Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

কালো জীবনে আলো জ্বলে আত্মশুদ্ধির মেহনতে

Icon

তারেক রহমান

প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কালো জীবনে আলো জ্বলে আত্মশুদ্ধির মেহনতে

শুদ্ধ জীবন ও সুন্দর পৃথিবীর জন্য আত্মশুদ্ধি বা তাসাওউফের মেহনত করতে হয়। কুরআন ও হাদিসে পরিশুদ্ধ মুমিনকে সফল মানুষ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

আত্মসমালোচনা, আত্মসমর্পণ ও আত্মপরিচয়ের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি অর্জনের পথ-পদ্ধতি ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে দৈনিক যুগান্তরের মুখোমুখি হয়েছেন দেশের প্রতিথযশা আলেম, ইসলামি চিন্তাবিদ পির মাওলানা আব্দুর রহীম ইসলামাবাদী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন-তারেক রহমান

-আত্মশুদ্ধি সম্পর্কে জানতে চাই?

ইসলামাবাদী : পবিত্র কুরআনে আল্লাহতায়ালা আত্মশুদ্ধির কথা বলতে গিয়ে ৭ বার শপথ করেছেন। এত অধিকবার শপথ আত্মশুদ্ধি ছাড়া অন্য আর কোনো কিছুর জন্য করেননি। কুরআনের ৩০ পারার ৯১তম সূরা শামসে আল্লাহতায়ালা আমাদের জীবনের ৭টি গুরুত্বপূর্ণ জিনিসের কসম খেয়েছেন, যথাক্রমে-সূর্য, চাঁদ, দিন, রাত, আসমান, জমিন ও আমাদের নফসের...। আত্মশুদ্ধি কত গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। আল্লাহ কসম খেয়ে বলছেন, ‘যে নিজের আত্মশুদ্ধি করল সে সফল হলো’।

-তাসাওউফ ও আত্মশুদ্ধির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে চাই?

ইসলামাবাদী : তাসাওউফ ও আত্মশুদ্ধি অর্থ হলো নিজের সংশোধন বা সুনির্দিষ্ট পথ ও পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমে নিজেকে খাঁটি করা বা পরিশুদ্ধ করা। সব ধরনের অনৈসলামিক কথা ও কাজ থেকে অন্তরকে মুক্ত ও নির্মল রাখা। এ তাসাওউফ বা আত্মশুদ্ধির উদ্দেশ্য হলো, গাফিলতি ও উদাসীনতার পর্দা দূর করে মুমিনের অন্তরে ইমানি নুর পয়দা করা। সে নুরের আলোতে চলাফেরা ও ওঠা-বসা। সর্বদা আল্লাহর জাতের ভয় অন্তরে জাগ্রত রাখা। আর আত্মার জন্য অর্জন করার মতো যত গুণ-বৈশিষ্ট্য আছে তার সবই অর্জন করা।

সব ধরনের আত্মার ব্যাধিগুলো থেকে মুক্ত হয়ে এগুলোকে নির্মূল করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো। যাতে করে এসবের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় এবং ‘আল্লাহর ইবাদত এভাবে কর যেন তুমি তাকে দেখছ। যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে অন্তত এ কল্পনা কর যে, স্বয়ং আল্লাহ তোমাকে দেখছেন’। [মুসলিম : ১/২৭] এ সক্ষমতা অর্জন করা। তাসাওউফ ও তাজকিয়ার যাবতীয় মেহনতের আসল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এটাই।

- অনেক পির আছেন যারা তাসাওউফ ও আত্মশুদ্ধির কথা বলেন-শুধুই নির্ধারিত কিছু জিকির-আজকার করেন। কিন্তু নৈতিক ও আত্মিকভাবে তাদের খুব একটা উন্নত মনের হয় না? আপনি কী বলবেন?

ইসলামাবাদী : নির্ধারিত কতিপয় জিকিরের তালিম ও অন্যান্য আমল তাসাওউফের আসল উদ্দেশ্য নয় এবং শরিয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে ওয়াজিব, ফরজও নয়; বরং এসব বিশেষ পদ্ধতি ও আমল মূলত আত্মিক রোগ দূর করার চিকিৎসা ও তদবির মাত্র। যা একজন শায়খে কামিল ও হক্কানি পির সাহেব তার মুরিদদের অবস্থা ও প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে বলে দিয়ে থাকেন। এখন যদি কোনো ব্যক্তি এগুলোকেই আসল মনে করে বসে এবং চূড়ান্ত উদ্দেশ্য নিজের চরিত্র সংশোধন ও আত্মশুদ্ধি থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়, তাহলে নিশ্চয় সে ভ্রান্তিতে রয়েছে এবং তাসাওউফ ও তাজকিয়ার প্রকৃত হাকিকত থেকে একদম বেখবর।

- সত্যিকারের মুমিন হওয়ার পথে আত্মশুদ্ধি কতটা সহায়ক বলে মনে করেন?

