মুমিনের জন্য নিরন্তন সহযোগী ও হাতিয়ার হচ্ছে দোয়া। দোয়ার মাধ্যমে জীবনে সমৃদ্ধি ও সফলতা আসে। বিপদাপদ দূর হয়ে যায়। পার্থিব এ জীবনে এমন কেউ কি আছে যার কোনো সমস্যা নেই? আছে কি কেউ এমন যার কোনো বিপদাপদ নেই? হতাশা ও দুর্দশা নেই?
মানুষের জীবনে এসব শব্দ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি কোনো না কোনো সমস্যা লেগেই থাকে মানুষের জীবনে। এরই মাঝে তার জীবন তরী বাইতে হয়। ব্যক্তি জীবন থেকে নিয়ে পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যন্ত মানুষের সমস্যা গড়াতে থাকে। কেউ ব্যক্তি জীবন নিয়ে চিন্তিত, কেউ পারিবারিক জীবনে অসুখী, আবার কেউ রষ্ট্রীয় জীবনে বিভিন্ন ঝামেলায় জর্জরিত। এসব হরহামেশাই পরিলক্ষিত হয়।
আল্লাহ বলেছেন, তোমরা আমার কাছে চাও, আমি তোমাদের দেব। দোয়া করলে তা কবুল করব। সমস্যা থাকলে তা সমাধান করে দেব। একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউই মানুষের প্রয়োজন পূরণ করতে পারে না। সমস্যার সমাধান দিতে পারে না। পারে না পরকালে সুখ দিতে ও শাস্তি থেকে মুক্ত করতে। মানুষ চাইতে লজ্জাবোধ করে আর আল্লাহ খালি হাতে ফিরিয়ে দিতে লজ্জাবোধ করেন।
হাদিসে এসেছে, যখন মানুষ কিছু চাওয়ার জন্য দুহাত তোলে, তখন তিনি সে হাত দুটিকে ব্যর্থ ও খালি ফেরত দিতে লজ্জাবোধ করেন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস; ৩২১)। অপর হাদিসে এসেছে, আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেন, দোয়া মুমিনের হাতিয়ার। দ্বীনের স্তম্ভ ও আসমান জমিনের নুর। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৪৬৫)।
দোয়া একটি স্বতন্ত্র ইবাদত। দোয়ার মাধ্যমে বান্দা আল্লাহতায়ালার প্রিয় ও নৈকট্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত হয়। মানুষ মাত্রই ভুল করে, গুনাহ করে। নবিগণ ছাড়া সাধারণ মানুষ ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। তাই ছোট কিংবা বড়, কোনো না কোনো গুনাহে মানুষ লিপ্ত হয়। গুনাহ করা অপরাধ, তবে গুনাহের পর তা মাফের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া না করা আরও মারাত্মক পর্যায়ের অপরাধ। তাই গুনাহ থাকুক বা না থাকুক, প্রয়োজন থাকুক বা না থাকুক, সর্বাবস্থায় আল্লাহর দিকে শরণাপন্ন হওয়া, প্রার্থনা করা একজন প্রকৃত মুমিনের কাজ। মানুষের যাবতীয় প্রয়োজন ছাড়াও সব সময় আল্লাহর কাছে দোয়া করা উচিত। কেননা দোয়াকে ইবাদত বলা হয়েছে। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেন, দোয়া ইবাদতের মগজ। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৩৩৭১)।
দোয়া শক্তিশালী আমলও বটে। এমনকি দোয়া তাকদিরকে পর্যন্ত বদলে দিতে পারে। রাসূল বলেন, দোয়া ছাড়া আর কিছুই আল্লাহর সিদ্ধান্তকে বদলাতে পারে না। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২১৩৯)। সুতরাং ইবাদত হিসাবেও সর্বদা দোয়া অব্যাহত রাখা উচিত। তা না করে উদাসীনতার সহিত জীবন অতিবাহিত করা মোটেও প্রকৃত মুমিনের শান নয়। ইবাদতের মূল উদ্দেশ্য হলো, এর মাধ্যমে আল্লাহর কাছে বিনয় ও নম্রতা প্রকাশ করা। আর তা দোয়ার মাধ্যমেই হয়ে ওঠে।
এখন কথা হলো, আল্লাহর কাছে কী চাব আমরা? এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। বৈধ সব জিনিসই তার কাছে চাওয়া যায়। মানুষের দৈনন্দিন জীবনের যাবতীয় প্রয়োজন ছোট বড় সবকিছুই তার কাছে চাওয়ার অনুমোদন রয়েছে। ব্যক্তিবিশেষ যার যেটা প্রয়োজন সে তা চাবে এটাই স্বাভাবিক। কারও সুস্থতার প্রযোজন, সে রবের কাছে সুস্থতার জন্য দোয়া করবে। কারও চাকরি-বাকরি প্রয়োজন, কারও খাদ্য-পনীয় প্রয়োজন। আবার কেউ পারিবারিক জীবনে অসুখী, সে তার সুখময় জীবনের জন্য দোয়া করবে। কেউ নিঃসন্তান, সে আল্লাহর কাছে নেক সন্তান চাইবে। মোটকথা; ছোট থেকে ছোট কিংবা বড় থেকে বড় সবকিছুই তাঁর কাছে চাওয়ার সুযোগ আছে। হাদিস শরিফে এসেছে, হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেন, তোমাদের প্রত্যেকেই যেন যাবতীয় প্রয়োজনের জন্য তার রবের কাছে চায়। এমনকি জুতার ফিতা ছিঁড়ে গেলে তাও। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস; ৬৩০৪)।
অনেকে বলে থাকে যে, এত এত দোয়া করি তবুও আল্লাহ কবুল করেন না। এটা নিছক বান্দার ভুল ধারণা। আসলে দোয়া কবুল হয়েছে কি হয়নি তা সে বোঝার সক্ষমতা রাখে না। আমরা তো প্রতিনিয়ত কত-শত ইবাদত করি। নামাজ, রোজা, দান-সদকা ইত্যাদি নিয়মিতই করে থাকি। কিন্তু কেউ কি বলতে পারে যে, তার নামাজ কবুল হয়নি। নিশ্চিতভাবে কেউই এমন কথা বলার অধিকার রাখে না। দোয়া কবুল হয়; তবে আমরা তা বুঝতে সক্ষম নই। বান্দার কোনো দোয়াই বৃথা যায় না। হয়তো দোয়ার কার্যকারিতা তাৎক্ষণিক প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করা যায় না; তবে পরোক্ষভাবে তা কার্যকর হয়।
হাদিস শরিফে এসেছে, হজরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেন, যদি কোনো মুসলমান আল্লাহর কাছে দোয়া করে আর তাতে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন কিংবা গুনাহের কিছু না থাকে, তাহলে আল্লাহ তাকে তিনটি বিষয়ের যে কোনো একটি দান করবেন। এক. কাঙ্ক্ষিত বস্তুই তাকে দেবেন। দুই. উক্ত দোয়ার অছিলায় কাঙ্ক্ষিত বস্তুর সমপরিমাণ কোনো বিপদাপদ তার থেকে দূর করে দেবেন। তিন. এর প্রতিদান পরকালের জন্য প্রস্তুত রাখবেন। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, তাহলে তো আমরা বেশি বেশি দোয়া করব। রাসূল বলেন, আল্লাহর দান আরও বেশি। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস; ৩৫৭৩)।
হতে পারে যে দোয়া করেছেন তা আপনার জন্য কল্যাণকর নয় কিংবা এর চেয়ে ভালো কিছু আপনার জন্য অপেক্ষা করছে, বিধায় আপনাকে কাঙ্ক্ষিত বস্তু দেওয়া হয়নি। এজন্য দোয়া করা ছেড়ে দেওয়া যাবে না, বরং প্রতিনিয়ত দোয়া অব্যাহত রাখতে হবে। কিছু হোক না হোক অন্তত ইবাদত হিসাবেও তো সওয়াব পাওয়া যাবে। আমাদের প্রতিটি চাওয়া পূরণ হোক। প্রতিটি দোয়া কবুল হোক রবের দরবারে। রহমের বারিধারায় শিক্ত হোক সবার জীবন।