রমজানের সাধনা জারি থাকুক বারো মাস
শাহাদত হোসাইন
প্রকাশ: ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রহমত, মাগফিরাত আর নাজাতের মাস মাহে রমজান আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছে। আমাদের কারও জানা নেই আগামী রমজান পর্যন্ত কারা বেঁচে থাকব এ পৃথিবীতে। কাজেই আমরা যারা মাহে রমজান মাস পেয়েছি তারা সত্যিই ভাগ্যবান এবং এ জন্য মহান রবের দরবারে বেশি বেশি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা উচিত।
রমজানের মহান শিক্ষাকে কীভাবে বছরব্যাপী নিজেদের জীবনে লালন করতে পারি সে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা উচিত। দীর্ঘ এক মাসের সিয়াম সাধনায় লব্ধ শিক্ষা যদি বছরের বাকি এগারো মাস নিজেদের জীবনে ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারি তাহলে বোঝা যাবে মাহে রমজানের মৌলিক দাবি আমরা কিছুটা হলেও পারঙ্গম করতে পেরেছি।
মাহে রমজানের মৌলিক বিষয় হলো তাকওয়া বা আল্লাহভীতি। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র রমজানকে অবশ্য পালনীয় করেছেন এবং এর উদ্দেশ্য উল্লেখ করে সূরা বাকারায় বলেছেন- ‘লাআল্লাকুম তাত্তাকুন’ অর্থাৎ ‘তোমরা যেন তাকওয়াবান হতে পার’। এ তাকওয়াবান হওয়া বা আল্লাহভীতি মনোজগতে ধারণ করা প্রত্যেক ইমানদারের জন্য অপরিহার্য। এখানেই মানবজাতির একমাত্র মুক্তি। যার অন্তরে আল্লাহর ভয় থাকবে সে সহজে কোনো পাপ কাজে জড়িত হতে পারে না।
আল্লাহভীতিতে পূর্ণ হৃদয় পৃথিবীর কোনো তাগুতি শক্তিকে ভয় করে না। দ্বীনের পথে যে কোনো বাধা ডিঙাতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করে না। তাকওয়াবান ব্যক্তির আচার-আচরণ, ব্যবসা-বাণিজ্য, লেনদেন, সবকিছু হয় ইসলামি শরিয়তের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ তাই তাকওয়াবান ব্যক্তিদের সমাজ হয় অত্যন্ত সুন্দর সাবলীল। সেখানে থাকে না কোনো হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি, সুদ-ঘুসের ছড়াছড়ি, বেহায়পনা, অনৈতিকতা। সব ধরনের পঙ্কিলতামুক্ত থাকে তাকওয়াবানদের অন্তর।
আত্মশুদ্ধি ও আত্মজাগৃতির জন্য রোজার যে প্রভাব রয়েছে তা অন্য কোনো ইবাদতে সেভাবে প্রকৃষ্ট নয়। মানুষের কুপ্রবৃত্তি ও আবেগের ওপর বিবেককে জয়ী করার যে অনুশীলন মাহে রমজানে আমরা পেয়েছি তা যেন জীবনে চলমান থাকে সেই প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে সর্বাত্মকভাবে। পবিত্র রমজান মাস আমাদের আল্লাহভীতির প্রশিক্ষণ দিয়েছে। জানি না আমরা কতটুকু প্রশিক্ষিত হয়েছি, রমজানের মহামূল্যবান শিক্ষাকে আমরা কতটুকু ধারণ করেছি। সমগ্র বিশ্বের মুসলমান রমজান পালন করেছে।
সারা দিন পানাহার ও জৈবিক চাহিদা থেকে বিরত থেকে মানুষ ইবাদতমুখী হয়েছে। পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের সঙ্গে সঙ্গে নফল ইবাদতের এক বিশাল সুযোগ সমৃদ্ধ এ মাসকে যারা যেভাবে কাজে লাগিয়েছে তারা সেভাবে তাদের জীবনকে ধন্য করেছে। তারাবিহর সালাত, তাহাজ্জুদ, কুরআন তেলাওয়াত, দানস-দকা, জাকাত-ফিতরা, অহেতুক কথা ও কাজ থেকে দূরে থাকা, ঝগড়া বিবাদ থেকে বিরত থাকাসহ বিভিন্ন পুণ্যময় ইবাদত ও কাজের যে একটি সার্বিক চর্চা আমরা এক মাস করেছি তা ফলপ্রসূ হবে যদি রমজানপরবর্তী সময়ে এসব অর্জিত গুণাবলি নিজেদের জীবনে প্রতিফলন ঘটাতে পারি।
পাপ-পঙ্কিলতায় ভরা জীবনের ট্র্যাডিশন ভেঙে মাহে রমজানে যেসব সদাচরণ আমরা চর্চা করেছি তা বছরের বাকি সময় ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। একটি মাসের সিয়াম সাধনার কঠোর অনুশীলনে মুসলিম হৃদয় এখন নব স্পৃহায় উজ্জীবিত। নিজেদের অন্তরাত্মাকে আল্লাহভীতির তরলে এমনভাবে ধৌত করে পরিশুদ্ধ করেছে সেখানে আর পঙ্কিল কোনো জীবাণু থাকার কথা নয়।
যে অন্তরে এতদিন শয়তান নামক শত্রুর অবাধ বিচরণ ছিল, যে অন্তর ছিল হিংসা-বিদ্বেষ আর লোভ-লালসায় ভরপুর তা এখন আল্লাহভীতিতে পরিশীলিত ও পরিশোধিত। এখন আমাদের এ পরিশুদ্ধ অন্তঃকরণে শপথ নিতে হবে মাহে রমজানে যে গর্হিত কাজ আমরা ত্যাগ করেছি এবং সৎ কাজের চর্চা করেছি তা যেন পুরোটা বছর অব্যাহত থাকে। আমাদের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক জীবন, ব্যবসায়িক জীবন, সামাজিক জীবন বা জীবনের অন্যান্য প্রতিটি ক্ষেত্রে যদি আল্লাহভীতিকে লালন করি তাহলে ধীরে ধীরে আমাদের জীবনে বিশাল পরিবর্তন আসবে এবং জীবন হয়ে উঠবে আল্লাহর রঙে রঙিন।
আমরা যদি প্রত্যেকের স্ব-স্ব অবস্থান থেকে চেষ্টা করি তাহলে কিন্তু জীবন আরও অনেক সহজতর ও সুশীল হয়ে উঠতে পারে। রমজান মাস শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি আমাদের অন্তর থেকে আল্লাহভীতি চলে যায়, প্রাত্যহিক জীবন থেকে রমজানের শিক্ষা বা রমজানের যে প্রশিক্ষণ তা চলে যায় তাহলে বুঝতে হবে রমজান থেকে আমরা কিছুই অর্জন করতে পারিনি বা আমাদের প্রচেষ্টায় কোনো ত্রুটি ছিল যার কারণে আল্লাহর কাছে আমাদের ইবাদত হয়তো কবুল হয়নি অর্থাৎ পুরো রমজানের যে প্রশিক্ষণ তা ভেস্তে গেছে। কেননা একটি সাধারণ নিয়ম হলো-যে কোনো কাজের বেলায় আগের কাজের বিশুদ্ধতার ওপর পরবর্তী কাজের সফলতা নির্ভর করে।
ইবাদত বন্দেগির ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য। একটি ভালো বা পুণ্য কাজ কবুল হওয়ার লক্ষণ হলো, পুণ্য কাজের পর আরেকটি পুণ্য কাজ করার সামর্থ্য লাভ করা বা স্পৃহা জাগা। কল্যাণকর কাজে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা প্রত্যেক মুমিন মুসলমানের কর্তব্য এবং এটি মহান আল্লাহর কাছে অতিপ্রিয়। যেমন সহিহ বুখারি শরিফের একটি হাদিসে হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন-‘যে কাজ (সৎ কাজ) কেউ নিয়মিত করে, সেটি আল্লাহতায়ালার কাছে অতীব প্রিয় আমল।’
কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো রমজান মাস আসে আর যায় কিন্তু আমরা রয়ে যাই আগের অবস্থানে। আমাদের জীবনে মৌলিক কোনো পরিবর্তন আসে না। রমজান মাস শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পুরোনো চেহারা আবারও ভেসে ওঠে। আমরা ফিরে যাই আমাদের সেই পঙ্কিল অন্ধকার গলিপথে যা সত্যিই পরিতাপের বিষয়।
একজন মুমিন মুসলমানের জন্য আল্লাহভীতি, ইবাদত-বন্দেগি, সৎ কাজের চর্চা, হারাম-হালাল মেনে চলা, সুদ-ঘুস বর্জন করে চলাসহ যাবতীয় সদ গুণাবলির চর্চা কেবল কোনো মৌসুমভিত্তিক হবে না বরং তা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত চালিয়ে যেতে হবে নিরলসভাবে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কালামুল্লাহ শরিফে আল্লাহ পাকের ঘোষণা-‘তুমি মৃত্যু অবধি তোমার রবের ইবাদত করতে থাক’-সূরা হিজর। তাই আমাদের উচিত ‘মৌসুমি মুসলমান’ না হয়ে প্রকৃত মুসলিম-মুমিন হওয়ার কঠোর সাধনায় জীবনকে পরিচালিত করা, তাহলে আমরা উভয় জিন্দেগিতে সফলকাম হতে পারব ইনশাআল্লাহ।
লেখক : ধর্মীয় নিবন্ধকার