Logo
Logo
×

২ যুগে যুগান্তর

ভাষা আন্দোলনের সূচনা

Icon

মুহাম্মদ আশরাফুল করিম

প্রকাশ: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের জন্ম কোনো একক বা কতকগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনার সমষ্টি নয়; বরং এটি ঐতিহাসিক পরম্পরায় সংঘটিত ধারাবাহিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা বাঙালি চেতনার সফল পরিণতি। কালের ধারায় গড়ে ওঠা এ জাতিচেতনা সুসংগঠিত ও সুসংহত হয়েছে উনিশশ বায়ান্ন খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। ভাষা আন্দোলনকে অনেকেই দেখেছেন শুধু ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াই হিসাবে। বাংলাভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস হাজার বছরের হওয়া সত্ত্বেও বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পূর্বে বাংলাভাষা কখনোই রাজভাষার মর্যাদা লাভ করেনি। একদিকে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা বাংলাকে অস্পৃশ্য হিসাবে ঘৃণা করেছেন, আবার পশ্চিম-পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলাকে হিন্দুয়ানি ভাষা হিসাবে অভিহিত করে উর্দুকে মুসলমানের জবান হিসাবে প্রতিষ্ঠার সর্বাত্মক অপচেষ্টা। আর্য শাসনামলে এ অঞ্চলের রাজভাষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যম ছিল বৈদিক ভাষা। বৌদ্ধ শাসনামলে তথা পাল যুগে রাজভাষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চার মাধ্যম ছিল পালি। যদিও এ কালপর্বেই বাংলাভাষা ও লিপির উন্মেষ ঘটে। ব্রাহ্মণ্য যুগ তথা সেন আমলে সংস্কৃত ছিল রাজভাষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চার মাধ্যম। সুলতানি ও মুঘল আমলে বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করা হলেও ফারসি ছিল রাজভাষা। বাংলা এ যুগেও অবহেলিত। তবে বাঙালি কবিদের রচনায় বাংলাভাষা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা দেখা যায়। ইংরেজ শাসনামলে ইংরেজি হয়ে ওঠে রাজভাষা এবং শিক্ষার মাধ্যম। বাংলা-ফারসি-উর্দু এ ত্রিধারা বিতর্কের মধ্য দিয়ে বাঙালি মুসলমানের আত্ম অন্বেষণের যে পালা শুরু; সেখান থেকে ভাষা আন্দোলনের ঘটনা প্রবাহের মিথস্ক্রিয়ায় জাতীয়তাবাদের উপাদানগুলো বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনায় প্রাণসঞ্চার করেছে। ভাষা আন্দোলন নিয়ে রচিত প্রকাশনাগুলোর অধিকাংশই প্রাধান্য পেয়েছে ঘটনার বর্ণনা। ভাষা আন্দোলনের অন্তর্নিহিত মূল চালিকাশক্তি অথবা এ আন্দোলনের প্রাপ্তি নিয়ে সেভাবে কোনো কাজ হয়নি। তবে ঘটনার বর্ণনাতেও ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গির ব্যত্যয় ঘটেছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত প্রসঙ্গে সঠিক মূল্যায়ন অনুপস্থিত। এ নিবন্ধে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত বিষয়েই আলোকপাত করা হয়েছে।

