বন্ধ হোক ধর্মের নামে হানাহানি
মাহমুদ আহমদ
প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিশ্বের যে দিকে তাকাই শুধু অশান্তি আর অশান্তি। প্রতিদিন প্রতিনিয়ত বিশ্বের কোথাও না কোথাও ধর্মীয় বিদ্বেষের কারণে রক্তপাতের ঘটনার সংবাদ পাওয়াই যায়। আল্লাহপাক সব আদম সন্তানকে প্রভূত সম্মান ঠিকই দান করেছেন কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে, আমরা সে সম্মান ধরে রাখতে পারিনি। সব আদম সন্তানকে আল্লাহতায়ালা সমভাবে সম্মানিত করেছেন এবং কোনো বিশেষ জাতি বা গোত্রের প্রতি পক্ষপাতমূলক ব্যবহার করেননি। একজন মানুষ সে যে ধর্মেরই হোক না কেন তার মূল পরিচয় হলো সে আদম সন্তান।
মানুষ হিসাবে তিনি কাউকে পৃথক করেননি। তার দৃষ্টিতে সবাই সমান এবং একই উম্মাহ কিন্তু পরবর্তিতে মানুষ বিভিন্ন দলে-উপদলে বিভক্ত হয়ে যায়। যেমন পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক ইরশাদ করেছেন ‘আর মানবজাতি একই সম্প্রদায়ভুক্ত ছিল। পরে তারা মতভেদ করল’ (সূরা ইউনুস, আয়াত : ২০)। ‘কিন্তু তারা তাদের মাঝে নিজেদের বিষয়কে বহু খণ্ডে খণ্ডিত করে ফেলেছে। প্রত্যেক দল তাদের কাছে যা আছে তা নিয়ে অহংকার করছে’ (সূরা মুমিনুন, আয়াত : ৫৪)। আসলে সমসাময়িক নবির মৃত্যুর পর নবির অনুসারীরা সাধারণত নিজেদের মধ্যে মতভেদ আরম্ভ করে এবং দলে-উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। আর প্রত্যেক দলই মনে করে তারাই নবির সত্য অনুসারী এবং অন্যরা ভ্রান্ত কিন্তু সব নবি অনুসারীরাই আদম-হাওয়ারই বংশধর।
আল্লাহপাক এ পৃথিবীতে অসংখ্য নবি-রাসূল পাঠিয়েছেন মানবের সংশোধন আর দলে-উপদলে বিভক্ত না হয়ে সবাই যেন একই সৃষ্টিকর্তার ইবাদত করে। এক নেতৃত্বের অধীনে থেকে জীবন পরিচালিত করাই আল্লাহতায়ালার ইচ্ছা আর এ লক্ষ্যেই তিনি নবি-রাসূলদের প্রেরণ করেছেন। আজ মুসলিম জাহানের অবস্থার দিকে লক্ষ করলে সহজেই বুঝা যায়, তাদের অবস্থা কোন পর্যায় গিয়ে পৌঁছেছে। সমগ্র মুসলিম জাহান আজ চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন। শ্রেষ্ঠ নবি (সা.)-এর অনুসারী মুসলমানরা আজ নিজেরাই নিজেদের হত্যা করছে। এর কারণ কী? এর মূল কারণ হচ্ছে, মুসলমান আজ পবিত্র কুরআনের আদেশ ও শ্রেষ্ঠ নবির অতুলনীয় শিক্ষার ওপর আমল করা ছেড়ে দিয়ে কার ধর্ম কী তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। পবিত্র কুরআন কি বলে তার অনুসরণ না করে বাহ্যিকতার অনুসরণ করছে।
অথচ এক জাতি হিসাবেই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে সৃষ্টি করেছেন। যেভাবে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয় তোমাদের এ উম্মত একই উম্মত এবং আমিই তোমাদের প্রভু-প্রতিপালক। অতএব, তোমরা আমার ইবাদত কর’ (সূরা আম্বিয়া, আয়াত : ৯৩)। ‘আর জেনে রাখ তোমাদের এ সম্প্রদায় একটিই সম্প্রদায়। আর আমি তোমাদের প্রভু-প্রতিপালক’ (সূরা মুমিনুন, আয়াত : ৫৩)। সবার সৃষ্টি যেহেতু একই ঐশী উৎস থেকে তাই সবার মূল কাজ হলো সবার মাঝে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত করা। সমগ্র বিশ্বে আজ মাজহাবের ফেরে মরছে সাধারণ নিরীহ মানুষ। আজ পাকিস্তানে যেমন সুন্নিরা আক্রান্ত হচ্ছে শিয়াদের দ্বারা, শিয়ারা আক্রান্ত হচ্ছে সুন্নিদের দ্বারা আবার আহমদিয়ারাও সেখানে আক্রান্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ভারতে হিন্দুদের দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে মুসলমানরা। পাকিস্তানে আজ এমন কোনো দিন অতিবাহিত হয় না যেখানে মাজহাবের ফেরে সাধারণ মানুষের প্রাণ হারাতে না হয়। এছাড়া ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান, লিবিয়া, ইয়েমেনসহ বিশ্বের বহু দেশে কেবল এ ধর্মীয় কারণে প্রতিনিয়ত প্রাণ হারাতে হচ্ছে অনেককে। চালানো হচ্ছে নিরীহ নিরপরাধ অবোধ শিশুদের ওপর একের পর এক বর্বরোচিত হামলা।
ধর্মের নামে এসব নৈরাজ্য যা আদৌ ইসলাম সমর্থন করে না এবং কোনো ধর্মই সেটা সমর্থন করতে পারে না। কেউ হিন্দু, খ্রিষ্টান, মুসলমান বা অন্য কোনো মতাবলম্বী হলেই যে তাকে আঘাত করতে হবে, এ নীতি কি কোনো ধর্মের হতে পারে? অবশ্যই পারে না। কেননা, ধর্মের চেয়ে বড় যে পরিচয় তা হলো মানুষ। একজন মানুষ সে যে ধর্মের বা মতের অনুসারী হোক, সে তার নিজ ধর্ম-কর্ম স্বাধীন ও পূর্ণ নিরাপত্তার সঙ্গে পালন করতে পারবে, এটাই শান্তি ও সম্প্রীতির ধর্ম ইসলামের শিক্ষা।
কবি নজরুল যথার্থই বলেছেন, ‘কাহারে করিছ ঘৃণা ভাই, কাহারে মারিছ লাথি? হয়তো উহারই বুকে ভগবান জাগিছেন দিবারাতি।’ আবার তিনি গেয়েছেন-‘তুমি চাহ নাই ধর্মের নামে গ্লানিকর হানাহানি, তলোওয়ার তুমি দাও নাই হাতে, দিয়াছ অমর বাণী, মোরা ভুলে গিয়ে তব উদারতা, সার করিয়াছি ধর্মান্ধতা, বেহেশত হতে ঝরে নাকো আর তাই তব রহমত। ক্ষমা করো হজরত।’
আমরা দেখতে পাই সমাজে এমন এক শ্রেণি রয়েছেন যারা বিভিন্ন ধর্মীয় মতাদর্শের বিরুদ্ধে এমনভাবে উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান করেন যা দেখে ও শুনে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য মরিয়া হয়ে যায়। যার ফলে কখনো মাজারে আবার কখনো মন্দির আবার কখনো মসজিদে আক্রমণ করে বসে। যদিও এ সংখ্যা তেমন বেশি নয়। যার যার ধর্ম-কর্ম সে তার মতো করে পালন করুক, কেউ যদি ধর্মের নামে অন্যায় কিছু করেও থাকে তাহলে তার বিচারের ভার মহান সৃষ্টি কর্তার কাছেই ছেড়ে দেই। কেননা শেষ বিচারের মালিক তো কেবল তিনি। যে কাজ সৃষ্টি কর্তার সে কাজ নিজ কাঁধে নেওয়া মোটেও ঠিক নয়। আল্লাহপাক আমাদের প্রকৃত ইসলামের শিক্ষা অনুসরণ করে চলার এবং তা নিজ জীবনে বাস্তবায়ন করার তৌফিক দিন, আমিন।
লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট