রবিউল আউয়াল মাসের তাৎপর্য
মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রবিউল আউয়াল খুবই ফজিলত ও বরকতের মাস। অধিকাংশ আলেমের মতে রমজানের পরই রবিউল আউয়ালের মর্যাদা। রমজান মাসের মর্যাদা অধিক হওয়ার কারণ এ মাসে কুরআন নাজিল হয়েছে। আর রবিউল আউয়াল মাসের মর্যাদা অধিক হওয়ার কারণ, এ মাসে নবি করিম (সা.) পবিত্র মক্কা শরিফে ভূমিষ্ঠ হয়েছেন।
বাংলাদেশে এ মাসে সপ্তাহ, পক্ষ ও মাসব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়ে থাকে। প্রিয় নবি (সা.)-এর জন্ম উৎসব হিসাবে ১২ রবিউল আউয়াল বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে সবার জন্য থাকে সাধারণ ছুটি। কেউ কেউ মাসব্যাপী প্রিয় নবি (সা.)-এর জন্ম, বেড়ে ওঠা, নবুয়ত, হিজরত, রাষ্ট্রগঠন, ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, রাজনৈতিক জীবন, আন্তর্জাতিক জীবন, সমাজ সংস্কারসহ জন্ম থেকে ইন্তেকাল পর্যন্ত জীবনের বিভিন্ন দিক ও বিষয় নিয়ে সিরাতুন্নবি শিরোনামে অনুষ্ঠান উদযাপন করে থাকেন।
এ মাসটি তাৎপর্যপূর্ণ হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে-এর প্রথম কারণ হলো বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত নবি করিম (সা.)-এর পৃথিবীতে আগমন। দ্বিতীয় কারণ হলো-এ মাসেই আম্মাজান খাদিজাতুল কুবরা (রা.)কে বিয়ে করেন আল্লাহর রাসূল (সা.)। তৃতীয় কারণ হলো-এ মাসেই মুসলমানদের জন্য প্রথম মসজিদ তৈরি করা হয় কুবা নামক স্থানে এবং এটিই ইসলামের ইতিহাসে নির্মিত প্রথম মসজিদ।
চতুর্থ কারণ হলো-এ মাসে আল্লাহর রাসূল (সা.) প্রিয় মাতৃভূমি মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরত করেন এবং যেদিন তিনি মদিনায়ে পৌঁছান তা ছিল সোমবার ১২ রবিউল আউয়াল। পঞ্চম কারণ হলো-এ মাসেই বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত, হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর ওপর আরোপিত রিসালাতের দায়িত্ব পালন শেষে দ্বীন-ইসলাম পূর্ণতার মাধ্যমে নিজের প্রভুর আহ্বানে সাড়া দেন তিনি।
কুরআন হাদিসে এ মাসের জন্য নির্দিষ্ট কোনো আমল বা ইবাদত পাওয়া যায় না। তবে কিছু আমল আছে অন্যান্য মাসের মতো এ মাসেও করা যায়। যেমন, প্রতি সোমবারে রোজা রাখা। সোমবারে রোজা রাখার ব্যাপারে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে-হজরত আবু কাতাদা (রা.) বলেন, সোমবারের রোজা সম্পর্কে নবি করিম (সা.)কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন, এ দিন আমি জন্মলাভ করেছি এবং এ দিনেই আমি নবুওয়াতপ্রাপ্ত হয়েছি বা আমার ওপর (কুরআন) নাজিল করা হয়েছে। (মুসলিম, হাদিস, ১১৬২)।
অন্য হাদিসের মধ্যে এসেছে, আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার (আল্লাহতায়ালার দরবারে) আমল পেশ করা হয়। আমার আমলগুলো রোজা অবস্থায় আল্লাহর সামনে পেশ করা হোক এটাই আমি পছন্দ করি। (তিরমিজি, হাদিস, ৭৪৭)। এছাড়া প্রতি চন্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে আইয়ামে বিজের তিনটি রোজা রাখার কথা এসেছে হাদিসে। এর প্রতি যত্নশীল হওয়া যেতে পারে। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আ’মর ইবনে আ’স (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘প্রতি মাসে তিনটি করে সিয়াম পালন, সারা বছর ধরে সিয়াম পালনের সমান।’-(বুখারি, ১১৫৯, ১৯৭৫)।
পরিশেষে বলতে চাই, মানবজাতির সচেতন প্রত্যেক ব্যক্তিই তাকে জীবনের সব ক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ বলে মনে করেন। আমরাও মনে করি, শান্তি-সম্প্রীতিতে ভরা সমৃদ্ধ দেশ গড়তে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণের কোনো বিকল্প নেই। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে সূরা আহজাবের ২১ নম্বর আয়াতে বলেছেন, ‘তোমাদের জন্য রাসূল (সা.)-এর জীবনে রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ, তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে।’
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনকে আদর্শরূপে গ্রহণ করলে সুফল তারাই পাবেন, যারা আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করেন এবং আখেরাতের প্রতি ইমান রাখেন। উল্লিখিত গুণ অর্জন না করে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবন নিয়ে আলোচনা ও গবেষণা করলে শতভাগ সুফল লাভ করার সম্ভাবনা নেই। মানবজাতির জন্য মুক্তি ও ইসলাম প্রতিষ্ঠার মহান দায়িত্ব দিয়ে আল্লাহতায়ালা হজরত মুহাম্মাদ (সা.)কে দুনিয়াতে প্রেরণ করেছিলেন। একটি নির্দিষ্ট সময় দুনিয়ার জীবনে দায়িত্ব পালনের পর মহান আল্লাহ তার প্রিয় হাবিবকে তার কাছে নিয়ে গেছেন। কিন্তু আল্লাহর নাজিল করা পবিত্র কুরআন ও তার হাবিবের আদর্শ আমাদের মাঝে আজও আছে। কেয়ামত পর্যন্ত থাকবে।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, তার উম্মত বলে পরিচয়দানকারী মুসলিম উম্মাহর একটি বিশাল অংশ আজ দিকভ্রান্ত। তারা হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আদর্শ ছেড়ে মনগড়া বিভিন্ন মতবাদের মধ্যে মুক্তি অন্বেষণ করছে। আল্লাহ প্রদত্ত জীবনবিধান ছেড়ে মিথ্যা মরীচিকার পেছনে ছুটে দুনিয়া ও আখেরাত ধ্বংস করছে। গোটা মানবজাতিকে দাঁড় করিয়েছে ধ্বংসের মুখোমুখি। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে আমাদের আরও বেশি বেশি রাসূল (সা.)-এর সিরাত অধ্যয়ন করতে হবে। তার প্রদর্শিত নীতি ও পদ্ধতি অনুসরণ করে ইসলামের বিজয়ের জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।
আর বিশ্বনবি (সা.)-এর অতুলনীয় সুমহান আদর্শ নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন এবং অন্যদের জীবনেও বাস্তবায়নের আহ্বান ও প্রচেষ্টাই মুসলিম উম্মাহর রবিউল আউয়াল মাসের অঙ্গীকার। এটাই হোক, এবারের এ রবিউল আউয়াল মাসের শপথ। মাহে রবিউল আউয়াল মাসের বরকত, রাসূলে আকরাম (সা.)-এর মহব্বত ও পরকালীন নাজাত মহান আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে নসিব করুন! আল্লাহুম্মা আমিন।