শাওয়াল মাসের ৬ রোজা
মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
প্রকাশ: ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রহমতের মাস ‘রমজান’ আমাদের মাঝ থেকে চলে গেল। প্রতিটি ধর্মপ্রাণ মুসলমান মাত্রই ১২ মাসের মধ্যে এ রমজান মাসের জন্য অপেক্ষা করেন। কারণ এ মাসের রহমত আর বরকতের পরিমাণ বহুগুণ বেশি।
তাছাড়া রোজার পুরস্কার আল্লাহতায়ালা নিজ হাতে প্রদান করবেন। হাদিসে আছে ‘সিয়াম আমারই জন্য এবং এর পুরস্কার আমি নিজেই দান করব।’ (সহিহ বুখারি)।
এক মাসে রোজা রাখার উপহারস্বরূপ আল্লাহতায়ালা আমাদের এত নেয়ামত দেবেন। তাহলে একবার চিন্তা করুন তো, রোজা রাখার কারণে যে ফজিলত ও রহমত আমরা পাই, সেটা যদি বাকি ১১ মাসে পাওয়া যেত, তাহলে কতই না ভালো হতো। কিন্তু ৩৬৫ দিন রোজা রাখা আমাদের পক্ষে সম্ভব না, তাছাড়া আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত কোনো কাজের ভার দেন না।
কুরআনে আছে, ‘আল্লাহ তোমাদের থেকে (বিধান) সহজ করতে চান, আর মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে দুর্বল করে।’ (সূরা নিসা : ২৮)। তাই মন খারাপ বা হতাশ হওয়ার কিছু নেই। রাসূল (সা.)-এর সহজ সমাধান আমাদের দিয়ে গেছেন।
আরবি চান্দ্র বছরের দশম মাস শাওয়াল। হজের মাসের একটিও এ মাস। এ মাস থেকেই হজের উদ্দেশ্যে মুসলিম উম্মাহ পবিত্র নগরী মক্কায় গমন শুরু করেন। এ মাসের প্রথম পবিত্র ঈদুল ফিতর হওয়ায় এ মাসের আমলের বরকতও অনেক বেশি। মহান আল্লাহ মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তাঁরই ইবাদতের জন্য। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘আমি জিন ও মানবজাতিকে একমাত্র আমারই ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি।’ (সূরা জারিয়াত, আয়াত : ৫৬)।
আল্লাহতায়ালার একান্ত ইচ্ছা তাঁর প্রত্যেক বান্দা তাঁর ইবাদত সম্পন্ন করার মাধ্যমে ইহ ও পরকালীন জীবনকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলবে। ইবাদত মূলত দুধরনের। ফরজ ইবাদত; যেমন-নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ইত্যাদি। নফল ইবাদত; যেমন-নফল নামাজ, কুরআন তেলাওয়াত, দরুদ শরিফ, দান-খয়রাত, নফল রোজা রাখা ইত্যাদি। আর মাহে রমজানের শিক্ষা আমরা কিছুটা হলেও অর্জন করতে পেরেছি। রমজানের শিক্ষা থেকে আমরা এতটুকু শিখতে পেরেছি যে তাকওয়া অর্জন করে, পরিপূর্ণভাবে হিংসা-বিদ্বেষ, মারামারি-হানাহানি পরিত্যাগ করে আমরা ভাই ভাই হয়ে গেছি।
রমজান আমাদের শিখিয়েছে আর্তমানবতার সেবায় এগিয়ে আসতে হবে এবং আগামী ১১ মাস আল্লাহর আদেশ-নিষেধ যথাযথ মেনে চলতে হবে। এক মাস রোজা রেখেই যেন বান্দা রোজাকে ভুলে না যায়, সেজন্য প্রতি চান্দ্র মাসের ১৩ থেকে ১৫ তারিখের রোজা, আশুরার রোজা, ৯ জিলহজ আরাফার দিনের রোজাসহ অন্যান্য নফল রোজার বিধান রেখেছে ইসলাম। ফরজ নামাজের কমতিগুলো পোষাতে যেমন নফল নামাজ রয়েছে, তেমনি ফরজ রোজার পরও শাওয়ালের সুন্নত রোজা রয়েছে।
এ নফলগুলো ফরজের ত্রুটিগুলোর ক্ষতিপূরণের জন্য। রোজাদার যদি অনর্থক বাক্যালাপ, কুদৃষ্টি প্রভৃতি কাজ থেকে সম্পূর্ণ বাঁচতে না পারে, তাহলে তার রোজার পুণ্য কমে যায়। আর কমতি পুণ্যকে পূর্ণ করতেই শাওয়ালের ছয়টি রোজা। শাওয়ালের ছয়টি রোজার মাধ্যমে রমজানের রোজার শুকরিয়া আদায় করা হয়। যখন কোনো বান্দার আমল আল্লাহতায়ালা কবুল করেন, তখন তাকে অন্য নেক আমলের তাওফিক দেন।
আমাদের পূর্বসূরিদের অনেকে রমজানের পর ছয় মাস আল্লাহর দরবারে এ জন্য কাঁদত, যেন রমজানে কৃত ইবাদত কবুল হয়। ইবাদত কবুল হওয়ার আলামত হলো আগের অবস্থার উন্নতি হওয়া। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘মৃত্যু পর্যন্ত তোমার রবের ইবাদত করো।’ (সূরা : আল-হিজর, আয়াত : ৯৯)। রাসূল (সা.) নিজেও শাওয়ালের রোজা রাখতেন এবং সাহাবায়ে কেরামদের রাখার নির্দেশ দিতেন।
হজরত আবু আইয়ুব আনসারি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি রমজানের রোজা রাখল, অতঃপর শাওয়ালের ছয়টি রোজা রাখল, সে যেন সারা বছরই রোজা রাখল।’ (মুসলিম : ২/৮২২)। রমজানের ৩০টি রোজার সঙ্গে শাওয়ালের ছয়টি রোজা যুক্ত হলে মোট রোজার সংখ্যা হয় ৩৬টি।
আর প্রতিটি পুণ্যের জন্য ১০ গুণ পুরস্কারের কথা উল্লেখ রয়েছে কুরআনুল কারিমে। তাহলে ৩৬টি রোজার ১০ গুণ হলে ৩৬০টি রোজার সমান (এটি পুরস্কারের দিক থেকে)। অর্থাৎ সারা বছর রোজার সমান সওয়াব হবে। হজরত সাওবান (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘রমজানের রোজা ১০ মাসের রোজার সমতুল্য আর (শাওয়ালের) ছয় রোজা দুই মাসের রোজার সমান। সুতরাং, এ হলো এক বছরের রোজা।’ (নাসায়ি : ২/১৬২)। শাওয়ালের ছয়টি রোজা নারী-পুরুষ সবার জন্যই সুন্নত। মাসের শুরু-শেষ কিংবা মাঝামাঝি সব সময়ই রাখা যায় এ রোজাগুলো।
একনাগাড়ে অথবা মাঝে ফাঁক রেখে পৃথকভাবেও রাখা যায়। শাওয়াল মাসে শুরু করে শাওয়াল মাসে শেষ করলেই হলো। তবে ঈদুল ফিতরের পর শাওয়ালের প্রথম দিকে একসঙ্গে ছয়টি রোজা রাখাই উত্তম। আর রমজানের কাজা রোজা থাকলে প্রথমে কাজা রোজা রাখবে। পরিশেষে, আমরা মাহে রমজানের অনুশীলন বাকি ১১ মাস কাজে লাগাব। মহান আল্লাহ আমাদের তাঁর ইবাদত-বন্দেগি করার তাওফিক দান করুন। আমিন।