ইসলামে পথিক ও মুসাফিরের অধিকার
মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
প্রকাশ: ১৩ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
পবিত্র কুরআনের একাধিক স্থানে ‘ইবনুস সাবিল’কে সহযোগিতা করতে বলা হয়েছে। কুরআনে তাদের কেন বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কুরআন-হাদিসের আলোকে বেশিরভাগ আলেমের মতে, ইবনুস সাবিল হলো এমন পথিক, যে এক দেশ বা অঞ্চল ছেড়ে অন্যত্র যায়।
ইবনে জায়েদ (রহ.) বলেন, ‘ইবনুস সাবিল দ্বারা মুসাফির উদ্দেশ্য। চাই সে ধনী হোক বা দরিদ্র, তার কাছে খরচের অর্থ থাকুক বা না থাকুক, সে বিপদগ্রস্ত হোক বা না হোক; শরিয়ত কর্তৃক ঘোষিত তার অধিকার অপরিহার্য’ (তাফসিরে তাবারি : ১৪/৩১)।
পবিত্র কুরআনে আট স্থানে আল্লাহ পথিক ও মুসাফিরদের সাহায্য করার নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘আত্মীয়স্বজনকে দেবে তার প্রাপ্য এবং অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরকেও এবং কিছুতেই অপব্যয় কোরো না’ (সূরা : বনি ইসরাইল, আয়াত : ২৬)।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেন, কিয়ামতের দিন তিন শ্রেণির লোকের প্রতি আল্লাহ দৃষ্টিপাত করবেন না এবং তাদের পবিত্র করবেন না। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। ১. যে ব্যক্তির কাছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি আছে, অথচ সে মুসাফিরকে তা দিতে অস্বীকার করে।
২. যে ব্যক্তি ইমামের হাতে কেবল দুনিয়ার স্বার্থে বাইআত হয়। যদি ইমাম তাকে কিছু দুনিয়াবি সুযোগ দেন, তাহলে সে খুশি হয়, আর যদি না দেন তবে সে অসন্তুষ্ট হয়, ৩. যে ব্যক্তি আসরের সালাত আদায়ের পর তার জিনিসপত্র (বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে) তুলে ধরে আর বলে যে, আল্লাহর কসম, যিনি ছাড়া অন্য কোনো উপাস্য নেই, আমার এই দ্রব্যের মূল্য এত এত দিতে আগ্রহ করা হয়েছে। (কিন্তু আমি বিক্রি করিনি) এতে এক ব্যক্তি তাকে বিশ্বাস করে (তা ক্রয় করে নেয়) (সহিহ বোখারি, হাদিস : ২৩৫৮)। ইসলামি শরিয়ত নফল ও ফরজ দানসহ একাধিক বিষয়ে পথিক ও মুসাফিরের অধিকার ঘোষণা করেছে।
পবিত্র কুরআনে পথিক ও মুসাফিরের প্রতি সদাচারের নির্দেশ দিয়ে বলা হয়েছে, ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে ও কোনো কিছুকে তার শরিক করবে না; এবং মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন, এতিম, অভাবগ্রস্ত, নিকট প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথি, মুসাফির ও তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করবে’ (সূরা : নিসা, আয়াত : ৩৬)।
উল্লিখিত আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসিরবিদরা বলেন, বান্দার হকের ক্ষেত্রে সদ্ব্যবহার হলো নফল দানে মুসাফিরের হক বা অধিকার রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘লোকে কী ব্যয় করবে সে সম্পর্কে তোমাকে প্রশ্ন করে। বলো, যে ধন-সম্পদ তোমরা ব্যয় করবে তা বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন, এতিম-মিসকিন ও মুসাফিরের জন্য’ (সূরা : বাকারা, আয়াত : ২১৫)।
মুমিনরা যুদ্ধলব্ধ যে সম্পদ লাভ করে তাতেও পথিক ও মুসাফিরের অধিকার রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আরও জানিয়ে রাখ যে, যুদ্ধে যা তোমরা লাভ করো তার এক-পঞ্চমাংশ আল্লাহর, রাসূলের, রাসূলের স্বজনদের, এতিম-মিসকিন এবং পথচারীদের যদি তোমরা ইমান রাখ আল্লাহে...’ (সূরা : আনফাল, আয়াত : ৪১)।
ফরজ জাকাতে আল্লাহ পথিক ও মুসাফিরের হক রেখেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘সদকা কেবল নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত ও তৎসংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের জন্য, যাদের মন আকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য, দাসমুক্তির জন্য, ঋণ ভারাক্রান্তদের, আল্লাহর পথে ও মুসাফিরদের জন্য। এটা আল্লাহর বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময় ’ (সূরা : তাওবা, আয়াত : ৬০)। অমুসলিমদের কাছ থেকে প্রাপ্ত সম্পদে মুসাফির ও পথিকের অধিকার আছে।
আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ জনপদবাসীর কাছ থেকে তার রাসূলকে যা কিছু দিয়েছেন তা আল্লাহর, তার রাসূলের, রাসূলের স্বজনদের, এতিমদের, অভাবগ্রস্ত ও পথচারীদের, যাতে তোমাদের মধ্যে যারা বিত্তবান কেবল তাদের মধ্যেই ঐশ্বর্য আবর্তন না করে’ (সূরা : হাশর, আয়াত : ৭)।
খলিফা ওমর ইবনে আবদুল আজিজ (রহ.) তৎকালীন যুগের বিশিষ্ট আলেম ইমাম ইবনে শিহাব জুহরি (রহ.)কে নির্দেশ দেন যেন তিনি তাকে দান-সদকার খাতগুলোর একটি তালিকা তৈরি করে দেন এবং ব্যয়ের পদ্ধতি বাতলে দেন। ইমাম জুহরি (রহ.) ‘ইবনুস সাবিল’ তথা পথিক ও মুসাফির সম্পর্কে লেখেন, ‘আল্লাহ পথচারীর জন্য যে অংশ নির্ধারণ করেছেন তা প্রত্যেক পথের পথচারীর সংখ্যানুপাতে বণ্টন করা হবে।
প্রত্যেক এমন পথিক যার আশ্রয় নেই তাকে আশ্রয় দেওয়া হবে, তার পানাহারের ব্যবস্থা করা হবে যতক্ষণ না সে আশ্রয় ও ঠিকানা খুঁজে পায় অথবা তার প্রয়োজন পূরণ হয়। আর রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলরা নির্ধারিত স্থানে ঘর তৈরি করবেন। যখনই কোনো অসহায় পথিক স্থানটি অতিক্রম করবে, তাকে আশ্রয় দেওয়া হবে, তাকে পানাহার করানো হবে, তার বহনকারী পশুকে খাদ্য দেওয়া হবে, যতক্ষণ না সে পথ চলার সামর্থ্য অর্জন করে’ (আল আমওয়াল, পৃষ্ঠা ৫৮০)।
মুসাফির ও পথিকের সেবা করার যে নির্দেশ কুরআন-হাদিসে এসেছে, তার প্রতিফল ঘটেছে ইসলামি সমাজ ও সভ্যতায়। যুগে যুগে মুসলিম শাসক ও সমাজসেবকরা পথিকদের সেবায় আশ্রয়কেন্দ্রসহ নানা ধরনের সেবাকেন্দ্র গড়ে তুলেছেন।
ইতিহাসবিদ ইবনে সাদ লেখেন, ‘ওমর (রা.) তার শাসনামলে একটি বিশেষ ঘর নির্মাণের নির্দেশ দেন। যার নামকরণ করেছিলেন ‘দারুদ দাকিক’। কেননা সেখানে আটা, ছাতু, খেজুর, কিশমিশ ইত্যাদি প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণ করতেন। কোনো নিঃস্ব বা পথহারা পথিক ও অতিথি উপস্থিত হলে তিনি সেখান থেকে তাকে সাহায্য করেন। ওমর (রা.) মক্কা ও মদিনার মধ্যবর্তী স্থানে পথিকদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করেন। সেখানে পানি সংরক্ষণ করতেন (তাবাকাতে ইবনে সাদ : ৩/২৮৩)।
আল্লামা আবদুল হাই হাসানি (রহ.) ‘জান্নাতুল মাশরিক’ গ্রন্থে গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড সম্পর্কে লেখেন, ‘যা শুরু হয়েছে বাংলাদেশের সোনারগাঁ থেকে এবং শেষ হয়েছে পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের ‘মায়ে নাইলাব’ নামক স্থানে গিয়ে। এ রাস্তার দৈর্ঘ্য চার হাজার ৮৩২ কিলোমিটার। এ মহাসড়কের প্রত্যেক তিন মাইল পর পর স্থাপন করা হয় বিশ্রামাগার বা পথিক নিবাস। যেখানে হিন্দু ও মুসলিমদের জন্য পৃথক খাবারের ব্যবস্থা ছিল। সড়কের দুই পাশে ফলদ গাছ লাগানো হয়, যেন পথিক ফল খেতে পারে এবং ছায়া গ্রহণ করতে পারে (ভারতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতিতে মুসলিম অবদান, পৃষ্ঠা ৪০)।
স্থানীয় ব্যক্তিরা যেমন পথিকের সঙ্গে সদাচার করবে, পথিকও স্থানীয়দের প্রতি কল্যাণকামী হবে। এমনকি স্থানীয়রা সদ্ব্যবহার না করলেও। এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনে একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত পেশ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘অতঃপর উভয়ে চলতে লাগল। চলতে চলতে তারা এক জনপদের অধিবাসীদের কাছে পৌঁছানোর পর তাদের কাছে খাবার চাইল। কিন্তু তারা তাদের মেহমানদারি করতে অস্বীকার করল। অতঃপর সেখানে তারা এক পতনোম্মুখ প্রাচীর দেখতে পেল এবং সে তা সুদৃঢ় করে দিল’ (সূরা : কাহাফ, আয়াত : ৭৭)।
লেখক : গবেষক, কলামিস্ট