Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

এলো রবিউল আউয়াল

Icon

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

প্রকাশ: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

এলো রবিউল আউয়াল

ইসলামি ইতিহাসে রবিউল আওয়াল গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য একটি মাস। ঐতিহাসিক মাস। হিজরি সনের চাকা ঘুরে আবার আমাদের মাঝে উপস্থিত এখন এ মাসটি। রবিউল আওয়াল মাসের চাঁদ আকাশে উঁকি দিতেই বিশ্বময় মুসলমানদের মাঝে নতুন করে এক আন্দোলন শুরু হয়।

রাসূল (সা.)-এর মহাব্বত নতুন করে জাগ্রত হয়। কারণ অধিকাংশ ঐতিহাসিকদের মতানুসারে এ মাসে সাইয়েদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন, খাতামুন নাবিয়্যিন এ ধরাপৃষ্ঠে আগমন করেন, পবিত্র মক্কা থেকে মদিনা মুনাওয়ারা হিজরত করেন এ মাসে, আবার এ মাসেই তিনি আল্লাহতায়ালা প্রদত্ত রিসালাতের সব দায়িত্ব পালন শেষে প্রভুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে পরলোক গমন করেন।

যখনই এ মাসের শুভাগমন হয়, মুসলমানদের অন্তরে স্বাভাবিকভাবে নবি প্রেমের নতুন হাওয়া জাগে, তারা নতুন করে আন্দোলিত হয়। যদিও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্ম তারিখ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মাঝে অনেক মতভেদ রয়েছে, যথাক্রমে : ১২, ৯, ৮ রবিউল আউয়াল। কিন্তু এ মাসের ১২ তারিখ সোমবার রাসূল (সা.) ইন্তেকাল করেছেন, এ বিষয়ে কোনো মতানৈক্য নেই। (আস্ সীরাতুন্ নববিয়া লিমুহাম্মদ ইবনে ইসহাক্ব : ১৫৯, আল্লামা ইদ্রিস কান্দলভী : সীরাতে মুস্তাফা খণ্ড : ১)।

মহানবি হজরত মুহাম্মাদ (সা.)কে ভালোবাসা ও তার প্রদর্শিত পথ অনুযায়ী জীবনযাপন করা ইমানের অংশ। এ প্রসঙ্গে ইমাম বুখারি (রহ.) তার কিতাবে স্বতন্ত্র একটি শিরোনাম এনেছেন, যার অর্থ ‘নবি করিম (সা.)-এর ভালোবাসা ইমানের অঙ্গ’। বিশিষ্ট সাহাবি আনাস (রা.) ও আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত : ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ওই সত্তার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ, তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত কেউ পরিপূর্ণ ইমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ আমি তার কাছে নিজ পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও সব মানুষ হতে প্রিয় না হব’ (বুখারি শরিফ : হা: ১৫, মুসলিম শরিফ: হা: ৪৫, মুসনাদে আহমদ: ১২৪৩)।

কুরআনে কারিমে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, হে নবি! আপনি বলুন, তোমাদের কাছে যদি তোমাদের পিতা-মাতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাইবোন, তোমাদের পত্নী, তোমাদের বংশ, তোমাদের অর্জিত সম্পদ, তোমাদের এমন ব্যবসা যা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় কর এবং তোমাদের বাসস্থান যা তোমরা পছন্দ কর; আল্লাহতায়ালা ও তাঁর রাসূল এবং তাঁর রাহে জিহাদ করা থেকে অধিক প্রিয় না হয়, তাহলে অপেক্ষা কর-আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত। আর আল্লাহ ফাসেক সম্প্রদায়কে হেদায়েত করেন না (সূরা তাওবা : ২৪)।

উল্লিখিত আয়াতে গোটা মুসলিম জাতির প্রতি এ আদেশ দেওয়া হয়েছে যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালোবাসা এমন উন্নত স্তরে রাখা ওয়াজিব, যে স্তরে অন্য কারও ভালোবাসা স্থান পাবে না। তাই যার ভালোবাসা এ স্তরে নেই সে শাস্তির যোগ্য। রাসূল (সা.)কে ভালোবাসার অর্থ রাসূল (সা.)-এর সিরাত আলোচনা করা যেমন পুণ্যের কাজ তেমনিভাবে তার সুরত বা দৈহিক গঠন নিয়ে আলোচনা করাও পুণ্যের কাজ। কিন্তু দৈহিক সুরত নিয়ে আলোচনার মাঝে আমাদের করণীয় কিছু নেই।

শুধু আলোচনার দ্বারা সওয়াব পাওয়া যায়। কারণ শত চেষ্টা করেও আমাদের সুরতকে রাসূল (সা.)-এর সুরতের মতো করা সম্ভব নয়। পক্ষান্তরে তাঁর (সা.) সিরাত নিয়ে আলোচনার দ্বারা সওয়াব পাওয়ার পাশাপাশি অনুরূপ চরিত্র গঠনের আশা করা যায়, যা দুনিয়া ও আখেরাতের সফলতার অন্যতম চাবিকাঠি।

সত্যিকারার্থে রাসূল (সা.)-এর ভালোবাসার অর্থ হলো, তিনি যেসব গুণে গুণান্বিত ছিলেন সেগুলোর চর্চা করা ও নিজের মাঝে সেগুলোর বাস্তবায়ন এবং যেসব বিষয় তিনি পরিহার করেছেন ও পরিহার করতে বলেছেন তা পরিহার করা। এ মর্মে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘রাসূল (সা.)-এর আনীত দ্বীনকে তোমরা আঁকড়ে ধর, আর যা নিষেধ করেছেন তা পরিহার কর’ (আল হাশর : ৭)।

রাসূল (সা.)-এর জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রয়েছে আমাদের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। এ প্রসেঙ্গে আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘তোমাদের মধ্য থেকে যারা পরকালে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের আশা রাখে ও আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মাঝে রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ’ (আল আহযাব : ২১)।

কুরআন ও হাদিসে প্রত্যেকটি বিষয় যেভাবে এসেছে এবং রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম যেভাবে আমল করেছেন বা করতে বলেছেন সেভাবে করা বা মেনে নেওয়ার নামই হলো ইবাদত। এতে কোনো ধরনের বাড়াবাড়ি করাকে শরিয়ত সমর্থন করে না। এমনিভাবে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ভালোবাসার ব্যাপারে তিনি যেভাবে ভালোবাসতে বলেছেন বা সাহাবায়ে কেরামরা যেভাবে ভালোবাসা দেখিয়েছেন সেভাবে ভালোবাসাই হলো ইবাদত। এতে কোনো ধরনের বাড়াবাড়ি করা শরিয়ত সমর্থন করে না।

পাশাপাশি রাসূলুল্লাহ (সা.) এ ব্যাপারে নিষেধও করেছেন। তিনি বলেছেন, খ্রিষ্টানরা যেমনভাবে ঈসা ইবনে মারিয়াম (আ.)-এর ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করেছে, তোমরা তেমনিভাবে আমার ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না। নিশ্চয়ই আমি আল্লাহর বান্দা, অতএব, তোমরা বল আল্লাহর বান্দা এবং তাঁর রাসূল।

এখানে বাড়াবাড়ি করার অর্থ হলো রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যাবলির ক্ষেত্রে অতিরঞ্জন ও সীমালঙ্ঘন করা। যেমন-রাসূল (সা.)কে হাজির-নাজির বলা, তিনি নুরের তৈরি, তিনি গায়েব জানেন, তাঁর নামে কসম খাওয়া, তাঁর নামে মানত করা, তাঁর কাছে দোয়া ও আশ্রয় প্রার্থনা করা আল্লাহর গুণগুলো গুণান্বিত করা ইত্যাদি। এ ধরনের কার্যকলাপ শরিয়তে গর্হিত। তাই এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকবে।

সাহাবায়ে কেরামের নবি প্রেমের অসংখ্য ঘটনা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ আছে। তারা কোনো দিন বাহ্যিক সাজসজ্জা, আড়ম্বরতা, মুখরোচক স্লোগান ও লৌকিকতাপূর্ণ মাসিক বা বাৎসরিক প্রথা হিসাবে রাসূল (সা.)কে ভালোবাসেননি। বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা রাসূল (সা.)-এর জীবনাদর্শ অনুসরণ করেছেন। ভালোবাসার ক্ষেত্রে তাদের মতো সুন্নাতের অনুকরণ ও আদর্শে আদর্শবান হওয়া ইবাদত ও সাওয়াবের কাজ। এ মর্মে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা ইমান আন যেমনি ইমান এনেছেন মানুষরা অর্থাৎ সাহাবারা’ (আল্ বাক্বারাহ : ১৩)।

সুতরাং তাদের ইমান ও আমল অনুযায়ী আমাদের ইমান ও আমল হওয়া বাঞ্ছনীয়। তাদের ইমান ও আমলের প্রতি আল্লাহতায়ালা খুশি হয়ে বলেন, ‘আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট, তারাই আল্লাহর দলের অন্তর্ভুক্ত। যেনে রেখ আল্লাহর দলই সফলকাম হবে’ (আল মহাদালাহ : ২২)। রবিউল আউয়ালের মূল শিক্ষা ও দাবি হলো-জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে আল্লাহর হুকুম ও রাসূল (সা.)-এর সুন্নাতের অনুসরণ ও অনুকরণ। জগতের সব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের ভালোবাসাকে নিজের জীবনে ধারণ করা। আল্লাহতায়ালা একমাত্র তাওফিকদাতা।

লেখক : গবেষক, কলামিস্ট

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম