বড়পির আবদুল কাদের জিলানী
মারেফাত বাগিচার শ্রেষ্ঠ বুলবুল
কুলসুম রশীদ
প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
শাহেনশাহ হজরত আব্দুল কাদের তিনি মনকে আকৃষ্টকারী, মন কেড়ে নেওয়ার এবং মনের খোরাককারী তিনি।
ওলিদের সর্দার ও সম্ভ্রান্ত উচ্চ বংশীয়। হজরত আলি মোর্তজা ও মুহাম্মাদ মোস্তফা (সা.)-এর চোখের মণি। -হজরত মাজহারুল হক আকবরবাদী (র.)।
সেরাতুল আসবার গ্রন্থের গ্রন্থগার হজরত মাওলানা আব্দুর রহমান চিশতি (র.) লিখেছেন : আল্লাহ সুবহানাহুতায়ালা হজরত আব্দুল কাদের জিলানী (র.)কে মহাসম্মানের অধিকারী, কামিলিয়াতের সুউচ্চ মর্যাদা কারামত ও অফুরন্ত নেয়ামত দান করেছেন। তিনি গাউস ও কুতুবের দরজায় উন্নীত হয়ে মাহবুবিয়াতের স্তরে উত্তীর্ণ হয়েছেন। এ অবস্থায়ই বলেছেন ‘কাদমি হাজিহি আলা রাকাবাতি কুলু আউলিয়াল্লাহ’ অর্থ : সব ওলি-আল্লাহর ঘাড়ে আমার ‘কদম’ নবির নিচেই গওসের দরওয়াজা। যারা নায়েবে রাসূল তারা তিন শ্রেণিতে বিভক্ত-গওস, আবদাল ও কুতুব। প্রত্যেকের রয়েছে রুহ ও নফস। আর এ দুটির মাঝে চির দ্বন্দ্ব বিরাজমান। যাদের রুহ নফসের ওপর যতই প্রভুত্ব স্থাপন করতে পারে তারা ততই আল্লাহতায়ালার নিকটতর হতে সক্ষম হন। তাঁর প্রেমে নিমজ্জিত হয়ে শ্রেষ্ঠ সাধকের মর্যাদাপ্রাপ্ত হন। কুতুবুল আকতার, মাহবুবে সোবহানি গাউসুল আজম শেখ সৈয়দ মহিউদ্দীন আব্দুল কাদের জিলানী (র.) ৪৭০ হিজরির (১০৭৭ খ্রিষ্টাব্দ) রমজান মাসের প্রথম দিন জিলান নগরে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৫৬১ হিজরিতে বাগদাদ নগরে নশ্বর জগৎ পরিত্যাগ করেন। সৈয়দ মুসা (র.) ও সৈয়দা ফাতিমা (র.)-এর একমাত্র সন্তান ছিলেন তিনি। পিতার নেসবতে হোসাইনি এবং মাতার নেসবতে হাসানি। মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায় ১৭ পারার হাফেজ হয়ে গিয়েছিলেন। কারণ, তার পুণ্যবতী মাতা ১৭ পারার হাফেজা ছিলেন আর তিনি প্রতিনিয়ত তেলাওয়াত করতেন। এখানে বলে রাখা ভালো, মা-বাবার আমল সন্তানের ওপর বর্তায়। অতি শৈশবকাল থেকে গাউসুল আজম (র.) খুব গম্ভীর ও সংযত স্বভাবের অধিকারী ছিলেন। জ্ঞানস্পৃহা অধিক হওয়ায় ১৮ বছর বয়সে বাগদাদে গমন করেন। অতঃপর ১৩টি ইলমে বিশেষ ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। শিক্ষার্থী অবস্থায় তাকে কঠোর দারিদ্র্যের ও অভাবের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। জ্ঞানার্জনের পর কঠোর পরিশ্রমসহকারে ইবাদতে ও রিয়াজতে মনোনিবেশ করলেন। তিনি লোকালয় ত্যাগ করে মরুভূমি, জঙ্গলে, পোড়োবাড়িতে সাধনায় ও ধ্যানে থাকতে লাগলেন। দীর্ঘ পঁচিশ বছর কঠোর সাধনা করার পর তিনি কামালিয়াত অর্জন করেছিলেন। জাহেরি ও বাতেনি ইলমে পূর্ণতা লাভ করে মৃতপ্রায় ইসলামকে সজীব করে তোলার জন্য আল্লাহ পাকের ইঙ্গিতে আবার বাগদাদে আগমন করলেন। এসে দেখলেন বাগদাদের খলিফাদের বিলাস-ব্যাসন ও আরামপ্রিয়তা এবং প্রজা পালনে শিথিলতার কারণে মুসলমানরা ধর্মের প্রতি উদাসীন হয়ে পড়েছিল। দুনিয়াদার আলেমরা ইসলামকে বিকৃত করে ফেলছিল। ধনী শ্রেণির পরম সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য এবং গরিব শ্রেণির অনাহারক্লিষ্ট জীবন গাউসে পাক (র.)-এর কোমল প্রাণে আঘাত হানল। তিনি রাব্বুল আলামিনের ওপর ভরসা করে তেজোদ্দীপ্ত ও সংস্কারমূলক সংকল্প নিয়ে এ সময় বিভেদ ও কুসংস্কারের মূলে আঘাত করতে লাগলেন। তার স্পষ্টবাদিতার জন্য শুরুতে অনেক রকমের কষ্ট পোহাতে হলো। অসীম ধৈর্য অবলম্বনের মাধ্যমে সব রকমের বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেলেন। তিনি সব রকমের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন। আল্লাহ পাক প্রদত্ত যে গুরুদায়িত্ব তার ওপর অর্পিত হয়েছিল অসীম সাহসিকতার সঙ্গে আল্লাহ পাকের সুমহান বাণী পৌঁছে দিতে লাগলেন। তার চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল পথহারা বিভ্রান্ত মানুষকে সিরাতুল মুস্তাকিমের পথপ্রদর্শন, পাপী, তাপী মানবকুলকে পাপের অতল গহ্বর থেকে উদ্ধার করে আখেরাতের নাজাতের ব্যবস্থা করা। আত্মার রোগে রোগগ্রস্ত ও মৃতপ্রায় লোকদের নতুন প্রাণ সঞ্চার করার লক্ষে তিনি বাগদাদে একটি মাদ্রাসা ও খানকা প্রতিষ্ঠা করেন। এবং সেখানেই তিনি দ্বীনের দাওয়াত শিক্ষা-দীক্ষা দেওয়ার কাজে নিয়োজিত হয়ে পড়েন। খলিফা থেকে আরম্ভ করে কুলি-মজুরসহ সব শ্রেণির লোক তার মজলিসে উপস্থিত হতেন। জ্ঞানী-গুণী আলেম, সুফি দরবেশ এমনকি ইহুদি, খ্রিষ্টান, কাফের, মুশরিকরাও তার মজলিসে বেশ আগ্রহের সঙ্গে যোগদান করতেন। ধনী দরিদ্রের আসন-বসনে কোনো ভেদাভেদ ছিল না। তিনি নির্ভীকচিত্তে স্পষ্ট ভাষায় সবার উদ্দেশে উপদেশ প্রদান করতেন। তার জ্ঞানগর্ভ নসিহতপূর্ণ এবং প্রেমময় ওয়াজ শ্রবণে কেউ মুদিত, কেউ বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যেত। প্রচুর মানুষ তার হাতে তওবা করে মুসলমান হয়। সুদীর্ঘ চল্লিশ বছর তিনি এরূপ নসিহতপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করেছেন। তার মজলিসে লক্ষাধিক লোক উপস্থিত হতো। এটি একটি তার অন্যতম কারামত যে, এই লক্ষাধিক ব্যক্তি সবাই সমানভাবে শুনতে পেত।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক