বিশুদ্ধ তওবায় জীবন বদলায়
হাসানুল বান্না অলি
প্রকাশ: ১৫ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আল্লাহতায়ালার কাছে তওবা করলে তিনি তওবা কবুল করে জীবনের সব গুনাহ মাফ করে দেবেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, হে ইমানদারগণ, তোমরা আল্লাহর কাছে তওবা কর, খাঁটি তওবা; আশা করা যায় তোমাদের রব তোমাদের পাপগুলো মোচন করবেন এবং তোমাদের এমন জান্নাতগুলোয় প্রবেশ করাবেন। (সূরা তাহরিম-৮)।
হাদিসেও রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন তওবাকারীকে সুসংবাদ দিয়েছেন এই বলে, যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে তওবা করবে গড়গড়া উঠার পূর্বে, আল্লাহ তার তওবা কবুল করবেন। (সহিহ আল জামে-৬১৩২)। খাঁটি তওবার মানে হলো প্রথম ঐকান্তিকতার সঙ্গে নিজের গুনাহের স্বীকৃতি দেওয়া এবং কৃত গুনাহের জন্য অনুশোচনা করা।
বিষয়টা ভাবতে সহজ মনে হলেও বাস্তবতা ভাবনার মতো সহজ কাজ নয়। গুনাহগুলোর জন্য আল্লাহতায়ালার কাছে মাফ চাওয়া এবং দ্বিতীয়বার এমন গুনাহ না করার জন্য একনিষ্ঠতার সঙ্গে ওয়াদা করা এবং বিভিন্ন নফল নামাজ, নফল রোজা বা আর্থিক ত্যাগ কুরবানির মাধ্যমে নিজের গুনাহের কাফফারা আদায় করা।
পাপ কাজ সংঘটিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দ্রুত সময়ের মধ্যে তওবা করতে হবে। কারণ তওবা করতে দেরি করাটাও পাপ। তওবা করার পর প্রথম কাজ হলো যেখানে থাকলে পাপ কাজে জড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে এমন জায়গা ত্যাগ করা অর্থাৎ পাপের স্থান ত্যাগ করা। শুধু তাই নয় বরং যাদের সঙ্গে থাকলে বা চললে অথবা যারা পাপ কাজে সহযোগিতা করে তাদের কাছ থেকে দূরে চলে যেতে হবে। মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন, আন্তরিক বন্ধুরাই সেদিন একে অপরের শত্রুতে পরিণত হবে, মুত্তাকিরা ছাড়া। (সূরা যুখরুফ-৬৭)।
এমন জিনিস যে জিনিস নিজের কাছে থাকলে পাপ কাজ হওয়ার সম্ভাবনা আছে ওইরকম জিনিসকে নষ্ট করে ফেলা। যদি নিজের কাছে কোনো হারাম জিনিস থাকে তাহলে তা যত দ্রুত সম্ভব নষ্ট করে ফেলা অথবা পুড়িয়ে ফেলা। হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উঠার পূর্বে তওবা করবে, আল্লাহতায়ালা তার তওবা কবুল করবেন। (মুসলিম)।
তবে তওবার শর্ত হচ্ছে প্রথমত অতীত জীবনের সব গুনাহের জন্য অনুতপ্ত হওয়া এবং পুনরায় দ্বিতীয়বার পাপ কাজে ফিরে না যাওয়ার সুদৃঢ় সংকল্প করা। আল্লাহতায়ালা বলেন, তোমরা তোমাদের প্রভুর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। অতঃপর তার দিকে প্রত্যাবর্তন (তওবা) কর। (সূরা হুদ : ৩)।
প্রথমবার শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে কোনো পাপ কাজ হয়ে গেলে তখন আমাদের সতর্ক হতে হবে কারণ, তেমনিভাবে আবার পরে পাপ কাজ সংঘটিত হওয়াটা স্বাভাবিক। মূলত বিষয় হলো যখনই কারও দ্বারা কোনো পাপ কাজ হয়ে যাবে, তখনই যদি সে জন্য অনুতপ্ত হয়, আল্লাহতায়ালার কাছে ওয়াদাবদ্ধ হয়-এ কাজ আর কখনো করবে না, তবে প্রতিবারই আল্লাহতায়ালা ক্ষমা করবেন। আমরা তার গোলাম, বান্দা, তিনি আমাদের প্রতিপালক। আমাদের কাজ হলো ভুল করা এবং সঙ্গে সঙ্গে তাওবা করা আর আল্লাহতায়ালার কাজ হলো আমাদের ভুলগুলো মাফ করে দেওয়া।
পাপ যত বড় হোক, যত বেশি হোক, তার রহমত ও অনুগ্রহ দয়া ও ক্ষমার তুলনায় তা মোটেও বড় নয়। তখন তিনি কোনো বান্দাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেন না। বান্দা যখন তাঁর কাছে তওবা করে ক্ষমা চেয়ে হাত বাড়ায়, তিনি তাতে অত্যন্ত খুশি হন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, হে লোক সকল! তোমরা আল্লাহর কাছে তওবা করো। আমি তো আল্লাহতায়ালার কাছে দৈনিক একশবার তওবা করি। (সহিহ মুসলিম, হাদিস ২৭০২)।
ইমাম গাযযালী (রহ.) বলেছেন, কেউ যখন নিজের সংশোধনের জন্য আগে বাড়তে চায় তখন তার প্রথম কাজ হলো পূর্ণরূপে তওবা করা। অর্থাৎ পেছনের সব পাপের জন্য আল্লাহতায়ালার কাছে মাফ চাওয়া এবং ইসতেগফার করা।
বলা চলে তওবাই হচ্ছে আত্মসংশোধনের প্রথম এবং প্রধান সিঁড়ি। জীবনের গুনাহ মাফ করানোর একমাত্র রাজপথ হলো তওবা। এছাড়া ভিন্ন কোনো পথ আমাদের সামনে খোলা নেই। পৃথিবীর ইতিহাসে যেমন অমার্জিত পাপীদের কথা লেখা আছে তেমনি লেখা আছে পাপহীন নবি-রাসূলদের সোনালি জীবনগাথা। এর মাঝে লেখা আছে আরও কিছু মানুষের কথা যারা অনেক মারাত্মক পাপ করেও আল্লাহর কাছে তওবা করেছে এবং তাদের তওবা কবুল হয়েছে। তারাই হলো আল্লাহতায়ালার কাছে সবচেয়ে প্রিয় মানুষ।
সুতরাং পাপ মোচনের মহৌষধ হচ্ছে তওবা। মানুষ যতই পাপ করুক না কেন, সঠিক পন্থায় তওবা করলে তার পাপ মোচন হবেই হবে। তওবার দ্বারা মুমিনের অন্তর নিষ্পাপ হয় এবং সে প্রবেশ করে অনাবিল শান্তির নিবাস জান্নাতে। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, গুনাহ থেকে তওবাকারী নিষ্পাপ ব্যক্তির মতো হয়ে যায়। (সুনানে ইবনে মাজাহ, ৪২৫০)।
সাহাবিরা হলো উম্মতের আদর্শ। তারা উম্মতের জন্য আকাশের তারাসম। তারাই যখন কোনো ভুল করতেন, সঙ্গে সঙ্গে তারা তার থেকে ক্ষমা পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে যেতেন এবং গুনাহ থেকে পবিত্র হওয়ার জন্য তারা অস্থীর হয়ে যেতেন। যতক্ষণ না এর থেকে ক্ষমার ঘোষণা পেতেন ততক্ষণ পাগলের মতো অস্থির হয়ে থাকতেন। তারা তাদের নিজেদের অপরাধ অকপটে স্বীকার করতেন এবং রাসূল (সা.)-এর দরবারে এসে তা প্রকাশ করতে কোনো ধরনের কুণ্ঠাবোধ করতেন না। আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রা.) থেকে একটি হাদিসে তিনি বলেন, আমরা গণনা করে দেখতাম, আল্লাহ্র রাসূল এক বৈঠকে ১০০ বার এ বাক্য পাঠ করেছেন। হে আমার রব! আমাকে মাফ করে দাও! আমার তওবা কবুল করো! নিশ্চয়ই তুমি তওবা কবুলকারী ও পরম দয়ালু। (সহিহ আবু দাউদ-১৫১৬)।
তওবা যেমন আমাদের পরকালকে সমৃদ্ধ করতে পারে ঠিক তেমনি আমাদের দুনিয়ার জীবনকেও সুন্দর করতে পারে। তাওবা কেবল পাপ থেকে মুক্তির জন্য নয় বরং তওবা আমাদের বিপদ ও সংকট থেকেও মুক্তির অন্যতম হাতিয়ার। সহজ কথা, আল্লাহতায়ালার কাছে তওবা করে কেউ যদি নিজের পাপগুলো ক্ষমা করিয়ে নিতে পারে, চোখের পানি ফেলে কেউ যদি নিজেকে ক্ষমাপ্রাপ্ত মানুষের তালিকায় জায়গা করে নিতে পারে, তবে স্বাভাবিকভাবেই সে আল্লাহতায়ালার প্রিয় বান্দায় পরিণত হবে। আর আল্লাহতায়ালার প্রিয় বান্দা যারা, তাঁর রহমত ও দয়া তাদের দুনিয়া-আখেরাত সর্বত্র ঘিরে রাখবেই। তাই যদি হয়, তবে আর ভাবনা কীসের! প্রয়োজন কেবলই পাপের অভিশাপ থেকে মুক্তির।