Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

ইসলামে সংলাপের গুরুত্ব অপরিসীম

Icon

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

প্রকাশ: ০২ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ইসলামে সংলাপের গুরুত্ব অপরিসীম

প্রতীকী ছবি

আল্লাহতায়ালা মানুষকে তার আকৃতি-প্রকৃতি, জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিবেকের দিক থেকে বিপরীতমুখী হরেক রকম করে সৃষ্টি করেছেন। এ কারণে স্বভাবগতভাবেই একজন তার জীবনে আকিদা-বিশ্বাস, চিন্তাচেতনা ও মতের দিক থেকে তার ভিন্ন মতের আরেকজনের সম্মুখীন হতে পারে।

এ অবস্থায় ভিন্ন মতাবলম্বীদের সঙ্গে আচরণ করতে গেলে তার সামনে দুটি রাস্তা খোলা থাকে। প্রথমটি হলো, জোরজবরদস্তি, কঠোরতা ও রূঢ়তার মাধ্যম অন্যকে পরাভূত করা। দ্বিতীয়টি হলো, সংলাপ ও উৎকৃষ্ট পন্থায় যুক্তি-তর্ক পেশ করা। এতে কোনো সন্দেহ নেই, সুস্থ বিবেকের অধিকারী একজন মানুষকে তার স্বভাব-চরিত্র, বিবেক-বুদ্ধি প্রথম পদ্ধতিকে ঘৃণা ও পরিত্যাগ করে দ্বিতীয় পদ্ধতি তথা সংলাপকে অনুসরণ ও তার আশ্রয় গ্রহণের দিকে নিয়ে যাবে। এজন্য সংলাপই হচ্ছে অন্যকে বুঝানোর অন্যতম পথ। এর মাধ্যমে তার আচরণ পরিবর্তন ও সমস্যার সমাধান করতে পারে একমাত্র ইসলাম। আজ সংলাপ শব্দটি বিভিন্ন কারণে আমাদের কাছে সুপরিচিত। চলমান নিবন্ধে ইসলামে সংলাপ ও এর গুরুত্ব নিয়ে আলোকপাত করব।

আল কুরআনে সংলাপ

আল কুরআনুল কারিম সংলাপকে খুব বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। পবিত্র কুরআনে তিন জায়গায় শব্দটি এসেছে। সূরা কাহাফের দুই জায়গায় তথা আয়াত ৩৪ এবং ৩৭, আর সূরা মুজাদালার প্রথম আয়াত। কুরআনে কারিমে সংলাপের বহুমুখী ব্যবহার স্থান পেয়েছে। নিম্নে তার কয়েকটি তুলে ধরা হলো :

ফেরেশতাদের সঙ্গে আল্লাহতায়ালার সংলাপ। (সূরা বাকারা : ৩০-৩৩)। ২. নবি-রাসূলদের সঙ্গে আল্লাহতায়ালার সংলাপ। (সূরা বাকারা : ২৬০)। ৩. নিজ কওমের সঙ্গে নবি-রাসূলদের সংলাপ। (সূরা ইবরাহিম : ৯-১২)। ৪. জান্নাত ও জাহান্নামিদের পারস্পরিক সংলাপ। (সূরা আরাফ : ৪৪)। ৫. পাখির সঙ্গে মানুষের সংলাপ। (সূরা নামল : ২০-২৫)। ৬. নবি-রাসূলদের সঙ্গে আল্লাহতায়ালার সংলাপ, যাতে তিনি শেষ নবির জন্য বাইআ’ত-এর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। (সূরা আল ইমরান : ৮১)। এ জাতীয় বিভিন্ন রকমের সংলাপ পবিত্র কুরআনে স্থান পেয়েছে।

হাদিসে সংলাপ

প্রিয় নবির জীবন চরিত এবং মুখনিঃসৃত হাদিসগুলোর দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, তা সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যকে বাস্তবায়নকারী গঠনমূলক সংলাপ সমৃদ্ধ। এতে বিস্মৃত হওয়ার কিছু নেই। তিনি তো কল্যাণের শিক্ষা আর উন্নত চরিত্র পরিপূর্ণতাদানের জন্য প্রেরিত হয়েছেন। কাজেই সংলাপের ব্যবহার তো তার অমীয় বাণীতে থাকবেই। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে : ১. হাদিসে জিবরাইল, যা হজরত ওমর বিন খাত্তাব (রা.) থেকে বর্ণিত। (মুসলিম : ৯)। ২. হোসাইন বিন ইয়াবুদের সঙ্গে প্রিয় নবির সংলাপ, যা তিনি তাকে ইসলামের প্রতি উদ্বুদ্ধ করার জন্য করেছেন। হুদাইবিয়ার সন্ধি ছিল রাসূল (সা.) সংলাপের চূড়ান্ত রূপ। ইমরান বিন হোসাইন থেকে বর্ণিত : তিনি বলেন, রাসূল (সা.) আমার পিতাকে বলেছেন : হে হোসাইন! একদিনে কতজন মাবুদের ইবাদত কর? আমার পিতা বললেন, সাতজনের। ছয়জন জমিনের, আর একজন আসমানের। রাসূল (সা.) জিজ্ঞেস করলেন : এদের কাকে মনে কর তোমার আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারবে? তিনি বললেন : যিনি আসমানে আছেন তিনি। রাসূল (সা.) বললেন, : হে হোসাইন! তুমি যদি ইসলাম গ্রহণ কর, তাহলে তোমাকে এমন দুটি কথা শেখাব, যা তোমার অনেক উপকার করবে। ইমরান বলেন, হোসাইন ইসলাম গ্রহণ করার পর রাসূলের কাছ থেকে কথা শিখতে চাইলেন। তখন রাসূল (সা.) বললেন, বল-‘আল্লাহুম্মা আলহামানী রুশদী ওয়া আ’য়াজ্জানী মিন শাররি নাফসি’।

