Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

ইসলামে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি

Icon

মাহবুবুর রহমান

প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ইসলামে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি

রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনে রয়েছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য সব দৃষ্টান্ত। মদিনায় হিজরতের পর তিনি একটি চুক্তি করেছিলেন যা ‘মদিনা সনদ’ নামে পরিচিত। এটি ছিল ইসলামের ইতিহাসে প্রথম লিখিত সংবিধান এবং এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল মুসলিম ও অমুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তি ও সম্প্রীতি রক্ষা করা।

মদিনা সনদ অনুযায়ী : ১. মুসলিম এবং ইহুদি সম্প্রদায় মদিনায় পরস্পর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে থাকবে। ২. উভয় সম্প্রদায় নিজেদের ধর্ম পালনে স্বাধীন থাকবে। ৩. মদিনায় কেউ কাউকে আক্রমণ করবে না এবং বাইরের আক্রমণের ক্ষেত্রে সবাই মিলে প্রতিরোধ করবে। এটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির একটি মাইলফলক হিসাবে ইতিহাসে চিহ্নিত।

হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা সেই ব্যক্তি নও, যে অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি জুলুম করে, তাদের অধিকার হরণ করে বা তাদের প্রতি কঠোর হয়।’ (আবু দাউদ)। এ হাদিসে স্পষ্টভাবে অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সুবিচার এবং সম্মানের নির্দেশনা রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, প্রতিবেশীর অধিকার নিশ্চিত করা ইমানের একটি অংশ। তিনি বলেন, ‘আল্লাহর শপথ! সে ব্যক্তি মুমিন হতে পারে না, যার প্রতিবেশী তার অন্যায় বা ক্ষতির কারণে নিরাপদ নয়।’ (সহিহ বুখারি, ৬০১৬)। এ হাদিসে প্রতিবেশীর অধিকার রক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, যা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অন্যতম মূলনীতি।

ইসলাম যুদ্ধ বা হিংসার পরিবর্তে শান্তি ও সংলাপের ওপর গুরুত্ব দেয়। যুদ্ধের সময়ও ইসলাম শত্রুপক্ষের ধর্মীয় উপাসনালয় ও নিরপরাধ ব্যক্তিদের রক্ষা করার নির্দেশ দেয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) যুদ্ধের জন্য সাহাবাদের প্রেরণ করার সময় বলতেন, ‘কোনো নারী, শিশু, বৃদ্ধ বা ধর্মীয় ব্যক্তিকে হত্যা করবে না। উপাসনালয় ধ্বংস করবে না।’ - (মুসলিম শরিফ)

বর্তমান বিশ্বে সাম্প্রদায়িক বিরোধ একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ধর্মের নামে হিংসা এবং বিভাজনের ঘটনা বাড়ছে। কিন্তু ইসলামের শিক্ষা এসব হিংসার বিপরীতে শান্তি এবং সহযোগিতার আদর্শকে তুলে ধরে। বিশ্বায়নের যুগে, যেখানে ভিন্ন ধর্ম, সংস্কৃতি এবং জাতির মানুষের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া বৃদ্ধি পেয়েছে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গুরুত্ব আরও বেড়েছে। ইসলাম শিক্ষা দেয় কিভাবে বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষ পরস্পর সম্মানের সঙ্গে সহাবস্থান করতে পারে। ইসলামের মূলভিত্তি হলো তাওহিদ বা একত্ববাদ, যা মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ দূর করে এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসে ঐক্যবদ্ধ হতে উৎসাহিত করে। এটি মানবজাতির জন্য একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানায়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মূল মন্ত্র হলো আল্লাহর সৃষ্টি হিসাবে মানুষকে ভালোবাসা এবং তাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করা।

কুরআনে উল্লেখিত একটি গুরুত্বপূর্ণ আয়াতে বলা হয়েছে, ‘ধর্মের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই। সঠিক পথ ভ্রান্ত পথ থেকে পৃথক হয়ে গেছে।’ (সূরা আল-বাকারা, ২:২৫৬) এ আয়াত স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় যে, ইসলাম ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতাকে সমর্থন করে না। এটি ব্যক্তির স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয় এবং অন্যের বিশ্বাসকে সম্মান করতে বলে।

ইসলাম শুধু মুসলমানদের জন্য নয় বরং সমগ্র মানবজাতির জন্য একটি সার্বজনীন বার্তা। এটি পৃথিবীর প্রতিটি ধর্মের প্রতি সহনশীল এবং সহমর্মী আচরণের নির্দেশনা প্রদান করে। ‘তোমাদের ধর্ম তোমাদের জন্য, আমার ধর্ম আমার জন্য।’ (সূরা আল-কাফিরুন, ১০৯:৬) এ আয়াতটি ইসলামের সহিষ্ণুতার মূলনীতিগুলোর একটি। এটি প্রমাণ করে যে, ইসলাম ভিন্ন ধর্মের অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দেয় এবং কোনো ধরনের বৈরিতা বা শত্রুতাকে সমর্থন করে না। ইসলামের নবি মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি অমুসলিম নাগরিকের (যাকে জিম্মি বলা হয়) প্রতি অন্যায় করে বা তার অধিকার হরণ করে, কিয়ামতের দিন আমি তার বিরুদ্ধে সাক্ষী দেব।’ (আবু দাউদ) এখানে অন্য ধর্মাবলম্বীদের সুরক্ষার প্রতি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কঠোর মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। এটি দেখায় যে, ইসলাম শুধু মুসলিমদের জন্য নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির জন্য ন্যায়বিচার এবং শান্তির বার্তা বহন করে।

ইসলামের ইতিহাসে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে। বিশেষত, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবন থেকে আমরা বহু শিক্ষা নিতে পারি।

মদিনা সনদ : মদিনায় ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময়, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইহুদি, খ্রিষ্টান এবং মুশরিকদের সঙ্গে একটি সংবিধান প্রণয়ন করেছিলেন। এটি ছিল একটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ভিত্তি। মদিনা সনদের গুরুত্বপূর্ণ শর্তগুলো হলো-প্রত্যেক সম্প্রদায় তাদের ধর্ম পালনে স্বাধীন থাকবে। মদিনায় বসবাসকারী সবাই একে অপরের প্রতি সহযোগিতা করবে। বাইরের আক্রমণের ক্ষেত্রে সবাই মিলে মদিনার সুরক্ষা নিশ্চিত করবে।

খলিফা ওমর (রা.)-এর সময় : খলিফা ওমর (রা.) যখন জেরুজালেম জয় করেন, তখন তিনি খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করেন। তিনি তাদের উপাসনালয় রক্ষা করেন এবং সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দেন। তার সময়ে কোনো উপাসনালয় ভাঙা হয়নি বা কোনো ধর্মীয় বৈষম্য সৃষ্টি হয়নি।

স্পেনে মুসলিম শাসন : স্পেনের মুসলিম শাসনকালে (৭১১-১৪৯২), মুসলিম, খ্রিষ্টান এবং ইহুদিরা একসঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করত। এ সময়কালে বিজ্ঞান, সংস্কৃতি এবং শিল্পকলায় ব্যাপক উন্নতি হয়েছিল। এ যুগ ‘আল আন্দালুসের স্বর্ণযুগ’ নামে পরিচিত।

যদিও ইসলাম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ওপর জোর দেয়, তবে বাস্তবজীবনে কিছু চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান। এর মধ্যে রয়েছে-ধর্মের নামে উগ্রবাদ এবং হিংসা। সামাজিক বিভাজন এবং কুসংস্কার। রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি। এ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার জন্য ইসলামের নৈতিক শিক্ষাগুলোকে সমাজে প্রয়োগ করা জরুরি। যেমন-

ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা প্রচার : সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য কুরআন এবং হাদিসের শিক্ষা সম্পর্কে সঠিক ধারণা সমাজে প্রচার করতে হবে।

সংলাপের আয়োজন : বিভিন্ন ধর্ম এবং সম্প্রদায়ের মধ্যে সংলাপ এবং আলোচনা আয়োজন করে পারস্পরিক বোঝাপড়া বাড়াতে হবে।

ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা : সমাজের প্রতিটি স্তরে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে, যাতে কোনো সম্প্রদায় বৈষম্যের শিকার না হয়।

শিক্ষার মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি : ধর্মীয় সহিষ্ণুতা এবং সম্প্রীতির শিক্ষা ছোটবেলা থেকেই প্রদান করা জরুরি।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম