দুষ্প্রাপ্য ধর্মীয় পাণ্ডুলিপিতে সমৃদ্ধ চবির গ্রন্থাগার
রোকনুজ্জামান
প্রকাশ: ২৫ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
মধ্য যুগের বাংলাসাহিত্যের বিরাট একটি অংশ চট্টগ্রাম অঞ্চলের মুসলিম রচয়িতাদের অবদানে সমৃদ্ধ। তারই কিছু প্রমাণ মেলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) গ্রন্থাগারের দুষ্প্রাপ্য, পাণ্ডুলিপি ও পত্রিকা শাখায়।
এখানে সংরক্ষিত আছে মধ্যযুগের মুসলিম কবি-সাহিত্যিকদের রচনার দুর্লভ সব পাণ্ডুলিপি। বাংলা, আরবি, ফারসি, উর্দু, বর্মি, সংস্কৃত ভাষায় রচিত ৫৬৫টি পাণ্ডুলিপির বিরাট সংগ্রহে সমৃদ্ধ এ গ্রন্থাগার। পাণ্ডুলিপি ছাড়াও এখানে আছে বহু দুষ্প্রাপ্য মুদ্রিত পুস্তক ও প্রাচীন সাহিত্য সাময়িকী।
পাণ্ডুলিপির এ সমাহার গড়ে উঠেছে মূলত বিখ্যাত সংগ্রাহক আবদুস সাত্তার চৌধুরীর সংগ্রহ নিয়ে। তাছাড়া ড. মুঈনুদ্দীন আহমদ খান ও সাহিত্যিক মাহবুবুল আলমের সংগৃহীত পুঁথিও এখানে রয়েছে। এ সংগ্রহ সমৃদ্ধ করতে বিভিন্ন সময় শ্রম দিয়েছেন সৈয়দ আলী আহসান, ইতিহাসবিদ ড. আবদুল করিম ও ড. আনিসুজ্জামানের মতো গুণী ব্যক্তিরা।
এসব পাণ্ডুলিপির মধ্যে তুলনামূলক নতুন আবিষ্কৃত সফর আলী বিরচিত ‘গোলে হরমুজ’ কাব্য। এটি পাওয়া যায় চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থানার ধর্মপুর গ্রামে। এ রোমান্টিক উপাখ্যানটি ১৬০০ থেকে ১৭০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে রচিত বলে অনুমান করা হয়। এ রকম আরেকটি পুঁথি আঠারো শতকের কবি খান গয়াসের ‘বিজয় হামজা’।
এ কাব্যটির অন্য কোনো পাণ্ডুলিপি আর কোথাও সংগৃহীত হয়নি। এটির বর্ণগঠনও অন্যান্য পাণ্ডুলিপির চেয়ে আলাদা। লিপিতে শৈলীগত মুনশিয়ানার ছাপ চোখে পড়ে সহজেই। এছাড়া উনিশ শতকের প্রথমার্ধের কবি চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানার গরদুয়ারার জিন্নত আলীর ‘মনিউল বেদায়াত’ এ সংগ্রহের অন্যতম নিদর্শন।
সপ্তদশ শতকের কবি শেখ চান্দ বিরচিত যোগশাস্ত্রীয় পুঁথি জ্ঞান প্রদীপের একটিমাত্র অনুলিপি চবি গ্রন্থাগারে রয়েছে। হিন্দু পুরাণের চরিত্রের জবানিতে আয়ুর্বেদ শাস্ত্র নিয়ে লেখা উল্লেখযোগ্য মুসলিম কবি সৈয়দ গাজীর ‘হরগৌরীর পুঁথি’ও রয়েছে এ সংগ্রহশালায়। কবি আমিনুদ্দিন বিরচিত ১০০ বছরেরও অধিক প্রাচীন ‘কাইমুল ইসলাম’, ১৭৬৪ সালের কবি সৈয়দ নুরুদ্দিনের পুঁথি ‘রুহুনামা’ ও এ পুঁথিশালার অন্যতম আকর্ষণ।
কবি হামিদ বিরচিত ‘ধর্ম্মবিবাদ’ কাব্যের পাণ্ডুলিপিটি আবিষ্কার ও উদ্ধার করেন সাহিত্যিক মাহবুবুল আলম। এ নামে অন্য কোনো রচয়িতার আর কোনো পাণ্ডুলিপি আবিষ্কৃত হয়নি। এদিক থেকে এ কাব্যের বিশিষ্টতা রয়েছে। কবি আবদুল জলিলের ‘মনেয়াবাদের ইতিবৃত্ত’ কাব্যটিতে প্রাচীন ইতিহাস ও বাস্তব ঘটনা প্রাধান্য পেয়েছে। এটিতে প্রায় ৩০০ বছর আগের নবাবি আমলে সাতকানিয়ার মনেয়াবাদ গ্রামের প্রতিষ্ঠাতা মনাগাজির জীবন ও আঞ্চলিক ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে।
এছাড়া রয়েছে কবি এজাহারের ‘জ্ঞানত্রিশা’ কাব্যের পাণ্ডুলিপি। এতে আরবি হরফগুলোর বৈশিষ্ট্য ও গুণাগুণ পয়ার সুরে বর্ণিত হয়েছে। সাতকানিয়া থানার বিখ্যাত আলেম আবুল খায়ের মোহাম্মদ সমসেরের গদ্যে-পদ্যে রচিত ‘নবি বংশের ইতিবৃত্ত’ও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কারণ এর পাণ্ডুলিপির আর কোনো অনুলিপি পাওয়া যায়নি। কবি আমিন উল্লাহ বিরচিত আলেপ লায়লার পাণ্ডুলিপিটিও কৌতূহলোদ্দীপক।
চবির এ গ্রন্থাগারে আলাওলের বিখ্যাত ‘পদ্মাবতী’র যে একটিমাত্র পাণ্ডুলিপি আছে তাও একটি দুষ্প্রাপ্য নিদর্শন। কারণ এ কাব্যের পূর্ণাঙ্গ পাণ্ডুলিপির নিদর্শন বিরল। এটির লিপিকাল ১৮৬৭ খ্রিষ্টাব্দ। এছাড়া দৌলত উজির বাহরাম খানের ‘লাইলি মজনু’ কাব্যের অসম্পূর্ণ একটি পাণ্ডুলিপি রয়েছে এখানে। এটি অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে কিংবা উনিশ শতকের প্রথম দশকে লিপিকৃত বলে অনুমান করা হয়।
এছাড়া শেখ চাঁদের ‘রসূল বিজয়’, শাহ মোহাম্মদ সগীরের ‘ইউসুফ-জোলেখা’, আরিফের ‘লালমনের কেচ্ছা’, নসরুল্লাহ খোন্দকারের ‘শরীয়তনামার’ মতো দুষ্প্রাপ্য পুঁথিগুলোর ফটোকপিও রয়েছে চবি গ্রন্থাগারের এ সংগ্রহশালায়। আলাওল, শমসের, শাহাদুল্লাহ, বক্সা আলী প্রমুখের কিছু পদাবলীও সংরক্ষিত আছে এখানে।
চবি গ্রন্থাগারের দুষ্প্রাপ্য, পাণ্ডুলিপি ও পত্রিকা শাখার তত্ত্বাবধায়ক আলী আজগর বলেন, আগে অনেকে পুরোনো পাণ্ডুলিপি নিয়ে আগ্রহ দেখাতেন, তবে দিন দিন তা কমছে। বর্তমানে পুঁথি নিয়ে গবেষণা করা শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব একটা নেই। কারণ পুঁথি পড়তে বিশেষ দক্ষতা প্রয়োজন। এছাড়া শিক্ষার্থীরা চাইলে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করে দুষ্প্রাপ্য শাখা থেকে সহায়তা নিতে পারেন।
লেখক : শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়