অমর একুশের বইমেলা : ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্মারক
মনি হায়দার
প্রকাশ: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আমরা উচ্চারণ করি বা লিখি-জাতি বা জাতিরাষ্ট্র। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চেতনালোকে নির্মিত হয় জাতির নানাবিধ উপসর্গ-রাষ্ট্রীয় কাঠামো, জনগণ, প্রশাসন, সরকার, মন্ত্রী, বিচার বিভাগ-আইন আদালতসহ আরও অনেক অনুষঙ্গ। সবকিছু মিলিয়ে সম্পূর্ণ আকার ধারণ করে একটা রাষ্ট্রের আদি অকৃত্রিম রূপ এবং একইসঙ্গে আর্থ-সামাজিকতার পরিপ্রেক্ষিতে ইতিহাসগত ভৌগোলিক পরিকাঠামোও থাকে জাতি রাষ্ট্রের। সেসব কাঠামো ও চেতনার অগ্নিসিন্ধুর স্রোত ধারণ করে বাংলাদেশ রাষ্ট্র। সার্থক একটা জাতি রাষ্ট্র গড়ে উঠার পেছনে অনেক লড়াই সংগ্রাম ও ত্যাগের স্মারক থাকে। সেই স্মারকের ধারাবাহিকতায় স্বাধীন বাংলাদেশে বাঙালির সংস্কৃতির বিকাশ ও জাগরণে নানা পালা ও পার্বণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আমাদের দেশে নানা ধরনের পার্বণ আদিকাল থেকে জনগণ পালন করে আসছে স্বতঃস্ফূর্ত প্রয়োগে। পহেলা বৈশাখ, চৈত্রসংক্রান্তি, মুসলমানদের ঈদ, হিন্দুদের পূজা, বৌদ্ধদের বৌদ্ধ পূর্ণিমাসহ আরও অনেক সর্বধর্মীয় বোধের ঊর্ধ্বে রাষ্ট্রীয় ধারণায় পার্বণ বা সংস্কৃতির আবাহন আমাদের শানিত করে, সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়। সেসব পার্বণের পালায় সবপ্রথমে বাংলা একাডেমি আয়োজিত অমর একুশের বইমেলা মহত্তম ভূমিকা পালন করে চলেছে ১৯৭১ সালের পর থেকে। প্রকৃতপক্ষে ১৯৭১ সালে দখলদার হায়েনা পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে বাঙালি ও বাঙালির সংস্কৃতির বৃহত্তর যাত্রা শুরু। সেই মহাযাত্রায় অমর একুশের বইমেলা অনবদ্য আয়োজন। বই মানুষের আত্মার নিবিড় নিখুঁত প্রতিনিধি। বইয়ের পৃষ্ঠার মধ্যে তৃষ্ণাকাতর পাঠক খুঁজে ফেরেন আপন আত্মার গান, বিকশিত চেতনার সৌরভ। বাংলা একাডেমি আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় বাঙালির চেতনা দুয়ার খুলে স্বাগত জানায় বায়ান্নোর রক্তে আঁকা বর্ণমালার খোলা প্রান্তরে।
বাংলা একাডেমি আয়োজিত অমর একুশের বইমেলা বাঙালির সর্ববৃহৎ মেলা। লক্ষ লক্ষ বিচিত্র বিবিধ মানুষের উপস্থিতিতে বইমেলা হয়ে ওঠে মহাজাগরণের মহাসরণি। কিন্তু সব জাগরণের বা মিলনের একটা ইতিহাস থাকে, বাংলা একাডেমির নিজস্ব একটা অনন্য ইতিহাস আছে, তেমন আছে বাংলা একাডেমি আয়োজিত অমর একুশের বইমেলারও নিববচ্ছিন্ন ইতিহাস। সেই ইতিহাসের রূপবদ্ধ মলাট সংরক্ষণের সম্পূর্ণ ইতিহাস আমাদের ছিল না, ছিল এখানে-সেখানে টুকরো টুকরো ছড়ানো-ছিটানো তথ্যপঞ্জি।
বিশিষ্ট গবেষক ড. জালাল ফিরোজ ইতিহাসের মোহাফেজখানা থেকে ছড়ানো-ছিটানো টুকরো টুকরো ইতিহাসের অংশ গভীর মননের সঙ্গে জোড়া লাগিয়ে, গবেষণার সর্বোচ্চ মাত্রায় রচনা করছেন অনন্য পুস্তক-অমর একুশে বইমেলার ইতিহাস।
গবেষকেরা কাজ করেন নিবিষ্টি মনে নিজস্ব প্রথায়। কারণ, গবেষণা যে কোনো বিষয়ের চেয়ে অনন্য মনোযোগ দাবি করে। সেই দাবিকে প্রবলভাবে গ্রাহ্য করে ড. জালাল ফিরোজ প্রায় চারশ পৃষ্ঠার বইয়ে বাংলা একাডেমি আয়োজিত অমর একুশের বইমেলার সব ঠিকুজির সুলুকসন্ধান করেছেন এবং যত্নের সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন বইয়ে। কেবল বাংলা একাডেমির বইমেলা নয়, পৃথিবীর অন্যান্য দেশে কীভাবে কী নামে বইমেলার আয়োজন হয়েছে, সেই ইতিহাসও তুলে ধরেছেন। ফলে, বইটি কেবল বাংলাদেশের বইমেলার ইতিহাস আশ্রিত বই নয়, হয়ে উঠেছে বিশ্ববীক্ষণেরও একটি আকর গ্রন্থ।
অমর একুশের বইমেলার ইতিহাস বইটি ছয়টি অধ্যায় ভাগ করেছেন ড. জালাল ফিরোজ। বইয়ের অধ্যায়গুলো যথাক্রমে-১. ভূমিকা : কী আছে বইয়ে-কেন এই বই, ২. দেশে দেশে বইমেলা : অমর একুশের বইমেলার সঙ্গে তুলনা, ৩. অমর একুশের বইমেলা ১৯৭১-২০২২, ৪. নীতিমালা সরকার সংস্কৃতিজগৎ ছাত্রসমাজ সংবাদমাধ্যম অনুষ্ঠান, ৫. বইমেলার প্রতিপক্ষ ও চালেঞ্জসমূহ, ৬. উপসংহার : বইমেলার ভবিষ্যৎ।
ভূমিকা : কী আছে বইয়ে, কেন এই বই-প্রথম অধ্যায়ের একেবারে শেষে লেখক লিখেছেন-একুশে গ্রন্থমেলার ওপর উপর্যুক্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ, আলোচনা ও প্রতিবেদন থাকা সত্ত্বেও বর্তমান গ্রন্থ বিশেষ কয়েকটি কারণে আকর্ষণীয় ও প্রয়োজনীয় বলে বিবেচিত হতে পারে। প্রথমত, এর আগে কেবল অমর একুশে বইমেলা নিয়ে কোনো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। এটি এই বিষয়ে প্রথম গ্রন্থ। এই গ্রন্থেই প্রথম বিস্তৃত পরিসরে বইমেলার নানা দিক সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। সুতরাং বইমেলার ওপর ব্যাপক অনুসন্ধানজাত ব্যাখা বিশ্লেষণ এই গ্রন্থে পাওয়া যাবে। দ্বিতীয়ত, একুশের বইমেলার ওপর রচিত এই গ্রন্থ অসংখ্য তথ্যরভান্ডার। একুশের বইমেলা সম্পর্কিত প্রায় সব ধরনের তথ্য এই গ্রন্থে পাওয়া যাবে। তৃতীয়ত, এই বইয়ে বইমেলার ঐতিহাসিক শুরু, ক্রমান্বয়িক বিকাশ এবং বিভিন্ন সময়ে যুক্ত হওয়া নানা মাত্রিকতা নিয়ে আলোচনা রয়েছে। চতুর্থত, এই বইয়ে প্রথম অমর একুশে বইমেলার উদ্ভবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান এবং মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে বাঙালির মানসজগতে সৃষ্টি পরিবর্তন কীভাবে কাজ করছে তা বিশ্লেষেণের চেষ্টা করা হয়েছে। পঞ্চমত, বইমেলা সম্পর্কে এর আগে পরিবেশিত অনেক তথ্য-ভ্রান্তি উপযুক্ত প্রমাণের মাধ্যমে নিরসনের চেষ্টা করা হয়েছে এই বইয়ে। ষষ্ঠত, অমর একুশের বইমেলা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের মধ্যে থেকে কীভাবে শুরু ও বিকশিত হয়েছে, তার ব্যাখা এই গ্রন্থে পাওয়া যাবে। সপ্তমত, এই গ্রন্থে একুশে বইমেলা ভবিষ্যতে কী কী সমস্যা ও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে এবং কীভাবে এসব মোকাবিলা করা যাবে সে সম্পর্কে আলোচনা রয়েছে।
[পৃষ্ঠা : ২৮]
উপরের পাঠ থেকেই বোঝা যায়, লেখক কতটা আন্তরিক ও নিবেদিত থেকে অমর একুশে বইমেলার ইতিহাস নিষ্ঠা ও মায়া নিবদ্ধ করেছিলেন বইয়ের পাতায় পাতায়। সত্যিকার অর্থে, বিষয়টা খুবই হতাশার-বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই অমর একুশের বইমেলার শুরু, কিন্তু আদ্যোপান্ত ইতিহাসের বই প্রকাশিত হলো এই প্রথম, এত বছর পর। বাংলাদেশে লেখক প্রকাশকের অভাব নেই, কিন্তু প্রয়োজনীয় বইটি হতে সময় লাগল পঞ্চাশ বছরেরও অধিক। আনন্দ বা গৌরব এখানে, শেষ পর্যন্ত বইটি হলো এবং প্রকাশক বাংলা একামেমি। বাংলা একাডেমি বাঙালি জাতি সত্তার সব গৌরব আর সংস্কৃতি আন্দোলনের যাবতীয় হলাহল ধারণ করে বিচিত্র ধারায় বহুধাবিবিধ বই প্রকাশ করে আসছে। সেই প্রকাশনা ধারাবাহিকতায় প্রকাশিত হলো ড. জালাল ফিরোজের অনন্য গবেষণালদ্ধ বই অমর একুশে বইমেলার ইতিহাস।
২০১৪ সালের আগের যে বইমেলার পরিবেশ ছিল, আজকের দিনের বইমেলার বিপরীতে পরিস্থিতি ছিল অভাবনীয়ভাবে ভিন্ন। গত শতকের আশি বা নব্বই দশকে বাংলা একাডেমির মূল প্রাঙ্গণজুড়েই বইমেলা ছিল। বাংলা একাডেমির বর্ধমান ভবন, বটতলা, পুকুরের পশ্চিম প্রান্তজুড়ে বইমেলার আয়োজন থাকত। একুশে ফেব্রুয়ারি বা ছুটির দিনেগুলোতে উপচেপড়া ভিড়ে বাংলা একাডেমির চৌহদ্দির মধ্যে তিলধারণের ঠাঁই থাকত না। সুচারু বিন্যাসে মেলা প্রাঙ্গণে দর্শনার্থী প্রবেশের জন্য লাইন এত দীর্ঘ হতো, যে একদিকে লাইন লম্বা হতো টিএসসি, অন্যদিকে ছিল দোয়েল চত্বর পর্যন্ত। তারও আগে বইমেলা ছিল অনেকটা বারোয়ারি ধরনের। বইমেলা বাংলা একাডেমির দেওয়ালের বাইরের রাস্তায় ছড়িয়ে ছিল। রাস্তার দুই পাশে ছোট ছোট স্টলে গানের ক্যাসেট, বাঁশি, খেলনা, ইলেকট্রিক লাইট, মিষ্টির দোকান ছিল। ছিল হালকা খাবারের দোকানও। অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হয়ে এসেই বইমেলাকে সত্যিকারের বইমেলায় রূপান্তরের জন্য রাস্তার সামনের খুচরো দোকান দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। এবং সেই থেকে সত্যিকারের মহান একুশের চেতনায় বারোয়ারি আয়োজনকে ছেঁটে ফেলে দিয়ে প্রকৃত বইমেলা হিসাবে আত্মপ্রকাশ ঘটে। পাঠকরা বা দেশের মানুষ জানেন বা দেখেন বাংলা একাডেমি আয়োজনে অমর একুশের বইমেলা করে থাকে, কিন্তু পেছনে কত কত ঘটনা, ঘটনার পরের ঘটনা ঘটে, কত বিচিত্র পরিকল্পনা, কত প্রজ্ঞাবান মানুষের আগমন ঘটে-মুখর হয়ে ওঠে বইমেলা প্রাঙ্গণ। বিশেষ করে সরকারপ্রধানরা যখন বইমেলা উদ্বোধন করতে আসতে শুরু করেন, তখন থেকেই রাষ্ট্রীয় আচার ঢুকে যায় আরও প্রখরভাবে। নানা সীমাবদ্ধতার বাধা অতিক্রম করে অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে বইমেলা বাংলা একাডেমির মূল প্রাঙ্গণ থেকে সামনের ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়ে যান মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান ২০১৪ সালে। সঙ্গে সঙ্গে অমর একুশের বইমেলা নতুন রূপ পরিগ্রহ করে দেশের মানুষ-পাঠক, প্রকাশকও লেখকদের সামনে প্রতিভাত হতে থাকে। মাঝখানে করোনা এসে একটা ঝাঁকি দিলেও বাংলা একাডেমির বইমেলা বাঙালির চেতনায় ইতিহাসের পাঠ হিসাবে এগিয়ে যাচ্ছে পূর্ণ গতিতে। যতদিন বাঙালি, বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশ, ততদিন অমর একুশের বইমেলা জেগে থাকবে প্রতিটি বাঙালির চেতনার কুটিরে আলো ও সুন্দরের পরম সাধনায়।
যেটুকু লিখলাম, সবটাই লিখলাম? না, বিশাল সমুদ্র ইতিহাসের সূচাগ্র পরিমাণ মাত্র লিখতে পারলাম।
সমুদ্র লিখতে হলে দরকার এষণা ও গবেষণার প্রযুক্ত মন। সেই মন ও এষণার সব বৈভব যুক্ত করে অমর একুশে বইমেলার ইতিহাস-ছিন্ন পাতার টুকরো টুকরো অংশ জোড়া দিয়ে, ফেলে আসা সময় ও বর্তমানের সঙ্গে সংগতি রেখে একটি সূত্রে গেঁথে বইটি পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করেছেন ড. জালাল ফিরোজ। বাংলা একাডেমি আয়োজিত বইমেলা বাংলার পাঠকদের হৃদ মন্দিরে কতটা প্রথিতো প্রমাণ পাওয়া যায়, এ বইয়ের একটি বিরবণী থেকে। ১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমি রাশিফল নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে স্টল বরাদ্দ করেছিল। প্রতিক্রিয়ায় ফজলুল করিম একজন পাঠক দৈনিক সংবাদে চিঠি লিখেছেন।
তিনি চিঠিতে লেখেন-মহান ভাষা আন্দোলনের ফলশ্রুতি হিসাবে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়। সে কারণে একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষ্যে বাংলা একাডেমির অনুষ্ঠানমালার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। অতীতে সপ্তাহব্যাপী আলোচনা সভা, পুস্তক প্রদর্শনী, কবিতা পাঠ, সঙ্গীতানুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে বাংলা একাডেমি তাদের অনুষ্ঠানমালা সূচনা করেছেন। এ বছর উপরোক্ত অনুষ্ঠানমালার পাশাপাশি প্রথমবারের মতো বাংলা একাডেমি একটি বিশেষ প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছে। এবারকার প্রদর্শনীতে একদিকে বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের তৈলচিত্র ও ভাষা আন্দোলনভিত্তিক বিভিন্ন সময়ের ছবি স্থান পেয়েছে। বাংলা একাডেমির এ ধরনের প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানাই।
‘সংবাদ’ পাঠ করে জানতে পারলাম ‘রাশিফল’ নামেও একটি ‘ব্যতিক্রম ধর্মী স্টল’ মেলায় খোলা হয়েছে। ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে রাশি ফলের কি সূত্র সম্পর্ক তা আমাদের জানা নেই। তবে একুশে ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠানের যে শ্রদ্ধা ও পবিত্রতা রয়েছে, তাতে ‘রাশিফল’ নামক উক্ত স্টল খোলাতে তার পবিত্রতা ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলে আমাদের বিশ্বাস। এ ধরনের স্টল আনন্দ মেলাতেই শোভা পায়। মহান ঐহিত্যবাহী কোনো জাতীয় অনুষ্ঠানের প্রদর্শনীতে একান্ত বেমানান বলেই আমাদের মনে হয়। কর্তৃপক্ষকে অতি শিগ্গির ‘রাশিফল’ নামক ব্যতিক্রর্মী স্টলটি বন্ধ করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করি।’
পৃষ্ঠা- ৯৩
কিন্তু গত ৮/২/৮৪ তারিখে দুটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। প্রথমত, বাংলা একামেডি জাতীর মননের প্রতীক হিসাবে প্রতিক্ষণে কোটি কোটি বাঙালির প্রখর দৃষ্টি ও বিবেচনার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। প্রমাণ উপরের এক বাঙালির চিঠি ও প্রতিক্রিয়া। তিনি মেনে নিতে পারেননি, বাঙালির জীবন ও রক্তের আকরে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানে ভাববাদের এমন প্রকাশ। তিনি সেই সময়ের জনপ্রিয় দৈনিকে চিঠি লিখে নিজের অবস্থান ও প্রতিকার দাবি করেছেন। দ্বিতীয়ত, বইটির লেখক গবেষক জালাল ফিরোজের তথ্য অনুসন্ধানের মহান ব্রত। ১৯৮৪ সালের একটি দৈনিকে একজন বাঙালি পাঠক কি প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন চিঠি লিখে, সাধারণের কিছুই যায়-আসে না, কিন্তু একজন প্রকৃত গবেষকের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই গুরুত্ব অনুধাবণ করে ছোট একটি চিঠিও উপস্থাপন করেছেন তিনি বইয়ে। প্রায় চারশ পৃষ্ঠার বইটির পাতাজুড়ে এমন সব তথ্য ও তত্ত্বের সমাবেশ ঘটিয়েছেন, যে বাংলা একাডেমি কিংবা বইমেলাসংক্রান্ত কোনো কাজ করতে গেলে, জালাল ফিরোজ রচিত ও বাংলা একাডেমি প্রকাশিত অমর একুশে বইমেলার ইতিহাস আকর গ্রন্থ হিসাবে কাজ করবে।
বাংলা একাডেমির পূর্ণ মাটি কতটা ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত বইয়ের আরেকটি উদ্ধৃতি উপস্থাপন করে প্রমাণ রাখছি। লেখক ড. জালাল ফিরোজ লেখেন-এখন প্রতি একুশে উপলক্ষ্যে একাডেমিতে মাসব্যাপী আলোচনা, সেমিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। কিন্তু ১৯৭১ সালের পূর্বে কখনো একুশের অনুষ্ঠান সপ্তাহব্যাপী হয়নি। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর হাতেই প্রথম সপ্তাহব্যাপী একুশের অনুষ্ঠানমালা শুরু হয়। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বাঙালি হিসাবে বাংলা ভাষা ও দেশের জন্য কাজ করা, ক্ষমতায় গেলে বাংলার প্রতিষ্ঠা ও একাডেমিতে তার আগমন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। সেদিন তিনি উপস্থিত শ্রোতামণ্ডলীর উদ্দেশে বলেন, আপনারা বুকে হাত দিয়ে বলেন, আপনারা ভাষার জন্য কী করেছেন? দেশের জন্য আপনারা কী করেছেন?... আমরা যেদিন ক্ষমতায় যাবো সেদিন থেকে বাংলা রাষ্ট্রভাষা হবে।... তিনি বলেন, বাংলা একাডেমিরও সৌভাগ্য যে, এতদিন পরে তারা একুশে ফেব্রুয়ারি সপ্তাহ পালনের সুযোগ পেয়েছেন। আমারও সৌভাগ্য যে, এখানে আপনাদের সামনে এস দাঁড়াবার সৌভাগ্য জীবনে এই প্রথমবার আমি পেয়েছি।
পৃষ্ঠা- ৫৩
এভাবেই ইতিহাসের পাতা থেকে এবং ইতিহাসের আড়ালে থাকা তথ্য তুলে এনে এনে সাজিয়ে-গুছিয়ে সমৃদ্ধ রচনায় এক পূর্ণাঙ্গ বই অমর একুশে বইমেলার ইতিহাস। বইমেলা কেবলই কি বইমেলা? না, অমর একুশের ধারণাকে হৃদয়ে এঁকে বাঙালির বইমেলা দেয়, নতুন করে প্রদীপ্ত হওয়ার শক্তি ও সাহস। আমাদের বর্ণমালা পৃথিবীর অন্য বর্ণমালা থেকে ইতিহাসগতভাবে রক্তাক্ত। কেন? আমরা বাংলা ভাষা রক্ষা করেছি, প্রতিষ্ঠিত করেছি রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে। ভাষার তরে মরণের এমন ইতিহাস পৃথিবীর আর কোনো রাষ্ট্রের নেই, কেবল আমাদের, বাংলাদেশের এবং বাঙালির। সুতরাং আমাদের রক্তের রং যেমন লাল, ঠিক তেমনটি আমাদের বর্ণমালাও লাল চেতনাগত ধারণায়, যদি লিখি কালো রঙে। কিন্তু সব রং ছাড়িয়ে বাংলা ভাষা ও বর্ণমালা রক্ত রঙিন, যেমন আমাদের পলাশ কৃষ্ণচূড়া।
লেখক : কথাসাহিত্যিক