ভাষা আন্দোলনের ব্যাপ্তিকাল সাতচল্লিশের দেশভাগের অব্যবহিত পর হতে ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে সংবিধানের স্বীকৃতি লাভ পর্যন্ত চিহ্নিত করা হলেও এর মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তিটি বহু আগে থেকেই গড়ে উঠতে শুরু করে। বিশ শতকের প্রারম্ভে বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ধারায় বাংলাভাষার প্রতি বাঙালি মুসলমানের গভীর মমত্ববোধ গড়ে উঠলেও বাংলা বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা কি না? এমন একটি অদ্ভুত প্রশ্নের অবতারণা করা হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে সৈয়দ এমদাদ আলী (১৮৭৫-১৯৫৬) সম্পাদিত ‘নবনূর’ পত্রিকার একটি নিবন্ধে বলা হয়, ‘বঙ্গভাষা ব্যতীত বঙ্গীয় মুসলমানের মাতৃভাষা আর কি হইতে পারে? যাঁহারা জোর করিয়া উর্দুকে বঙ্গীয় মুসলমানের মাতৃভাষার আসন প্রদান করিতে চান, তাঁহারা কেবল অসাধ্য সাধনের জন্য প্রয়াস করেন মাত্র।’ ১. ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী রংপুর প্রাদেশিক শিক্ষা সম্মেলনে বাংলাভাষাকে জাতীয় ভাষার মর্যাদা দেওয়ার কথা বলেন। ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ (১৮৬৮-১৯৬৮), মোহাম্মদ এয়াকুব আলী চৌধুরী, ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে মুজফ্ফর আহমদ, ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ, ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্, লুৎফর রহমান প্রমুখ বাংলাকে অবজ্ঞা করে উর্দুর প্রতি এক শ্রেণির বাঙালি মুসলমানের প্রীতির বিরোধিতা করেন। ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন আসাম ব্যবস্থা পরিষদে শ্রীহট্ট সদর মহকুমা-সদর দক্ষিণ থেকে নির্বাচিত সদস্য আব্দুল হামিদ চৌধুরী মাইজ ভাগের ছিন্ন কেুরআন ঘটনার নায়ক দারোগা বরখাস্তের একটি প্রস্তাব বাংলায় উপস্থাপন করলে তা বিধিসম্মত নয় বলে নাকচ করা হয়। গোপেন্দ্র লাল রায়, রাজেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী প্রমুখ এমএলএ-এর বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেন। এ প্রতিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে স্পিকার বাংলায় প্রস্তাব উপস্থাপনের অনুমতি দেন। ২. বাংলাভাষার মর্যাদার প্রশ্নে সরকারি কোনো ফোরামে এটিই প্রথম প্রতিবাদ। এভাবে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তিটি গড়ে উঠলেও ভাষা আন্দোলনের প্রস্তুতি পর্ব হিসাবে ডক্টর জিয়াউদ্দিন আহমেদ ও চৌধুরী খালেকুজ্জামান কর্তৃক উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়ায় বাঙালি লেখক বুদ্ধিজীবীদের প্রতিবাদ পর্বকে চিহ্নিত করা যায়।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন পরিপ্রেক্ষিত গড়ে ওঠে সাতচল্লিশ খ্রিষ্টাব্দে উপমহাদেশের তদানীন্তন রাজনৈতিক পটভূমিতে নানা প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্য দিয়ে। বিভিন্ন গবেষক ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে জিন্নাহ্র বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে গড়ে ওঠা প্রতিবাদ থেকে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত দেখিয়েছেন। কার্যত আন্দোলনের সূচনা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পর বাংলাভাষার দাবিকে ঘিরে সংগঠিত সচিবালয়ে কর্মচারীদের বিক্ষোভ, জমায়েত ও মিছিলে। তবে কোনো নির্দিষ্ট ঘটনার সূত্রে নয়, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর জাতীয় চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতেই রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি উত্থাপিত হয়।

৩. কার্যত সরকারি কর্মচারীদের মাঝেই রাষ্ট্রভাষা বিষয়ে প্রথম সচেতনতা সৃষ্টি হয়। এর কারণ ছিল পাকিস্তান অর্জনের প্রবল উচ্ছ্বাসের মাঝে তৎকালীন প্রতিক্রিয়াশীল শাসকচক্র একটি ভয়ংকর প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ৪৭-এর অক্টোবরে নতুন রাষ্ট্রের পক্ষে যেসব পোস্টকার্ড, এনভেলাপ, মানিঅর্ডার ফর্ম, রেল টিকিট, টাকা ইত্যাদি ছাপানো হয়েছিল, তা কোনোরূপ আলোচনা ছাড়াই শুধু উর্দু ও ইংরেজিতে ছাপা হয়। বাঙালি আশা করেছিল সরকারি কাজে তাদের মাতৃভাষা ব্যবহার করা হবে। প্রশাসনের এ পদক্ষেপে সচিবালয়ের বাঙালি কর্মচারীরা জীবিকার শঙ্কায় পতিত হয়। কেননা সরকারি কাজে বাংলা বাদ দিয়ে শুধু উর্দু ও ইংরেজি ব্যবহৃত হলে উর্দু না জানা এসব বাঙালি কর্মচারীরা কাজের সুযোগ হারাবেন। ভাষা বিষয়ে রাষ্ট্র তখনো সাংবিধানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি। তাই পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি কর্মচারীরা পশ্চিমাদের বাঙালিকে শোষণের এ দুরভিসন্ধি উপলব্ধি করে নিজেদের জীবিকার হুমকি বিবেচনায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সোচ্চার হোন। ভাষা বিতর্কের উল্লিখিত টানোপোড়েন সচিবালয়ে বিস্ফোরক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। তাই পাকিস্তানি শাসকদের এ অর্বাচীন পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাভাষার তত্ত্বগত দাবির বাস্তব রূপায়ণে তারা আন্দোলনে নামেন। শুধু সচিবালয়ের কর্মচারীরাই নন, বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল-কলেজের ছাত্র-শিক্ষক, পলাশী ও নীলক্ষেত ব্যারাকে বসবাসরত অধিবাসীদের একটি বিশাল অংশ নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ করেন। ৪. ভাষাসৈনিক জনাব আবদুল মতিনের ভাষ্যতেও এর সত্যতা পাওয়া যায়। তিনি বলেন, ‘১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসের শেষ দিকে আমি নীলক্ষেত ব্যারাকের মধ্য দিয়ে আসার সময় সেখানকার কর্মচারীদের এক পথসভায় শামিল হই। তাদের এক বক্তার কথা শুনে মনে হয় নতুন ছাপা পোস্টকার্ড-এনভেলাপা দিতে বাংলা না থাকায় তারা ক্ষুব্ধ। তাদের কথা হলো, শুধু পোস্টকার্ড ইত্যাদিতে বাংলা থাকলেই চলবে না। বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষাও করতে হয়েছে। তাদের দাবি ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।’ সে সময় আমিও এ দাবির কথা উপলব্ধি করেছিলাম ও বলেছিলাম।...ছাত্ররা বাংলা রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন শুরু করে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ থেকে। ৫. যদিও সরকারি কর্মচারীদের এ আন্দোলন ছিল অসংগঠিত এবং অনেকাংশে বিচ্ছিন্ন কিন্তু বাংলাভাষার দাবিতে এটিই ছিল প্রথম প্রত্যক্ষ সংগ্রাম। অধ্যাপক এম এ কাসেম এপ্রিল ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত ‘ছাত্র-আন্দোলন’ নামক পুস্তিকার ২ নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-‘ভাষা আন্দোলনের সমর্থক ইংরেজি শিক্ষিত মহলের অধিকাংশ হইলেও ইহাও ছিল প্রধানত ছাত্র আন্দোলন। সকলেই জানেন ঢাকা শহরেই এ আন্দোলন স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সীমাবদ্ধ ছিল। রেলে, ব্যবসায়ী মহলে- এবং সেক্রেটারিয়েটে ধর্ম্মঘট করার চেষ্টা হইয়াছে বটে কিন্তু সফল হয় নাই।’ তিনি ছাত্রদের আন্দোলনকে প্রধান হিসাবে দেখলেও সচিবালয়ের ধর্মঘটের কথা অস্বীকার করেননি। এরই ধারাবাহিকতায় ১২ নভেম্বর ফজলুল হক হলে বাংলার সপক্ষে একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভা উদ্বোধন করেন নুরুল আমিন এবং সভাপতিত্ব করেন কৃষিমন্ত্রী হাবীবুল্লাহ বাহার। সভায় বাংলার পক্ষে বক্তব্য প্রদান করেন কাজী মোতাহার হোসেন, কবি জসীমউদ্দীন, আবুল কাশেম প্রমুখ। ৬. পশ্চিমা শাসকচক্রের বাংলা বিরোধিতার সুদূরপ্রসারী চক্রান্ত আরও স্পষ্ট হয় ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার বিষয়ের সিলেবাস সম্পর্কে যে সার্কুলার প্রকাশ করা হয় সেখানে ৩১টি বিষয়ের মধ্যে ৯টি ছিল ভাষাবিষয়ক। এ ভাষাগুলোয় হিন্দি, সংস্কৃত-এর মতো ভাষা স্থান পেলেও স্থান হয়নি তথাকথিত মুসলমানদের হিন্দুয়ানি তকমা দেয়া বাংলাভাষার। ৭. এর প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন সহসভাপতি এবং ঢাকা সরকারি কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক ফরিদ আহমদ ৮ জানুয়ারি ১৯৪৮ চাকরি থেকে ইস্তাফা দেন। পরে পাকিস্তানের নৌবাহিনীতে নিয়োগেও উর্দু ও ইংরেজিতে পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ২৭ নভেম্বর ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে করাচিতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ প্রস্তাবে ৫ ভাষা প্রশ্নে বাংলার স্বার্থ ও অধিকার ক্ষুণ্নের সংশয় ও আশঙ্কা প্রবলভাবে দেখা দেয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পূর্ব বাংলার স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার, শিক্ষামন্ত্রী আবদুল হামিদ ও পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান পরস্পরবিরোধী বক্তব্য প্রদান করেন। তথাপি তাদের বক্তব্যে একটি বিষয় স্পষ্ট যে উর্দুকে পাকিস্তানের লিংগুয়া ফ্রাঙ্কা করার প্রস্তাব ওই সম্মেলনে গৃহীত হয়। ৬ এই শিক্ষা সম্মেলনকে কেন্দ্র করে পূর্ব বাংলায় অসন্তোষ দানা বাঁধে। ৫ ডিসেম্বর ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে বর্ধমান হাউসে মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক চলাকালে সভাস্থলের বাইরে ছাত্র-জনতা বাংলাকে অবিলম্বে পূর্বপাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। ৭ উক্ত সম্মেলনের প্রতিক্রিয়ায় ৬ ডিসেম্বর ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে একটি প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় মুনীর চৌধুরী, কল্যাণ দাসগুপ্ত, একেএম আহসান প্রমুখ বক্তব্য প্রদান করেন। এতে ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী ও সরকারি কর্মচারীদের একাংশ অংশগ্রহণ করেন। সভায় সুস্পষ্টভাবে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি ভাষা ও শিক্ষার বাহনরূপে গ্রহণ করার দাবি জানানো হয়। ৮. সভা শেষে যে মিছিল বের হয় সেই মিছিলেরও স্লোগান ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দিদের মুক্তি চাই, উর্দুর জুলুম চলবে না ইত্যাদি। ৯. ৭ ডিসেম্বর মওলানা আকরম খাঁর সভাপতিত্বে এসএম হলে বাংলা ভাষার ওপর একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। একই দিন দুপুরে রেলওয়ে শ্রমিকদের সভায় একে ফজলুল হকের সভাপতিত্ব করার প্রশ্নে বাঙালি-অবাঙালি কর্মচারীদের মাঝে বিরোধ দেখা দেয়। ঢাকার স্থানীয় অধিবাসীদের অধিকাংশই তখন উর্দুর সমর্থক। বিরোধের সুযোগে স্থানীয় লোকদের মাঝে এ গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয় যে, সিরাজউদ্দৌলা পার্কের এ সভাটি হিন্দুদের সহযোগিতায় ফজলুল হকের পাকিস্তানবিরোধী একটি ষড়যন্ত্র। তাছাড়া বাংলার মতো একটি হিন্দু ভাষাকে উর্দুর পরিবর্তে রাষ্ট্রভাষা করার চক্রান্তও ওই সভার উদ্দেশ্য। ফলে মুসলিম লীগের অনুসারি স্থানীয় কট্টর অধিবাসীরা সভায় হাঙ্গামার সৃষ্টি করে, চেয়ারে অগ্নি সংযোগ করে এবং ছাত্রদের ওপর ক্ষুব্ধ ও চড়াও হয়। ধারণা করা হয় ওই ঘটনার পেছনে খাজাদের ইন্ধন ছিল। ১০. উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার তৎপরতার বিরোধিতা করে ১২ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে একটি প্রেস সাক্ষাৎকারে সরকারের ডাইরেক্টর অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন ডক্টর কুদরত-ই-খুদা বলেন, ‘কোন জাতির জীবনে অস্বাভাবিক কোন জিনিসকে চাপিয়ে দেওয়া চলে না এবং সেটা উচিতও নয়। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা।’ ১১. সিরাজউদ্দৌলা পার্কের ঘটনার কয়েকদিন পর (১২ ডিসেম্বর ) একদল লোক বাস ও ট্রাকে চড়ে উর্দুর পক্ষে ধ্বনি দিতে দিতে পলাশী ব্যারাক, পার্শ্ববর্তী মেডিকেল কলেজ এবং আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হোস্টেলে হামলা চালায়। এতে ২০ জনেরও অধিক লোক আহত হয়। ১২. প্রাথমিক পর্যায়ে হোস্টেলের ছাত্র, পলাশী ব্যারাকে বসবাসকারী সরকারি কর্মচারী ও সন্নিহিত এলাকার বাংলা সমর্থকরা এ হামলা প্রতিরোধ করেন। এতে উর্দু সমর্থকরা পালিয়ে যায়। এ ঘটনা বিদ্যুৎ বেগে সব শহরে ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র, পলাশী ব্যারাকের কর্মচারীবৃন্দ এবং শহরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা সাধারণ জনতা ইঞ্জিনিয়ারিং হোস্টেলে সমবেত হন। সেখান থেকে মিছিল সহযোগে শিক্ষামন্ত্রী আবদুল হামিদের বাসভবন ঘেরাও করেন। তারা সরকারি ফরমে বাংলা না থাকা এবং ছাত্রদের ওপর হামলার প্রতিকার চান। জনতা তাকেসহ (শিক্ষামন্ত্রী) সচিবালয় অভিমুখে মিছিল করে যান এবং বাধা ভেঙে সচিবালয়ে প্রবেশ করেন। এ সময় সচিবালয়ে অবস্থানরত কৃষিমন্ত্রী সৈয়দ আফজালের কাছে তারা তাদের দাবি জানান। উভয় মন্ত্রীর কাছ থেকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সমর্থনদানের লিখিত প্রতিশ্রুতি আদায় করেন। তদানীন্তন চিফ সেক্রেটারি আজিজ আহমদের কাছ থেকেও তারা একই প্রতিশ্রুতি আদায় করেন। অবশ্য আজিজ আহমদ প্রতিশ্রুতি দিলেও তিনি বাংলার বিপক্ষে তার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে তৎপর থাকেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৩ ডিসেম্বর সচিবালয়ের কর্মচারীরা পূর্ণ হরতাল পালন করেন এবং ওই দিন থেকে ১৫ দিনের জন্য ১৪৪ ধারা বলবৎ করা হয়। ১৩. বশীর আল্ হেলাল এ হরতালের তথ্যটি তার গবেষণায় উল্লেখ করেছেন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে এটিই ছিল প্রথম হরতাল পালন। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এরই ধরাবাহিকতায় রাজনৈতিক ঘটনার উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে সংগঠিত হয়