সংলাপের প্রয়োজনীয়তা

জাতি এবং সম্প্রদায়ের মধ্যে সংলাপের বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে ইসলাম। মহান আল্লাহতায়ালার বাণীর আলোকেই মূলত তা দেওয়া হয়েছে-‘হে নবি! আপনি আপনার মালিকের পথে মানুষকে প্রজ্ঞা ও সদুপদেশের মাধ্যমে আহ্বান করুন’। (সূরা নহল : ১২৫)। গঠনমূলক সংলাপের মাধ্যমে মানুষকে সত্যের দিকে আহ্বানের জন্য, প্রজ্ঞা এবং সংলাপের আহ্বানের গুরুত্ব বোঝাতে এ আয়াতে কারিমা উম্মতে মুহাম্মাদির প্রতি এক প্রজ্ঞাময় নির্দেশ। আল্লাহর কথা মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে, উত্তম কথার মাধ্যমে সংলাপ চালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি প্রতিটি মুসলিমের জীবনে অনেক মূল্য রাখে। মানুষের সঙ্গে উত্তম আচরণ, একনিষ্ঠ আহ্বান, উত্তম শব্দের ব্যবহার, সংলাপকালে ধৈর্য এবং কোমলতা প্রদর্শন, উত্তম আদর্শের নমুনা দেখিয়ে দ্বীনের সৌন্দর্যকে সমুন্নত করার ভূমিকা অতুলনীয়।

সংলাপের উপকারিতা

অন্যদের সন্তুষ্ট করতে এবং তাদের আচরণকে ভালোর দিকে নিয়ে যেতে সংলাপকে সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম হিসাবে মনে করা হয়। অন্যের মতকে সম্মান দিতে, নিজের ভুল স্বীকার করে নিতে এবং নিজেকে অন্যের সমালোচনা সহ্য করতে অভ্যস্ত করার ক্ষেত্রে সংলাপ কার্যকর ভূমিকা পালন করে। নিয়মতান্ত্রিক সংলাপ আমাদের কাছে সঠিক বিষয়টি পৌঁছে দিতে সাহায্য করে, এমনকি সংলাপকারী নিজেকে সংশোধনের সুযোগ পায়, সে তার চিন্তা এবং সঠিক উপস্থাপনের ক্ষেত্রে উন্নতি লাভ করে। তাকে তার আত্মা এবং তার জিহ্বার নিয়ন্ত্রণ শেখায়। ভারসাম্যপূর্ণ চিন্তা এবং সঠিক ফায়সালা করার যোগ্যতা বৃদ্ধি করে; যা তাকে সর্বোচ্চ মাত্রায় অন্যদের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলে। মানসিক প্রবৃদ্ধি, রাগ সংবরণ, নিজেকে দ্বন্দ্ব, রুদ্রাচরণ ভয়ভীতি ও অস্থিরতা থেকে মুক্ত রাখতে সংলাপের গুরুত্ব অপরিসীম।

আল্লাহর দিকে আহ্বানের ক্ষেত্রে, সত্যের দাওয়াত ও এর সাহায্যে বাতিলকে মেটাতে, একে পরাজিত করতে সংলাপ হচ্ছে সবচেয়ে সফল মাধ্যম। যেমন-মহান আল্লাহ বলেন, বল, ‘হে কিতাবিরা, তোমরা এমন কথার দিকে আস, যেটি আমাদের মধ্যে ও তোমাদের মধ্যে সমান, আমরা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কারও ইবাদত না করি। (সূরা আল ইমরান : ৩ : ৬৪)। মূলত দাওয়াত পুরোটাই সংলাপ। যেমনটি অনেক জ্ঞানীরা বলে থাকেন : আল কুরআন হচ্ছে হক আর বাতিলের মধ্যে ইমানদার আর বেইমানের মধ্যে, উপকারী সত্য কথা আর বিভ্রান্ত অপবিত্র কথার মধ্যে সংলাপধর্মী উৎকৃষ্ট গ্রন্থ।

সংলাপের গুরুত্ব এবং দাওয়াতের ক্ষেত্রে এর উপকারিতা এভাবে প্রকাশিত হয়, সংলাপ হচ্ছে বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক পদ্ধতি, যার মাধ্যমে ইসলামের বিরুদ্ধে যারা কুৎসা রটায়, বিভিন্ন সংশয়-সন্দেহ ছড়িয়ে দিতে চায়, সম্মেলন, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, সভা-সামাবেশ, গ্রন্থ রচনা, লিফলেটের পেছনে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে কুণ্ঠাবোধ করে না, তাদের ভ্রান্তি গোমরাহী দূরীকরণে, সন্দেহ নির্মূলে, সুস্পষ্ট প্রমাণাদি দ্বারা তাদের ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনা উন্মোচনে, সংলাপই হচ্ছে সবচেয়ে সফল কার্যকর মাধ্যম।

চিন্তা সাধনার মধ্যে সমন্বয় সাধনে, ভুল থেকে শুদ্ধকে বের করে নিয়ে আসতে সংলাপই উপযুক্ত প্রক্রিয়া। সংলাপে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকে অন্যের প্রমাণাদির দিকে তাকালেই কেবল এটি সম্ভব। বলা হয়, সুচতুর জ্ঞানী ব্যক্তি কখনো তার শত্রুদেরও প্রশংসা করে। কারণ শত্রুরা যখন তার কোনো ত্রুটির দিকে দৃষ্টি আকৃষ্ট করে, তখন তারা কোনো ভালো নিয়তে নয় বরং তার দোষ রটিয়ে দেওয়ার জন্য খোলাবাজারে তাকে লজ্জা দেওয়ার উদ্দেশ্যে করে থাকে। কিন্তু সে তার ভুল ধরে দেওয়ায় যখন তাদের প্রশংসা করে বসে, এতে ফল হয় উলটো। লোকেরা তার উদারতায় মুগ্ধ হয়। অনেক ক্ষতিকারক জিনিস উপকারী হয়ে ধরা দেয়। এভাবেই কখনো কখনো আল্লাহতায়ালা তার মুমিন বান্দার সেবায় কাফেরকে বরাদ্দ করে দেন। বর্তমান এ সময়ে যখন ইসলামের আলোচনা তুঙ্গে পৌঁছেছে, এর পরিধি বিস্তৃতি লাভ করেছে, এ মুহূর্তে সংলাপের গুরুত্ব আরও অনেক বেশি বেড়ে গেছে।

ইসলামি চিন্তাবিদদের জন্য সময় এসেছে আত্মভোলা অবস্থা পরিহার করার, নিস্তেজতা থেকে বেরিয়ে আসার, তার অনুসারীদের সঙ্গে নিয়ে সব বিরোধীর সঙ্গে সংলাপে বসার। শুধু তাই নয়, বরং যারা শত্রুতা ও হিংসা পোষণ করে, তাদের নিয়েও বসার।

আশা করা যায়, জ্ঞানগর্ভ, গঠনমূলক সঠিক পথনির্দেশক সংলাপ, এমন পরিবেশ সৃষ্টি করবে, দোদুল্যমান ব্যক্তি সন্তুষ্ট হবে, ভীতু প্রশান্তি লাভ করবে, আর বিভ্রান্ত স্থির হবে। এমন হতে পারে, শত্রু এবং বিদ্বেষীও তার শত্রুতা এবং বিদ্বেষ কমিয়ে দেবে।

আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘এটি অসম্ভব কিছু না, আল্লাহতায়ালা তোমাদের এবং যাদের তোমরা শত্রু ভাবাপন্ন দেখছ পরস্পরে বন্ধুত্ব সৃষ্টি করে দেবেন, আল্লাহতায়ালা সবই করতে পারেন, আল্লাহতায়ালা ক্ষমাশীল পরম দয়ালু। (সূরা মোমতাহিনা : ৬০ : ৭)।

সফল ও সার্থক সংলাপ করতে হলে আমাদের সংলাপের মূলনীতি ও আদবগুলো ভালোভাবে জানতে হবে। অভিমত ও বক্তব্য তুলে ধরার ক্ষেত্রে এবং দলিল-প্রমাণ উপস্থাপন, আধুনিক গবেষণার অনুসৃত পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করা। যেমন-দাবির পক্ষে সরাসরি দলিল পেশ করা, দলিলের বিশুদ্ধতার বিষয় বিবেচনায় রাখা ইত্যাদি। এক্ষেত্রে প্রসিদ্ধ একটি মূলনীতি হচ্ছে ‘কোনো বিষয়ে কারও কাছ থেকে বর্ণনা করলে তার বিশুদ্ধতা অপরিহার্য। আর যদি নিজস্ব অভিমত হিসাবে দাবি করা হয়, তাহলে তার পক্ষে দলিল দিতে হবে।

লেখক : গবেষক কলামিস্ট

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম