ঐক্যের শক্তিতে বলিয়ান হোক মুসলিম দুনিয়া
মাহমুদ আহমদ
প্রকাশ: ২০ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ইসরাইল কর্তৃক ফিলিস্তিনে চলমান সহিংসতায় নারী, শিশু ও বৃদ্ধসহ অগণিত মানুষ নির্মমভাবে প্রাণ হারাচ্ছে। হতাহতের সংখ্যা বাড়তে থাকায় গাজার হাসপাতালগুলো রোগীর চাপে হিমশিম খাচ্ছে। এমন অমানবিকতা, নিষ্ঠুরতা ও পৈশাচিকতা এর আগে পৃথিবী খুবই কম দেখেছে। এমন আনাচার কখনো ইসলাম সমর্থন করে না।
নিরপরাধ বেসামরিক জনগণের হত্যা বা ক্ষতি সাধন করা ইসলাম ও শান্তির দূত মহানবি (সা.)-এর শিক্ষার সরাসরি লঙ্ঘন। তিনি শিখিয়েছেন, যুদ্ধাবস্থায়ও কোনো নারী, শিশু বা বৃদ্ধকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা বা তাদের ক্ষতি সাধন করা যাবে না। কোনো ধর্মীয় নেতা বা উপাসনালয়েও হামলা করা যাবে না।
এমন পরিস্থিতিতে মুসলমান দেশগুলোর অন্তত তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হওয়া উচিত এবং তাদের কর্ণপাত করা উচিত। তাদের নিজেদের মতপার্থক্যের ঊর্ধ্বে উঠে একতাবদ্ধ হওয়া উচিত।
আহলে কিতাবদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের উন্নতি করার জন্য যদি আল্লাহতায়ালা মুসলমানদের এ আদেশ দিয়ে থাকেন, আল্লাহতায়ালার সত্তার কথা বলে তাদের যেন আহ্বান করা হয়, ‘সেই কথার দিকে এসো, যে বিষয়ে আমরা এবং তোমরা একমত’, তাহলে, মুসলমানরা যারা একই ধর্মের অনুসারী, তাদের অবশ্যই উচিত নিজেদের মতপার্থক্যের ঊর্ধ্বে উঠে নিজেদের মাঝে একতার বন্ধন গড়ে তোলা।
এ বিষয়ে তাদের চিন্তা করা উচিত এবং নিজেদের ঐক্য গড়ে তোলা উচিত। বিশ্ব থেকে অবিচার দূর করার এবং ন্যায়বিচারের অধিকার পরিপূর্ণ করার, আর অত্যাচারিতের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার এটিই একমাত্র পথ। আর এমনটি করতে হলে মুসলমানদের অবশ্যই বিশ্বজুড়ে যারা নিপীড়িত তাদের পক্ষে এক সুরে একটি শক্তিশালী কণ্ঠস্বর উচ্চকিত করতে হবে।
এমন বর্বর ও নিষ্ঠুর হামলা শুধু ফিলিস্তিনিদের ওপরই যে হচ্ছে তা কিন্তু নয় বরং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হচ্ছে। বিশ্বে কেন মুসলমানরা প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হচ্ছে? এর একটাই কারণ, তাহলো মুসলিম আজ শতধাবিভক্ত হয়ে পরস্পর ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত।
মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর পরস্পরের মাঝেই নেই ঐক্য। মুসলমানদের এ অনৈক্যের কারণেই ভ্রাতৃঘাতী দ্বন্দ্ব সংঘাতে লিপ্ত হয়ে পড়তে দ্বিধাবোধ করছে না। মুসলিম বিশ্বের একতাই পারে জাতিগুলোকে শক্তিশালী জাতিতে রূপান্তরিত করতে। আজ যদি সমগ্র বিশ্বের মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ থাকত তাহলে কারও এ সাহস থাকত না মুসলমানদের ওপর এমন নির্মম অত্যাচার করার।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘হে মুমিনরা! তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে (ইসলাম ও কুরআন) ঐক্যবদ্ধভাবে আঁকড়ে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না’ (আলে ইমরান-১০৩)। ‘তোমরা সেসব লোকের মতো হয়ো না, যাদের কাছে স্পষ্ট ও প্রকাশ্য নিদর্শন আসার পরও তারা বিভিন্ন দলে-উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে এবং নানা ধরনের মতানৈক্য সৃষ্টি করেছে, তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি’ (আলে ইমরান-১০৫)।