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে সূচিত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন স্বৈরাচারী পশ্চিম পাকিস্তানিদের নির্মম রাজনৈতিক নির্যাতন ও বাঙালিদের প্রতিরোধের ঘটনাপ্রবাহে সর্বব্যাপী রূপ পরিগ্রহ করে উনিশশ্ বায়ান্ন খ্রিষ্টাব্দের একুশে ফেব্রুয়ারি। তবে আন্দোলন এখানেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি ঘটেনি। বরং একুশে ফেব্রুয়ারির পর বাংলাভাষা ও বাঙালিদের বিরুদ্ধে পাকিস্তান শাসকদের অত্যাচার ও ষড়যন্ত্র না থেমে আরও কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়। ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৬ এই কালপর্বে পাকিস্তানের শাসক-শোসক গোষ্ঠীর প্রতিভূ মুসলিম লীগ সরকারের দমন-পীড়নমূলক নীতি ও পদক্ষেপ স্থিমিত হয়ে পড়া রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বে একটি উচ্চকণ্ঠ শোনা যায় শেখ মুজিবুর রহমান। তবে পশ্চিম পাকিস্তানিদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে অদম্য বাঙালির প্রতিরোধ সংগ্রামের সফল পরিণতি বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসাবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি লাভ করে। ২৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে শাসনতন্ত্রে পাশের মাধ্যমে বাংলা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে। এ সংবিধানে ২১৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়-২১৪-(ও) The state language of Pakistan shall be Urdu and Bengali. ভাষা আন্দোলন শুরুর প্রায় দশ বছর পর বাংলা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে এভাবেই বাঙালির দীর্ঘ ভাষা সংগ্রাম পাকিস্তান শাসকদের বিরুদ্ধে বাঙালিদের প্রথম বিজয় সূচিত হয়।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে সচিবালয়ের কর্মচারীদের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে আন্দোলনের সূত্রপাত তার দাবিটি ছিল পাকিস্তানে সংখ্যাগুরু অধিবাসীদের মুখের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা। ছাত্রসমাজের নেতৃত্বে এ আন্দোলন বেগবান হয়েছে এবং বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে পরিণত হয়েছে। এ আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি রাজনীতিকদের উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা ছিল না। মুসলিম লীগের কট্টরপন্থি অংশ এর তীব্র বিরোধিতা করে। তারা এটাকে ‘যুক্ত বাংলা গঠনের ষড়যন্ত্র’, ‘হিন্দুদের চক্রান্ত’ ইত্যাদি আখ্যা দিয়েছেন। অপর অংশটি ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের পূর্ব পর্যন্ত সংগঠিত ছিল না। এ অংশের যারা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাদের ছাত্র পরিচয়টিই প্রাধান্য পেয়েছে। শুরুতে কমিউনিস্ট পার্টির সরাসরি কোনো তৎপরতা লক্ষ করা যায় না। যদিও কমিউনিস্ট অনুসারী ছাত্ররা এ আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে এ দেশের ছাত্রসমাজের সংগ্রামী ভূমিকা ও আত্মদান তাদের নেতৃত্বের আসনে আসীন করে। এ আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ে ছাত্রসমাজ গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্ব দান করেন। তবে আন্দোলনের প্রথম ধূপকাঠিটি প্রজ্বলন করেন সচিবালয়ে কর্মরত বাঙালি কর্মচারীদের একাংশ। তারও অনেক পূর্ব থেকে বাঙালি লেখক-বুদ্ধিজীবীরা এ আন্দোলনের তাত্ত্বিক ভিত্তি গড়ে তোলেন।

লেখক : গবেষক ও গ্রন্থাগারিক

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম