কুরআন-হাদিসের আলোকে মালিক শ্রমিক সম্পর্ক
জাহেদুল ইসলাম
প্রকাশ: ০৩ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আল্লাহ মানুষকে তৈরি করেছেন শ্রমজীবী হিসাবে। মানুষ কাজ করে নিজেদের জন্য হালাল জীবিকা নির্বাহ করবে এটাই স্বাভাবিক।
আল্লাহতায়ালা কুরআন মাজিদে ঘোষণা করেন, যখন সালাত শেষ হবে, তখন তোমরা জীবিকা নির্বাহের জন্য পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো আর আল্লাহর অনুগ্রহ অনুসন্ধান কর এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফল হতে পার। (সূরা জুমুআ, আয়াত-১০)। অত্র আয়াতে আল্লাহ ফরজ নামাজ আদায়ের পর রিজিকের সন্ধানে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
আমাদের মনে রাখতে হবে, শ্রমিক এবং মালিক দুজনই মানুষ। আল্লাহতায়ালা বলেন, হে মানুষ, তোমরা তোমাদের রবকে ভয় কর, যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন এক আত্মা থেকে। আর তা থেকে সৃষ্টি করেছেন তার স্ত্রীকে এবং তাদের থেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বহু পুরুষ ও নারী। (সূরা নিসা, আয়াত-১)। এখানেই স্পষ্ট, সূচনার দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা দেখি সব মানুষ একই মা-বাবার সন্তান। সেই দিক দিয়ে সব মানুষ পরস্পর ভাই ভাই।
রাসূল (সা.) বলেন, এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। (সহিহ বোখারি, ই.ফা-৬৪৮১)। আল্লাহতায়ালা বলেন, নিশ্চয় মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই। (সূরা হুজুরাত, আয়াত-১০)। সুতরাং, মালিক এবং শ্রমিক যাই হোক, আমরা যদি ইসলামের উপরোক্ত নির্দেশনার দিকে তাকাই, তাহলে মালিক-শ্রমিকের সম্পর্ক হবে আপন ভাইয়ের মতো। বড় ভাই ছোট ভাইয়ের যে সম্পর্ক হয় সেটাই হবে মালিক-শ্রমিকের সম্পর্ক। একজনের ওপর আরেকজনকে প্রাধান্য দিয়ে আল্লাহতায়ালা অনুগ্রহ করেছেন মাত্র।
তিনি বলেন, আর আল্লাহ্ জীবনোপকরণে তোমাদের মধ্যে কাউকে কারও ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। (সূরা নাহল, আয়াত-৭১)। সুতরাং, সেই বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে শ্রমিকের সঙ্গে সুন্দর আচরণ করতে হবে। তার জন্য তা-ই পছন্দ করতে হবে, যা নিজের জন্য পছন্দ করি। তাকে তা খেতে দিতে হবে, যা নিজেরা খেতে পছন্দ করি।
রাসূল (সা.) বলেন, শ্রমিক/তোমাদের অধীনস্থরা তোমাদের ভাই। আল্লাহ তাদের তোমাদের অধীন করেছেন। সুতরাং, যার ভাইকে তার অধীন করেছেন, সে যেন তাকে তা-ই খাওয়ায়, যা সে খায়। সেই কাপড় পরিধান করায়, যা সে পরিধান করে এবং তাকে সামর্থ্যরে অধিক কোনো কাজের দায়িত্ব দেবে না, যদি এমনটা করতে হয়, তাহলে সে যেন তাকে সাহায্য করে (সহিহ বোখারি-৫৬১৭)।
আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) অন্যত্র বলেন, তোমাদের কেউ প্রকৃত মুমিন হবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য তা-ই পছন্দ করবে, যা নিজের জন্য পছন্দ করে। (সহিহ বোখারি, কিতাবুল ইমান, ই.ফা-১২)। সুতরাং, মালিক শ্রমিকের ব্যাপারে এ দৃষ্টিভঙ্গি লালন করলে তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠবে। কাজের সুন্দর পরিবেশ তৈরি হবে। শ্রমিককেও তার কাজের ব্যাপারে আন্তরিক হতে হবে।
মালিকের অবর্তমানে শ্রমিকের ওপর তার সব সম্পদ আমানতস্বরূপ। তাকে আমানতের যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। কাজে ফাঁকি দেওয়া বন্ধ করতে হবে। মালিকের কাজকে নিজের কাজ মনে করে করতে হবে।
হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) দীর্ঘ দশ বছর রাসূলের খেদমত করেছিলেন। এ দীর্ঘ সময়ে রাসূল (সা.)কে বলতে হয়নি, আনাস! এ কাজটি কেন করেছ কিংবা এ কাজটি কেন করনি। এজন্য শ্রমিকদেরও ভালোভাবে নিজের কাজ সম্পন্ন করতে হবে। মালিকরাও শ্রমিকদের সামর্থ্যরে বাইরে কোনো কাজ চাপিয়ে দিতে পারবে না। আল্লাহতায়ালা নিজেই কোনো ব্যক্তিকে তার সামর্থ্যরে বাইরে দায়িত্ব দেন না। (সূরা বাকারাহ, আয়াত-২৮৬)।
তাই, শ্রমিকদের ওপর এমন কাজের বোঝা দেওয়া যাবে না, যা করতে সে অক্ষম। এমন কাজ দিলে তাকে সহযোগিতা করতে হবে। সময় বাড়িয়ে দিতে হবে। মজুরি বাড়িয়ে দিতে হবে। মালিক শ্রেণিকে সব সময় মনে রাখতে হবে, আল্লাহতায়ালা চাইলে আমাকেই শ্রমিক বানিয়ে তাকে আমার মালিক বানাতে পারতেন। আল্লাহতায়ালার এ অনুগ্রহকে স্মরণ করতে হবে।
সুতরাং, নিজের পক্ষে যা অসম্ভব, তা শুধু শ্রমিক হওয়ার কারণে তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। সামর্থ্য থাকার পরও শ্রমিকের প্রাপ্য ও অধিকার প্রদানে টালবাহানা করা যাবে না। আর ছোটখাটো অজুহাতে বেতন-ভাতা ও প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। নবি (সা.) বলেন, যে কাউকে শ্রমিক নিয়োগ দেওয়ার পর তার থেকে কাজ বুঝে নিয়েছে অথচ তার প্রাপ্য দেয়নি। কেয়ামতের দিন আমি তার বিপক্ষে সাক্ষ্য দেব। (সহিহ বোখারি-২২২৭)।
শ্রমিককে তার যথাযথ প্রাপ্য না দেওয়া এবং তার সঙ্গে সুন্দর আচরণ না করার ফলেই মালিক শ্রমিকের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। তাই, মালিক শ্রমিক স্ব স্ব জায়গা থেকে নিজেদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করলে মালিক শ্রমিকের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠবে। ফলে উভয় উপকৃত হবে। মালিক শ্রমিক বৈষম্যও দূরীভূত হবে ইনশাআল্লাহ।