
প্রিন্ট: ০৮ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:৪০ পিএম
দ্বীনের দাওয়াত হোক ভালোবাসাময়

লাবীব হুমায়দী
প্রকাশ: ০৪ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বাঙালি মুসলিম সমাজে আমরা প্রায়ই একটি সাধারণ চিত্র দেখি, আমরা চাই সবাই ধার্মিক হোক, ইসলামের পথে চলুক, ধর্মীয় অনুশীলনে মনোযোগী হোক। এ চাওয়া নিঃসন্দেহে একটি মহৎ অভিপ্রায়, কারণ একজন মুসলমানের কামনা তো এমনটাই হওয়া উচিত যে, সে শুধু নিজে নয়, বরং তার চারপাশের মানুষও ইসলামের আলোয় আলোকিত হোক। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এ চাওয়াটা আমরা বাস্তবে কতটুকু কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে পারছি? আমরা কি সত্যিই অন্যদের ধর্মীয় অনুশীলনের দিকে আহ্বান জানাচ্ছি, নাকি কেবল সমালোচনা করে নিজেদের দায়িত্ব শেষ করে দিচ্ছি?
আমাদের আশপাশে কেউ ইসলামি বিধান পুরোপুরি অনুসরণ করছে না, কেউ হয়তো হিজাব-বোরকা পরছে না, কেউ হয়তো সামাজিক মাধ্যমে নিজের পরিবারের ছবি শেয়ার করছে, কেউ হয়তো পশ্চিমা সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে পড়েছে-এসব দেখলেই আমরা তীব্র সমালোচনা শুরু করি। কোনো যুবক যদি ইসলামের পথে না চলে, আমরা তখন তাকে নিয়ে হতাশা প্রকাশ করি, তার দিকে আঙুল তুলি। ফেসবুক বা অন্য সামাজিক মাধ্যমে নানা ধরনের পোস্ট লিখি, যেখানে মূলত অভিযোগ আর সমালোচনার ছড়াছড়ি থাকে, ‘আজকালকার ছেলেমেয়েরা একদম বেয়াড়া, তারা ইসলামের পথে নেই, তারা ফেসবুকে শুধু অশ্লীলতা ছড়াচ্ছে!’
কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমরা কি কখনো তাদের কাছে গিয়ে ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরেছি? আমরা কী কখনো ধৈর্য ধরে ভালোবাসার সঙ্গে তাদের বুঝিয়েছি? আমরা কি তাদের জন্য দোয়া করেছি, তাদের হৃদয় জয় করার চেষ্টা করেছি? সত্য হলো, দাওয়াতের ক্ষেত্রে আমরা একশ হাত পিছে, কিন্তু সমালোচনার ক্ষেত্রে আমরা সব সময় এগিয়ে থাকি। অথচ, ইসলাম কখনো এ ধরনের নেতিবাচকতা বা আক্রমণাত্মক সমালোচনাকে উৎসাহিত করেনি।
রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদের সামনে দাওয়াত প্রদানের একটি চমৎকার উদাহরণ রেখে গেছেন। তিনি কখনো কঠোর সমালোচনা করে বা কারও ভুলকে সরাসরি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে কাউকে ইসলামের পথে আনতে চাননি। বরং তিনি ভালোবাসা, উদারতা ও ধৈর্যের মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে ইসলামের আলো জ্বালিয়ে দিয়েছেন।
একবার এক বেদুইন মসজিদে এসে প্রস্রাব করে ফেলল। সাহাবিরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন এবং তাকে শাস্তি দিতে চাইলেন। কিন্তু রাসূল (সা.) তাদের থামিয়ে দিলেন এবং বললেন, ‘তাকে যেতে দাও, এরপর পানি ঢেলে জায়গাটি পরিষ্কার করো।’ এরপর তিনি সেই বেদুইনের কাছে গিয়ে কোমলভাবে ইসলাম সম্পর্কে বোঝালেন। ফলাফল কী হলো? সেই ব্যক্তি মুহূর্তেই ইসলামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে মুসলমান হয়ে গেল এবং রাসূলুল্লাহর প্রতি গভীর ভালোবাসায় আবদ্ধ হলো।
আজ আমরা রাসূলুল্লাহর এই সুন্দর আচরণ ভুলে গেছি। আমরা মানুষকে ইসলামের দিকে ডাকতে চাই, কিন্তু সেই আহ্বান ভালোবাসার মাধ্যমে নয়, বরং কঠোর সমালোচনা আর কটাক্ষের মাধ্যমে জানাই। এতে করে মানুষ ইসলামের প্রতি আরও দূরে সরে যায়, নিজেদের ভুল স্বীকার করার বদলে আত্মরক্ষার জন্য আরও বেশি প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
আমাদের সমাজে যদি আমরা সত্যিকার অর্থে ধার্মিকতার চর্চা বাড়াতে চাই, তাহলে শুধু সমালোচনা করে বা আক্ষেপ প্রকাশ করে কোনো ফল আসবে না। বরং আমাদের উচিত। নিজেরা ইসলামের আদর্শ বাস্তবে অনুসরণ করা, ভালোবাসা ও সহমর্মিতার মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নেওয়া, দাওয়াতের কাজ করা, মানুষের জন্য দোয়া করা এবং যারা ধর্মের পথে আসতে চায় তাদের সাহায্য ও অনুপ্রেরণা দেওয়া।
আমরা অনেক সময় দেখি, কেউ ধর্মের পথে আসার চেষ্টা করলে সমাজ তাকে নিরুৎসাহিত করে। কেউ হিজাব পরতে চাইলে তাকে নিয়ে ঠাট্টা করা হয়, কেউ নামাজ শুরু করলে তাকে ‘মৌলভী’ বলে বিদ্রুপ করা হয়। অথচ আমাদের উচিত যারা ইসলামের পথে আসতে চায়, তাদের সাহায্য করা, উৎসাহ দেওয়া, তাদের পাশে থাকা।
আমরা চাই আমাদের সমাজ আরও ইসলামিক হোক, সবাই ইসলামের পথে চলুক, এ চাওয়া অবশ্যই মহৎ। কিন্তু এই চাওয়াটা কেবল মুখের কথা বা ফেসবুক স্ট্যাটাসে সীমাবদ্ধ থাকলে কোনো লাভ নেই। আমাদের নিজেদের কাজ, আচরণ ও দাওয়াতের মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে ইসলামের সৌন্দর্য পৌঁছে দিতে হবে। আমরা যদি সত্যিই ইসলামের পথে মানুষকে আনতে চাই, তাহলে আমাদের ভালোবাসা, সহানুভূতি ও ধৈর্যের চর্চা করতে হবে।