ইসলামাবাদী : হ্যাঁ সত্যিকারের মুমিন হওয়া যায় আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে। আত্মশুদ্ধির চর্চা মানুষকে মানবিক ভুলত্রুটি থেকে মুক্ত থাকতে সাহায্য করে। মানুষের মধ্যে যে হীনমন্যতা থাকে তা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার সর্বোৎকৃষ্ট পথ হলো আত্মশুদ্ধি। আল কুরআনে বান্দাকে তার নিজের প্রয়োজনে আত্মশুদ্ধির তাগিদ দেওয়া হয়েছে। সূরা ফাতিরের ১৮ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘কেউ যখন আত্মশুদ্ধি করে সে তো তা করে তার নিজের জন্যই।’ আত্মশুদ্ধিকে বলা হয় মানবচরিত্র সংশোধন ও শুদ্ধ পথে নিয়ে যাওয়ার শ্রেষ্ঠতর উপায়। ইবাদতের মূল লক্ষ্য হলো আত্মাকে শুদ্ধ করা। মানুষের মাঝে যেসব খারাপ অভ্যাস রয়েছে, যেসব হীনমন্যতা রয়েছে তা ত্যাগ করা।

নামাজ, রোজা, জাকাতের লক্ষ্য এ ক্ষেত্রে অভিন্ন। মহান আল্লাহ আদম-হাওয়াকে সৃষ্টির পর বেহেশতে ঠাঁই দেন। মানুষ শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে আল্লাহর বারণ অমান্য করে নিষিদ্ধ বৃক্ষের নিকটবর্তী হলে তাদের পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এ সময় হজরত আদম (আ.) তার পাপের জন্য সর্বশক্তিমানের দরবারে বিনীতভাবে ক্ষমা চান। বলেন, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের আত্মার প্রতি জুলুম করেছি। তুমি আমাদের ক্ষমা না করলে এবং আমাদের প্রতি দয়া না করলে অবশ্যই আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ব’ সূরা আরাফ, আয়াত ২৩। মানুষ পাপাচারের মাধ্যমে আত্মাকে কলুষিত করে। আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে আত্মাকে কলুষমুক্ত করা যায়।

আল্লাহর প্রতি ভয় তথা তাকওয়ার গুণ অর্জনের মাধ্যমে আমরা আত্মশুদ্ধির কাক্সিক্ষত পথে যেতে পারি। আল কুরআনের সূরা আশ শামসের ৯ ও ১০ নম্বর আয়াতে মুমিনদের আত্মশুদ্ধিতে উদ্বুদ্ধ করে বলা হয়েছে, ‘সে-ই সফলকাম হবে যে নিজেকে পবিত্র করবে এবং সে-ই ব্যর্থ হবে যে নিজেকে কলুষাচ্ছন্ন করবে।’

-সমাজ বিনির্মাণে আত্মশুদ্ধির ভূমিকা সম্পর্কে আলোকপাত করেন?

ইসলামাবাদী : ভালো মানুষ হওয়ার জন্য আত্মশুদ্ধি অপরিহার্য। সমাজের সব স্তরে শুদ্ধ মানুষই নিরাপদ ও কল্যাণ সমাজ বিনির্মাণ করতে পারে। বিশেষত সমাজের দায়িত্বশীল, ক্ষমতাশীল ও প্রভাব-প্রতিপত্তিসম্পন্ন লোক যারা সমাজ পরিচালনা করেন, তাদের আত্মশুদ্ধির প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি এবং সবার আগে। কারণ তাদের ভালো-মন্দের প্রভাব পুরো সমাজে ছড়ায় বা সমাজকে প্রভাবিত করে।

আত্মশুদ্ধির মাধ্যমেই মহানবি (সা.) আদর্শ সমাজ ও কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। হজরত ইবরাহিম (আ.) দোয়া করেছিলেন, ‘হে আমাদের পরোয়ার দেগার! তাদের মধ্যে থেকেই তাদের কাছে একজন রাসূল প্রেরণ করুন, যিনি তাদের কাছে আপনার আয়াতগুলো তিলাওয়াত করবেন, তাদের কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেবেন এবং তাদের তাজকিয়া বা পবিত্র করবেন’ (সূরা-২ বাকারা, আয়াত: ১২৯)।

- পির-মুরিদি ও বাইয়্যাতের হাকিকত কী?

ইসলামাবাদী : হজরত থানভী (রহ.) বলেন, বাইয়্যাত ও পির-মুরিদির হাকিকত বা বাস্তবতা হলো, পির সাহেব তার মুরিদকে জিকির ও আল্লাহর হুকুম বলে দেওয়ার ওয়াদা করেন আর মুরিদ এ কথার স্বীকারোক্তি করে যে, তার পির সাহেব যা বলবেন, সে তা অবশ্যই পালন করবে। মুরিদ হওয়ার প্রচলিত পদ্ধতির বাইরেও পির সাহেব তালিম দিতে পারেন এবং মুরিদ তার তালিম অনুপাতে আমল করতে পারেন।

এভাবে মুরিদ হওয়ার মাঝে এ বৈশিষ্ট্য ও উপকার রয়েছে যে, এতে করে সেই মুরিদের প্রতি পির সাহেবের তাওয়াজ্জুহ বা মনোযোগ অধিক হয়ে থাকে। মুরিদও পির সাহেবের কথা পালনের ব্যাপারে অধিক যত্নশীল হয়ে থাকে। তাসাওউফের ইমামরা বলেন, একজনকেই পির ধরবে এবং নিজের পির সাহেবকে সমকালীন যুগের সব পির সাহেবের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করবে। এতে পির-মুরিদ উভয়ের মাঝে বন্ধন ও সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম