Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

ইমাম গাজ্জালির শিক্ষাভাবনা

Icon

শামসীর হারুনুর রশীদ

প্রকাশ: ২৩ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ইমাম গাজ্জালির শিক্ষাভাবনা

ইমাম গাজ্জালি পুরোনো জরাজীর্ণ শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচনা করেন এবং একটি নতুন শিক্ষাব্যবস্থার পরিকল্পনা পেশ করেন। মুসলিমদের মধ্যে যে শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন ছিল, তার মধ্যে দুধরনের ত্রুটি পরিলক্ষিত হচ্ছিল। প্রথমটি হলো-দ্বীনি ও দুনিয়াবি শিক্ষাব্যবস্থা পৃথক ছিল। এর ফলস্বরূপ দিন ও দুনিয়ার মধ্যে পৃথকীকরণ দেখা দেয়। ইসলাম এটিকে ভ্রান্ত মনে করে। দ্বিতীয়টি হলো-শরিয়তের জ্ঞান হিসাবে এমন অনেক বিষয় পাঠ্য তালিকাভুক্ত ছিল, যা শরিয়তের দৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না।

এর ফলে দ্বীন ইসলাম সম্পর্কে জনগণের ধারণা ভ্রান্তিতে পরিপূর্ণ হয়ে যায় এবং কতিপয় অপ্রয়োজনীয় বিষয় গুরুত্ব অর্জন করার কারণে ফিরকাগত বিরোধ শুরু হয়। ইমাম গাজ্জালি এ গলদগুলো দূর করে একটি সুসামঞ্জস্য ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করেন।

গাজ্জালি তার দর্শনে শিক্ষাবিষয়ক ভাবনাকে গুরুত্বসহকারে উপস্থাপন করেছেন। শিক্ষা বিষয়ে তার বিশেষ মতাদর্শ হলো, শিক্ষাকে গতিশীল, পরিবর্তনের মধ্যেও টেকসই এবং নতুন কিছু উদ্ভাবন করার সক্ষম হতে হবে। তিনি সমাজের জন্য যে শরিয়া ব্যবস্থা চালু করেছিলেন, তার লক্ষ্য ছিল, মানুষ যেন তার সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্যসুখ লাভ করতে পারে। এ কারণে তার শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো, মানুষ যেন এমনভাবে জ্ঞান অর্জন করে, যাতে ধর্মীয় নিয়ম-নীতি সুচারুরূপে মেনে পার্থিব ও পরকালীন উভয় জগতে সে সুখী হতে পারে। অন্যান্য পার্থিব লক্ষ্য, যেমন-সম্পদ উপার্জন, সামাজিক অবস্থান বা শক্তি অর্জন এবং জ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা এ সবই মায়াছায়া, যেহেতু এগুলো শুধু ক্ষণস্থায়ী জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত। তার মতে, প্রাকৃতিকভাবে শৈশবকালে শিশুরা বুঝতে পারে না কোন ধরনের কথা বলা উচিত এবং কোনটা উচিত নয়। তাই এ সময় তাদের কোনো পাপ হয় না।

পরিবার, বিশেষত, মা-বাবা তাকে শেখায় কোথায়, কখন, কীভাবে কথা বলতে হয়। শিশুরা পরিবারের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়, সংস্কৃতি শেখে, নৈতিকতা শেখে এবং এমনকি প্রতিবেশ বোঝে তারা পরিবারের মাধ্যমে। সুতরাং শিশুর শিক্ষার জন্য দায় হলো পরিবারের। সেই দায়ের খানিকটা রয়েছে প্রাথমিক শিক্ষালয়ের শিক্ষকেরও। শিশুর তাই প্রধান শিক্ষার বিষয় হবে নৈতিকতা এবং শিক্ষকের প্রধান কাজ হলো তাকে চরিত্রবান করে বেড়ে ওঠার পথ দেখিয়ে দেওয়া। তিনি বলেন, বাল্যকালে অবশ্যই ‘মক্তবে’ (প্রাথমিক শিক্ষালয়) পাঠাতে হবে। এ সময়ে যা সে শিখবে, তা পাথরের মতো হৃদয়ে খোদাই হয়ে থাকবে। মাদ্রাসা বা স্কুলে পড়াশোনার ওপর যাদের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে, তাদের সচেতন হওয়া উচিত যে কীভাবে একটি ছেলের ভেতরগত প্রেরণাগুলোর বিকাশ হয় এবং আগ্রহগুলো এক সময় থেকে অন্য সময়ে পরিবর্তিত হয়।

শৈশবে একটি ছেলের মধ্যে প্রথমে ঘোরাফেরা, খেলাধুলা ও বিনোদনের প্রতি আকর্ষণ জন্মে, তারপর পরিচ্ছন্নতা ও ভালোবাসার অনুভূতি তৈরি হয়। কৈশোরে নারী ও যৌন সম্পর্কে আগ্রহের সূচনা হয়, ২০ বছর বয়সের আগেই নেতৃত্ব ও আধিপত্যের জন্য আকুলতা জাগে এবং এরপর সৃষ্টিকর্তার ভাবনায় সে আনন্দিত হয়। এ পরিবর্তিত আগ্রহগুলো বিবেচনা করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার পাঠ্যবিষয় নির্ধারণ করা উচিত, যেন তা তার অভ্যন্তরীণ প্রেরণার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখে। (মুওয়াসওসাতু আর-রিসালা, ২০তম খণ্ড : ৪৩০-৪০।)

সভ্যতার যাত্রায় ইসলাম আগমনের সঙ্গেই নতুনভাবে ধর্মীয় পরিভাষার সংযুক্তি ঘটে এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তন শুরু হয়। মুসলিম বিশ্বের পরিধি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আরব ও ইসলামি সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়ে। ফলে ভিনদেশি মানুষ, ভাষা, সংস্কৃতি, শিক্ষা ও যোগাযোগমাধ্যমের মধ্য দিয়ে জ্ঞানের পরিসর বাড়তে থাকে। একটা সময় যখন জ্ঞানচর্চায় মুসলিম সমাজে প্রাগ্রসরতা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে, তখন জ্ঞান দুভাবে ভাগ হয়ে যায়। একটা হলো, ‘আরব বিজ্ঞান’। এ বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু ছিল, কুরআন, হাদিস, ফিকহ, আরবি ভাষা এবং সিরাত বা নবিজীবন-সংক্রান্ত বিভিন্ন শাস্ত্রীয় জ্ঞান ও নিয়মতান্ত্রিক পাঠ্যবই। একই সঙ্গে আরেকটি নিয়মানুগ বিজ্ঞান জারি হয়, তা হলো-চিকিৎসাবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, রসায়ন, গণিত, দর্শন ও যুক্তিবিদ্যা। এটাকে বলা হতো ‘অনারবীয় বিজ্ঞান’।

একজন বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষাবিদ হিসাবে গাজ্জালি উভয় ধরনের জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রে সমস্যাবলির প্রতি আগ্রহ লালন করতেন। এসবের ধরন-ধারণ, পদ্ধতি, শ্রেণি ও লক্ষ্যকে সামনে রেখে তিনি মতামত দিয়েছেন। জ্ঞান বা শিক্ষা সম্পর্কে গাজ্জালির মতাদর্শ হলো, সৃষ্টিকর্তার জ্ঞান প্রকাশিত হয় তাঁর নবির মাধ্যমে। শরিয়তের শিক্ষা ধর্মীয় ও পার্থিব উভয় বিষয়কে ধারণ করে। কেননা, জ্ঞান বা শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো মানুষের সত্যিকারের সুখকে সম্পূর্ণরূপে অর্জন করতে সাহায্য করা। তবে তিনি মনে করতেন, অনারবি বা ধর্মনিরপেক্ষ বিজ্ঞানের চেয়ে আরব বা ধর্মীয় বিজ্ঞান উত্তম। কেননা, মানুষ চিরস্থায়ী সুখের চেয়ে পার্থিব সুখকে বেশি গুরুত্ব দিতে পারে না। তার মানে এই নয় যে, ধর্মনিরপেক্ষ বিজ্ঞানকে অবহেলা করা হচ্ছে বরং সমাজে এরও প্রয়োজন রয়েছে। আসলে আল-কিন্দি, আল-ফারাবি, ইবনু আন-নাদিম, ইবনু সিনা ও অন্যান্য আরব দার্শনিক ও বিশেষজ্ঞ যখন অনারবীয় বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধনে ব্যস্ত ছিলেন, তখন গাজ্জালির ভাবনা হয়েছিল, অ্যারিস্টটলের দ্বারা প্রভাবিত এ বিজ্ঞান মুসলিমদের পরকালীন সুখের ভাবনা থেকে দূরে সরিয়ে দেবে। (কাশফু আজ-জুনুন, হাজি খলিফা, ১ম খণ্ড : ২৪৩-৪৫; Fastupdate sheet.)

গাজ্জালি জ্ঞানকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করেছিলেন। প্রথমত ‘প্রকৃতি’ অনুসারে জ্ঞানবিজ্ঞান দুটি ভাগে বিভক্ত; ১. থিওলজি ও ধর্মীয় জ্ঞান। ২. প্রায়োগিক জ্ঞান; যেমন নৈতিকতা, গার্হস্থ্য অর্থনীতি, সমাজনীতি ও রাজনীতি। দ্বিতীয়ত উৎস অনুসারে জ্ঞানের দুই ভাগ; ১. ওহির জ্ঞান, যা নবি-রাসূলদের থেকে প্রাপ্ত; যেমন তাওহিদ বা আল্লাহর একত্ব, ধর্মগ্রন্থ, মৃতের কাফন-দাফনের মতো নির্দিষ্ট ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান এবং নৈতিকতা; ২. যুক্তিসংগত বিজ্ঞান, যা মানুষের যুক্তি ও চিন্তাভাবনার মাধ্যমে উদ্ভাবিত। যেমন গণিত, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ইত্যাদি। তবে গাজ্জালির মতে, ধর্মীয় বিজ্ঞান এবং যুক্তিসংগত বিজ্ঞানের মধ্যে কোনো সংঘর্ষ নেই। একটি হলো প্রাপ্ত জ্ঞান এবং আরেকটি অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান। একটি আরেকটির জন্য অপরিহার্য। (মুওয়াসওসাতু আর-রিসালা, ২০তম খণ্ড : ৪৪০-৫০; ইহয়াউ উলুমুদ্দিন, ইমাম গাজ্জালি।)

লেখক : শিক্ষক ও গবেষক

shamserharun@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম