স্বমহিমায় ফিরুক কওমি মাদ্রাসা
তানজিল আমির
প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
কওমি মাদ্রাসা, ফাইল ছবি
ইলম, আমল ও আদব-এ তিন বিষয়ের শিক্ষা ও চর্চাই কওমি মাদ্রাসার মূল বিষয়। অন্য শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে তুলনার ক্ষেত্রে; মানুষ যেসব কারণে মাদ্রাসা শিক্ষাকে গুরুত্ব দেয় তার প্রধানতম কারণ হলো, শিক্ষার পাশাপাশি দীক্ষার চর্চা। একটি ছেলে মাদ্রাসায় বিশেষত কওমি মাদ্রাসায় পড়ে-সমাজের মানুষ ধারণাই করে নেয়, ছেলেটি অন্যদের চেয়ে সভ্যতা-ভদ্রতায় এগিয়ে থাকবে।
এ কারণেই মাদ্রাসা পড়ুয়া কেউ যখন সামান্য ভুলও করে অন্যরা তা মেনে নিতে পারে না। কারণ মাদ্রাসায় পড়ুয়ারা কুরআন-হাদিসের জ্ঞান অন্বেষণ করে, আর এ শিক্ষায় যারা দীক্ষিত হবে-তারা অন্যদের চেয়ে আদব-কায়দায় আলাদা হবে এটিই বাস্তবতা। যুগ যুগ ধরে মাদ্রাসা শিক্ষিত ও আলেমদের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা-ভক্তির পেছনে এটিই মূল নিয়ামক।
কিন্তু হতাশার বিষয় হলো-যুগের অবক্ষয়ের প্রভাবে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের মাঝে দিন দিন আদব-কায়দার বিষয়টি যেন কমে যাচ্ছে। ‘বিগত দিনের চেয়ে আগত দিন ভালো হবে না’ এ কথা সত্য। ব্যক্তি পর্যায়ে কারও কোনো আচরণগত সমস্যা দিয়ে ওই জনগোষ্ঠীকে দোষারোপ করাও উচিত নয়।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, যখন কোনো জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ নিয়মিত এ ধরনের কার্যক্রমে লিপ্ত থাকে এবং তাদের ফেরানোর চেষ্টা করাও যায় না, এমনকি সম্মানহানির ভয়ে ভদ্র মানুষদের চুপ থাকতে হয়, তখন সেটি আর স্বাভাবিক পর্যায়ে থাকে না। বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসার প্রধান দুটি কেন্দ্র, হাটহাজারী ও পটিয়া মাদ্রাসায় বিপথগামী কিছু ছাত্রদের অসভ্য আচরণের পর খোদ মাদ্রাসাসংশ্লিষ্টরাই ছাত্রদের বেয়াদবি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন।
চলতি সপ্তাহে পটিয়া মাদ্রাসায় কিছু ছাত্রের শিক্ষকদের সঙ্গে বেয়াদবি ও তাণ্ডবের পর এখন অনেকেই বলা শুরু করেছেন-২০২০ সালে হাটহাজারী মাদ্রাসার তাণ্ডবের বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ না করাতেই এরা এমন সাহস পেয়েছে।
অন্য শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা কার্যক্রমের পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এখানে সব কিছুই ওস্তাদ-সাগরিদ ঘিরে পরিচালিত হয়। এক সময় বিভিন্ন ওস্তাদদের বাড়ি গিয়ে কোনোরকম খেয়ে না খেয়ে পড়াশোনা করতে হতো। মাদ্রাসাকেন্দ্রিক অবকাঠামো গড়ে ওঠার পরও, প্রিয় ওস্তাদের ব্যক্তিগত বিভিন্ন কাজও ছাত্ররা নিজ থেকে করতেন।
এমনকি এ নিয়ে ছাত্রদের মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতাও হতো। এভাবেই ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে নিবিড় আত্মিক সম্পর্কের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে কওমি মাদ্রাসার কার্যক্রম। এখনো ছাত্ররা শিক্ষকদের সামনে উচ্চস্বরে কথা বলতে ইতস্তত বোধ করে। কিন্তু এ ধারায় গড়ে ওঠা ছাত্ররাই যখন মাইক হাতে নিয়ে শিক্ষকের নাম ধরে গালাগাল করে-ভাবুন তো বিষয়টি তখন কোন পর্যায়ে দাঁড়ায়।
একটি প্রতিষ্ঠানে নানা কারণে পরিচালক বা শিক্ষকদের প্রতি ছাত্ররা মনোক্ষুণ্ন হতেই পারে, কিন্তু যত মারাত্মক অন্যায় হোক, প্রচলিতধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো বিদ্রোহ-ধর্মঘট করা কওমি মাদ্রাসার আদর্শ নয়। দেওবন্দি ধারায় এ ধরনের প্রক্রিয়া স্বাভাবিক কোনো আচরণ নয়। এটি গুরুতর পর্যায়ের অপরাধ।
ইতিহাসের নিদারুণ বাস্তবতায় দারুল উলুম দেওবন্দসহ ভারত-বাংলাদেশের বিভিন্ন মাদ্রাসায় ছাত্রদের মাধ্যমে এ ধরনের আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু এগুলোকে দুর্ঘটনা এবং অপরাধ হিসাবেই বিবেচনা করা হয়েছে সব সময়। বিভিন্ন মাদ্রাসায় যারা এমন ছাত্র বিদ্রোহের সঙ্গে জড়িত বলে চিহ্নিত হয়, তাদের সব সময়ই ঘৃণার চোখে দেখা হয়েছে। এমনকি তারাও এসব কাজের জন্য গর্ববোধ করেন না, জীবনের একপর্যায়ে এসে তারুণ্যের উত্তাপে কৃত এমন কাজের জন্য নিজেই লজ্জিত হয়।
বাস্তবতা হলো-ওস্তাদ বা মাদ্রাসার সঙ্গে এমন উচ্ছৃঙ্খল আচরণ যারা করে, তারা পবিত্র এ ধারায় টিকে থাকতে পারে না। বঞ্চিত হয় ইলম-আমলের অমিয় সুধা থেকে। দেওবন্দি ধারায় ওস্তাদের সঙ্গে বেয়াদবি বা মাদ্রাসায় বিদ্রোহ চূড়ান্ত পর্যায়ের মারাত্মক অপরাধ। এ ধরনের কার্যক্রমে জড়িতের পূর্বসূরিরা কোনো দ্বীনি কাজের যোগ্যও মনে করতেন না। উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ আলেম শাইখুল হাদিস মাওলানা মুহাম্মাদ জাকারিয়া (র.) এ বিষয়ে বেশ কঠোর ছিলেন। তার জীবনীতে লেখা হয়-‘শুধু মাদ্রাসা মাযাহিরুল উলূম নয়, যে কোনো দ্বীনি মাদ্রাসায় স্টাইক হওয়া শায়েখ অপছন্দ ও ঘৃণা করতেন এবং যেসব ছাত্র স্ট্রাইকের নেতৃত্বদানে অংশ নেয়, তাদের কোনো রকম বিবেচনা, সুধারণা, আস্থা ও কোনো ধর্মীয় সম্মানের উপযুক্ত মনে করতেন না।
সুতরাং তিনি যখন ১৯৭০ সালের মে মাসের মাঝামাঝিতে দারুল উলূম নাদওয়াতুল উলামায় স্ট্রাইক হওয়ার খবর পান, তখন অত্যন্ত মর্মাহত হন, এবং তিনি সেসব ছাত্রের ব্যাপারে কখনো প্রসন্ন হতে পারেননি, যে কোনো মাধ্যমে যাদের স্ট্রাইকে অংশ নেওয়ার সংবাদ পেয়েছেন।
মুসালসালাতের সময়ও অনেক সময় লিখে লাগিয়ে দেওয়া হতো অথবা ঘোষণা করে দেওয়া হতো, যারা কোনো মাদ্রাসায় স্ট্রাইকে অংশ নিয়েছে, তারা এ দরসে অংশ নিতে পারবে না। ইজাজত দেওয়ার বেলায়ও খুব তৎপর থাকতেন, যাতে কোনো ধরনের স্ট্রাইকে অংশ গ্রহণকারী ব্যক্তিকে এ সম্মানে ভূষিত করা না হয়। এমনকি এ জাতীয় ছাত্রদের তিনি মুরিদ করতেও অস্বীকার করতেন। এক জায়গায় তিনি লেখেন, আমি এসব বেয়াদবদের সঙ্গে বাইয়াতের সম্পর্ক একেবারে রাখতে চাই না। (শাইখুল হাদিস মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া : জীবন ও কর্ম ২৩১)।
একজন ছাত্রের জন্য প্রতিষ্ঠানের আইন মেনে পড়াশোনা করা ছাড়া তার কী অধিকার বা দায়িত্ব আছে? মাদ্রাসার কোনো আইন বা শিক্ষক যদি তার ভালো না লাগে তাহলে সে অন্য প্রতিষ্ঠানে চলে যাবে। একজন ছাত্র মসজিদের মাইকে অন্য ছাত্রদের প্রহার করা এবং রক্তাক্ত করার ঘোষণা কোন অদৃশ্য সাহসে দিতে পারে?
মূলত সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের সামনে বিভিন্ন মাদ্রাসায় ছাত্র বিদ্রোহের নামে যা হচ্ছে, এগুলো দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অদৃশ্য শক্তির নিয়ন্ত্রণে, অর্থনৈতিক এবং প্রশাসনিক সহায়তায় করানো হচ্ছে। কওমি মাদ্রাসার শৃঙ্খলা এবং চেইন অব কমান্ড যেন ভেঙে যায় এটিই এর মূল উদ্দেশ্য। এখন মাদ্রাসায় পড়ুয়া অনেক তরুণ নিজেই জানে না, সে কার কণ্ঠে, কার ভাষায় কথা বলছে।
গত কয়েক বছরে আমরা দেখেছি, বাইরে থেকে বিভিন্ন নামে সিন্ডিকেট করে এ চক্র কওমি আলেমদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত অপপ্রচার চালিয়ে আলেমদের ব্যাপারে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি করছে। এমনকি আল্লামা আহমদ শফীর মতো বয়োবৃদ্ধ আলেমের সঙ্গে তার অন্তিম মুহূর্তে বেয়াদবি করেছিল তারা। কওমি আলেমদের এসব নানামুখী ষড়যন্ত্রের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
লেখক : তরুণ আলেম ও চিন্তক