আজ যদি সবাই পবিত্র কুরআনের শিক্ষা অনুযায়ী একক নেতেৃত্বের অধীনে সমগ্র মুসলিম বিশ্ব চলত তাহলে অবশ্যই মুসলমানরা সর্বত্র মার খেত না। ইসলাম আল্লাহর মনোনিত ধর্ম। তাই ইসলাম মানুষের মনে অসাধারণ গুণের ও মাহাত্ম্যের উন্মেষ ঘটাবে এটাই স্বাভাবিক। প্রকৃতপক্ষে ঘটেছিলও তাই।
সনিষ্ঠ ইসলাম অনুসারীদের মাঝে দেখা গেছে বহু অসাধারণ গুণের ও মাহাত্ম্যের সমাবেশ। একনিষ্ঠ ইসলামের অনুসারীরা হয়েছিল সব অসাধারণ মানবিক, নীতিক ও মহৎ গুণের অধিকারী।
এজন্যই ইসলামের অনুসারী মুসলমানরা সর্বক্ষেত্রে অতি আশ্চর্যজনক সাফল্য লাভ ও সুমহান কীর্তি স্থাপন করে সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে এক অতি গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য। তাদের সে সাফল্য প্রকৃতই অতীব বিস্ময়কর। মুসলমানরা হয়েছিল বিশ্বের অর্ধেকের মালিক। তারা প্রবল প্রতাপ ও শান-শওকতের সঙ্গে শাসন করেছে অর্ধজাহান। শৌর্যবীর্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান, অর্থনীতি প্রকৃতি সব ক্ষেত্রেই তাদের সাফল্য ছিল অতীব চমকপ্রদ। কোনো ক্ষেত্রেই কোনো জাতিই ছিল না তাদের সমকক্ষ। মুসলমানরা বিশ্বে সব ক্ষেত্রেই ছিল শীর্ষস্থানীয়, নেতৃস্থানীয়। যুদ্ধ হতে শুরু করে জীবনের সব ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জনে সক্ষম হওয়ায় তাদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল বিশ্বব্যাপী। সে যুগে মুসলমানরাই দিয়েছিল বিশ্বনেতৃত্ব। অসাধারণ জাতিরূপে, শ্রেষ্ঠতম জাতিরূপে মুসলমানরাই লাভ করেছিল প্রতিষ্ঠা। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের সাফল্য ও খ্যাতি এতই অসাধারণ ছিল যে, তারা আখ্যায়িত হয়েছেন বহু আলংকারিক বিশ্লেষণে, প্রশংসিত হয়েছেন উচ্ছ্বসিতভাবে পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের বড় বড় মনীষী কর্তৃক। বহু অসাধারণ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়ায় মুসলমানরা উন্নতির শীর্ষে পৌঁছেছিল সত্য, তবে একথা বলাই বাহুল্য, পরবর্তীকালে সময়ের সঙ্গে তাল রেখে আরও এগিয়ে যেতে, নিজেদের সে প্রতাপ, প্রতিপত্তি, প্রাধান্য ও বিশ্ব নেতৃত্ব বজায় রাখতে তারা হয়েছিল ব্যর্থ।
এর কারণ কী? শ্রেষ্ঠ জাতি হিসাবে এবং অর্ধ জাহান শাসনের বিশ্বনেতৃত্ব যাদের গৌরবময় ঐতিহ্য, তা আজ কোথায়? আজ এত এত মুসলিম দেশ থাকা সত্ত্বেও কেন পারছে না ইসরাইল ও ফিলিস্তিনিদের মাঝে সংঘাত বন্ধ করতে? কেন পারছে না মুসলমান বিশ্বনেতৃত্ব দান করতে?
এর একমাত্র কারণ হলো-মুসলিম বিশ্বের কোনো একক নেতা নেই। নেতাশূন্য বলেই মুসলমানরা সমগ্র বিশ্বে অপদস্থ হচ্ছে। আজ এ অনৈক্যের কারণেই দেশে দেশে যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই আছে, এ শেষ হওয়ার নয়, যতদিন পর্যন্ত না মুসলিম বিশ্ব এক ইমামের নেতৃত্বে চলবে ততদিন মুসলিম বিশ্বের শান্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব নয়।
আজ সমগ্র বিশ্বে কোটি কোটি মুসলমান রয়েছে ঠিকই কিন্তু তাদের নেই কোনো নেতা, যিনি সবার সমস্যায় পাশে দাঁড়াবেন এবং সমস্যা দূর করার নিঃস্বার্থ চেষ্টা করবেন। কেউ কি আজ বলতে পারে, তাদের এ ধরনের গুণসম্পন্ন নেতা রয়েছে? কোনো মুসলিম সম্প্রদায় আজ এমন নেই যারা বলতে পারবে যে তাদের এমন এক নেতা রয়েছেন, যিনি আমাদের কষ্টে ব্যথিত হন, আমাদের জন্য মহান সৃষ্টিকর্তার দরবারে প্রার্থনা করেন, আমাদের আলো দেখান।
বর্তমান মুসলিম বিশ্বের একক ইসলামি নেতার খুবই প্রয়োজন। একক নেতৃত্ব ছাড়া বিশ্বের মুসলমান মাথা উঠিয়ে দাঁড়ানো কোনো মতেই সম্ভব নয়। সমগ্র মুসলিম বিশ্বের আবার মাথা তুলে দাঁড়ানো খুবই প্রয়োজন।
লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
masumon83@yahoo.com