদের কথাই-বা বলি কেন! কোথায় তারা আছে! এ রাষ্ট্রের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিচিত্রভাবে সাধারণরা উৎখাত হয়েছে। ভাষা থেকে, শিক্ষা থেকে, চিকিৎসা থেকে; কোত্থেকে নয়! ভাষার এক মতের ইতিহাস বলে যে, বাংলাভাষা প্রাকৃতজনের অর্থাৎ নিম্ন শ্রেণির মানুষের মুখ থেকে জন্ম নিয়েছে। ভাষাটি আজও গরিবের ভাষাই রয়ে গেছে। রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরও ওই ব্রাত্যজনের ভাষাকে রাষ্ট্র বিশেষ কোনো মর্যাদার আসনে বসাতে পারেনি। এর প্রমাণ-টাকা আছে এমন কেউ তাদের সন্তানকে আজকাল আর বাংলা মাধ্যমে পড়ায় না। গরিবরাই তাদের সন্তানদের মর্যাদাহীন বাংলা মাধ্যমে পড়ায়। ভাষাটা আছে কিন্তু মর্যাদার আসনটি উৎখাত হয়েছে। এটা প্রাপ্য মর্যাদা থেকে গরিবের উৎখাত ছাড়া আর কী!

বাংলাদেশে গরিবের জন্য চিকিৎসা নেই-এ কথা বুঝিয়ে না বললেও হয়। বড়লোকদের জন্য কিছু চিকিৎসাকেন্দ্রের নমুনা যথারীতি রাখা হয়েছে। রাখা হয়েছে তাদের বিদেশে চিকিৎসার যাবতীয় এন্তেজাম। আর সাধারণদের জন্য আমাশয়-জ্বর-সর্দি-পাতলা পায়খানার ব্যবস্থাপত্র দেওয়ার জন্য সুবন্দোবস্ত রাখা হয়েছে। এ কাজটি দীর্ঘকাল ধরেই করা হয়েছে; স্বাধীন বাংলাদেশেই হয়েছে এবং হচ্ছে। সুচিকিৎসার বন্দোবস্ত থেকে উৎখাত হওয়া সাধারণ মানুষ যে হাজারে হাজার কাঠামোগত হত্যার শিকার হচ্ছে-একথা তো মিথ্যা নয়!

এ তো গেল প্রত্যক্ষ উৎখাতের ব্যাপার। মর্মগত উচ্ছেদের ব্যাপারও আছে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ উৎখাত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ ও এর ইতিহাস থেকেও। এ ইতিহাস ক্রমাগত ‘অসাধারণ বড়’দের দখলে চলে গেছে। মুক্তিযুদ্ধ তো একটি জনযুদ্ধ ছিল। কিন্তু এ জনযুদ্ধ কতিপয়ের যুদ্ধ ও ইতিহাসে পরিণত হয়েছে। আমরা যখন গ্রামে ছিলাম, তখন মুক্তিযুদ্ধের যে গল্প বাবা-মা বা গ্রামের ময়মুরব্বিদের কাছে শুনেছি, সে গল্প সাধারণ মানুষের দৌড়াদৌড়ি, আতঙ্ক, অসহায়তা, প্রতিরোধে রোমাঞ্চকর। সেসব গল্পে নায়ক আমাদের পাড়ার ছানু খাঁর ভাই জাহাঙ্গীর। পাকিস্তানি প্রশিক্ষিত বাহিনীর সঙ্গে রোমহর্ষক সম্মুখযুদ্ধে তিনি শহিদ হন। তাকে ভালোবেসে গ্রামের মানুষ তার নামে গড়ে তুলেছে শহিদ জাহাঙ্গীর ক্লাব। আর ওইসব গল্পে আবশ্যিকভাবে দেখতে পেয়েছি পিঁপড়ার মতো সারিসারি উৎকণ্ঠিত ভয়াতুর মানুষ। এসব দৃশ্যের বিপরীতে থাকত অস্ত্র কাঁধে গভীর জঙ্গলে ঘাপটি মেরে থাকা গেরিলাদের জোনাকোজ্জ্বলা চোখ। থাকত শত্রু ছাউনিতে হানা দেওয়ার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় করে তাদের এ-গ্রাম থেকে ও-গ্রামে ছুটে চলার কথা। তাদের সফলতা আর আত্মত্যাগের কথা। এমনকি ১৬ ডিসেম্বর বা ২৬ মার্চ এলে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র হাতে যত ভিডিও ও ছবি দেখি সেখানেও তো কোনো অসাধারণের দেখা পাই না। সব হাড্ডিসার কোটরাগত চোখের কালো কুচকুচে মানুষদেরই তো দেখি। যত বই পড়া শুরু করলাম এবং বর্তমানের নিকটবর্তী হতে থাকলাম তত জানতে থাকলাম যে, ওসব কিছু না। বড়রাই আসল; অসাধারণরাই আসল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এও জেনে উঠলাম; ১৯৫২ থেকে আজ পর্যন্ত বুদ্ধিজীবী হত্যা ও কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া, কোথাও কোনো অসাধারণ মানুষ মারা যাচ্ছে না; সব সাধারণ না-খান্দার দল মারা পড়ছে। এ সাধারণদের আত্মত্যাগকে বারবার একটা গড়পড়তা সংখ্যার মধ্যে ফেলে অসাধারণ করে তোলা হয়েছে। অসাধারণ করে তোলা হয়েছে বড়দের অবস্থা ও অবস্থানকে পোক্ত করার প্রয়োজনে। সাহিত্য ও সাধারণের স্মৃতিতে ছাড়া শহিদদের তো আমি আর কোথাও দেখি না; দেশের ক্রিয়াকর্ম-দর্শন কোথাও না!বিজয়ের এতটা বছর কেটে গেল! এখনো একটি প্রশ্ন তুলতেই হয়। না তুললে বিজয় দিবস সম্পর্কিত যে কোনো আলোচনা নিরর্থক ও বানোয়াট মনে হয়। প্রশ্নটি খুবই পুরোনো। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও ক্লাসিক। প্রশ্নটি হচ্ছে, বিজয়টা আসলে কার হলো! চোখ বন্ধ করে থাকলেও তো বুঝি-এ বিজয় ওই অসাধারণদের। কতিপয় মানুষের। কিন্তু আমরা এ পরিস্থিতি চাই না। এজন্য হয়তো ব্যাপক পরিবর্তন প্রয়োজন। কিন্তু কে করবে সেই পরিবর্তন! সেই ‘অসাধারণ বড় কেউ’ বা ‘কেউ কেউ’! তবু বিজয় দিবসে এটা একান্তভাবেই চাই, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সর্বত্র সাধারণের গুরুত্ব বাড়ুক। দেশটাকে সাধারণ মানুষ তাদের নিজেদের সত্তার অংশ মনে করুক; ভয় না পাক; আস্থায় থাক।

লেখক : শিক্ষক ও গবেষক, উপ-পরিচালক : ডিসেমিনেশন অফ নিউ কারিকুলাম স্কিম, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর বাংলাদেশ

ঘটনাপ্রবাহ: মহান বিজয় দিবস


আরও পড়ুন

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম