আইসিটি খাতের দুর্নীতি
শ্বেতপত্রে উন্মোচিত হবে ১৫ বছরের লুটপাট
পাঁচ সদস্যের বিশেষজ্ঞ শ্বেতপত্র কমিটি গঠিত

দেশের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) খাত ছিল ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের দুর্নীতি ও লুটপাটের স্বর্গরাজ্য। বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থার নেওয়া ২৫ হাজার কোটি টাকার ২১ প্রকল্পের অর্ধেকেরও বেশি লুটপাট হয়েছে বলে উঠে এসেছে সাম্প্রতিক এক তদন্তে। প্রায় প্রতিটি প্রকল্পেই ছিল মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়, অসম চুক্তি, অস্বচ্ছ ক্রয় প্রক্রিয়া এবং স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় অর্থের ব্যাপক অপচয়ের নজির। এ দুর্নীতির চিত্র উন্মোচনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার একটি স্বতন্ত্র শ্বেতপত্র প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির প্রফেসরিয়াল ফেলো অধ্যাপক ড. নিয়াজ আসাদুল্লাহর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি আগামী দুই মাসের মধ্যে এ শ্বেতপত্র প্রকাশ করবে বলে জানা গেছে। এতে বিগত সরকারের সময়ে আইসিটি খাতের দুর্নীতির বিশদ চিত্র এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের অপচয় প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
সম্প্রতি ‘ন্যাশনাল ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন স্ট্র্যাটেজি এবং আইসিটি রিফর্ম রোডম্যাপের’ খসড়া প্রস্তুত করেছে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আইসিটি বিভাগ। এ খসড়ায় আইসিটি খাতের দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি আলাদা শ্বেতপত্র প্রকাশের সুপারিশ করা হয়েছে।
পলিসি অ্যাডভাইজার (সমন্বয় ও সংস্কার) ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব জানান, ‘আইসিটি খাতের দুর্নীতি নিয়ে আলাদা শ্বেতপত্র প্রকাশের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে এবং আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি।’ এই কমিটিতে একাডেমিশিয়ান, আইনজ্ঞ, প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও সাংবাদিক রয়েছেন।
আইসিটি বিভাগের সচিব শীর্ষ হায়দার চৌধুরী বলেন, ‘আইসিটি খাতের দুর্নীতি তদন্তে ১৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল, যার প্রতিবেদন আমরা হাতে পেয়েছি। প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশে পৃথক শ্বেতপত্র প্রকাশের জন্য পাঁচ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের কাজ চলছে। আশা করছি, এপ্রিলের মধ্যে আমরা এ শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে পারব।’
এদিকে আইসিটি খাতের অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্তের জন্য গঠিত কমিটির প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০০৯ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নেওয়া ২১টি প্রকল্পে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করা হয়েছে। অনেক প্রকল্প তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের কার্যপরিধির বাইরের হওয়া সত্ত্বেও বাস্তবায়ন করা হয়েছে, যা সরকারি অর্থের অপচয় ঘটিয়েছে।
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকার তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে দুর্নীতি ও অপব্যবস্থাপনার শীর্ষ খাতে রূপান্তর করে গেছে। এতে দেশের ডিজিটাল অর্থনীতি ও ট্রান্সফরমেশনের সুনাম নষ্ট হয়েছে এবং বৈদেশিক ঋণের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।’
উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ‘ন্যাশনাল ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন স্ট্র্যাটেজি এবং আইসিটি রিফর্ম রোডম্যাপের’ খসড়ার ওপর দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে মতামত আহ্বান করেছেন। ১৭১ পৃষ্ঠার খসড়াটিতে ২০২৫-২০৩০ সাল মেয়াদে ১০টি কৌশলগত পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে-আন্তঃক্রিয়াশীল ডিজিটাল অবকাঠামো প্রতিষ্ঠা, সাইবার নিরাপত্তা ও ডেটা সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করা, আইসিটি বিভাগের সেবা কাঠামো পুনর্গঠন, ডিজিটাল অর্থনীতি চাঙা করতে উদ্ভাবনী ইকোসিস্টেম গড়ে তোলা, ২০৩০ সালের মধ্যে ৭০-৮০ লাখ আইটি দক্ষ পেশাদার তৈরি করা, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ৫০ হাজার সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ গড়ে তোলা। এছাড়া পোশাকশিল্পে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দক্ষতা উন্নয়নের পরিকল্পনাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
বেসিসের সাবেক সভাপতি ফাহিম মাশরুর বলেন, ‘আইসিটি খাতে দুর্নীতির বিষয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ একটি ইতিবাচক উদ্যোগ হতে পারে, তবে শ্বেতপত্র কমিটিতে আইসিটি খাত সম্পর্কে দক্ষ ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করলেই সঠিক চিত্রটি তুলে আনা সম্ভব হবে। কেননা এর আগে আইসিটি বিভাগের গঠিত ১৩ সদস্যের ইন্টারনাল কমিটির প্রতিবেদন এখনো প্রকাশিত হয়নি। এছাড়া এ খাতে দুর্নীতির বিষয়ে আমরা এখনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখিনি। সাবেক প্রতিমন্ত্রী পলকের বিরুদ্ধে পাহাড়সম অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও এখনো সরকারি অর্থ আত্মসাতের কোনো মামলা হয়নি। পলকের এ দুর্নীতিতে আমলাদেরও সহযোগিতা রয়েছে, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ প্রকাশ করা হয়নি। আমরা আগেই বলেছিলাম, দুর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করলে এটি অবশ্যই নিউট্রাল ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত হওয়া উচিত, অন্যথায় কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টের বিষয়টি উঠে আসে।
মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ আইসিটি খাতের দুর্নীতি নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশের সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক হিসাবে দেখছেন। তবে তিনি মনে করেন, এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ কাজে খাতসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। অন্যথায় ভুল সিদ্ধান্তের ঝুঁকি থেকে যাবে, যা নিরপরাধ ব্যক্তিদের দোষী সাব্যস্ত করতে পারে এবং প্রকৃত দুর্নীতিবাজদের আড়াল করার সুযোগ সৃষ্টি করবে।
সরকারের পরিকল্পনা অনুসারে, আগামী দুই মাসের মধ্যে আইসিটি খাতের দুর্নীতি নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশিত হবে। এতে বিগত ১৫ বছরে অনিয়ম ও লুটপাটের চিত্র উন্মোচিত হবে এবং ভবিষ্যতের জন্য নীতি সুপারিশ প্রণয়ন করা হবে। তবে আইসিটি খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ করাই যথেষ্ট নয়, বরং ভবিষ্যতে কীভাবে ডিজিটাল বৈষম্য দূর করা যায় এবং খাতটি কীভাবে আরও এগিয়ে নেওয়া যায়, সে দিকেও নজর দেওয়া জরুরি।