Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

ভাঙছে পরিবার, বাড়ছে কলহ-সমাধান কোথায়

Icon

নূর আহমাদ

প্রকাশ: ১১ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ভাঙছে পরিবার, বাড়ছে কলহ-সমাধান কোথায়

দিন যতই যাচ্ছে, পারিবারিক সুখ-শান্তি আমাদের জীবন থেকে যোজন যোজন দূরে সরে যাচ্ছে। বৃদ্ধশ্রমের সংখ্যা বাড়ছে।

ডিভোর্স এখন মহামারিতে রূপ নিয়েছে আমাদের দেশে। পারিবারিক খুন-খারাবি এর আগে এতটা ভয়ংকর কখনোই হয়নি। পরকীয়ার বলি হচ্ছে সন্তান। স্বামীকে স্ত্রী আর স্ত্রীকে স্বামী খুন করছে অবলীলায়। বাড়ছে আত্মহত্যা।

মনোবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলেছেন, যে সমাজে পারিবারিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, ওই সমাজে মাদক-আত্মহত্যা-পরকীয়া মহামারির মতো বেড়ে যায়। পারিবারিক ভাঙন, কলহ রোধের ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটির চেয়ারম্যান এবং আউলিয়ানগরের পির সাহেব মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নূর আহমাদ

-পরিবারের আবেদন কি ফুরিয়ে আসছে?

-পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন এবং প্রথম প্রতিষ্ঠান হলো পরিবার। আদম-হাওয়া এ দুজন মানুষের প্রেমময় পরিবার থেকেই আজকের এ বিকশিত সাড়ে সাতশ কোটি মানুষের উন্নত ও আধুনিক পৃথিবী এতটা পথ পেরিয়ে এসেছে। আরও কত বছর পৃথিবী টিকে থাকবে তা আমাদের জানা নেই।

তবে পরিবারের প্রয়োজনীয়তা এবং মানুষের কাছে পরিবারের আবেদন পৃথিবীর শেষ অবধি সেই শুরুর মতোই থাকবে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তাই আল্লাহ প্রদত্ত প্রতিটি ধর্মব্যবস্থায় পরিবারকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে অনেক বেশি। আজকের পৃথিবীতে এমন কোনো ধর্মের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে পরিবারের কথা গুরুত্বের সঙ্গে বলা নেই।

পরিবারের কথা বলা হয়নি এমন ধর্ম অতীতের কোনো কালে থাকার ন্যূনতম যৌক্তিকতাও নেই। রাসূল (সা.) পারিবারিক সম্প্রীতির ব্যাপারে এত বেশি বলেছেন, হাদিস এবং ফিকহ শাস্ত্রে পরিবার নিয়ে আলাদা অধ্যায়, ভলিউমও রয়েছে। কুরআন পরিবার সম্পর্কে সংক্ষেপে বলেছে, কিন্তু মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ কথা বাদ দেয়নি। সূরা নুরসহ বিভিন্ন সূরায় আল্লাহতায়ালা বলেছেন, সামর্থ্যবান নারী-পুরুষের বিয়ে দেওয়াটা জরুরি।

বিয়ের পর পারিবারিক বন্ধন এবং লজ্জাস্থানের হেফাজত রাষ্ট্রীয়ভাবে দেখভালের কথা বলেছে কুরআন। সন্তান গর্ভধারণ, দুধপান, বাবা-মার সঙ্গে ব্যবহার, সন্তানের প্রতি কর্তব্য এবং খুব প্রয়োজন হলে বিচ্ছেদ নিয়ম-কানুন কী হবে তা বিস্তারিত বলেছে কুরআন।

-তার মানে কি মানবপ্রজন্ম টিকিয়ে রাখাই পরিবারের মূল উদ্দেশ্য?

-দার্শনিক গুরু অ্যারিস্টটল বলেছেন, মানুষ পশু-পাখির মতো সাধারণ কোনো প্রাণী নয়। শুধু বংশবিস্তারই মানুষের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। মানুষ সৃষ্টির পেছনের স্রষ্টার অনেক বড় উদ্দেশ্য রয়েছে। আর এ উদ্দেশ্য সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য পরিবারের বিকল্প নেই। পবিত্র কুরআন থেকে আমরা জানতে পারি, মানুষ সৃষ্টির পেছনে আল্লাহতায়ালার উদ্দেশ্য হলো-পরীক্ষা করে দেখা যে, সৎকর্মে কে সবচেয়ে ভালো।

সত্য-সুন্দর আর সৎকর্মের পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য পরিবারের বিকল্প নেই অ্যারিস্টটলও সে কথা স্বীকার করেছেন। আধুনিক বিজ্ঞান প্রমাণ করেছেন, পরিবারের স্পর্শে বেড়ে ওঠা মানুষ অনেক বেশি সুখী, মেধাবী এবং নৈতিক বোধসম্পন্ন হয়ে থাকে। শুধু তাই নয়, বহু জটিল রোগ এবং মানসিক সমস্যার সহজ সমাধানের একমাত্র নাম পরিবার।

পরিবার ছাড়া মানুষ অনেকটা পশুর মতো। অন্যভাবে বলতে গেলে, পশু ও মানুষের মাঝে একটি পার্থক্য হলো, পশুর মাঝে শক্তিশালী পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন নেই; কিন্তু মানুষের মধ্যে আছে।

-হালে অনেকে বলতে চায়, পারিবারিক বন্ধনের প্রয়োজন নেই। এ সম্পর্কে কী বলবেন?

-পশ্চিমা সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী নারী-পুরুষ একে অপর থেকে যৌন সুখ লাভ করে ঠিকই; কিন্তু পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা-মায়া-মমতা তাদের মন নদীতে জাগে না। এর বড় কারণ হলো, পরিবার প্রথাকে তারা দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিতে চায়। তারা বিয়েহীন লিভটুগেদার সংস্কৃতি সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিতে চায়। এতে করে শারীরিক সুখ মিললেও আত্মার প্রশান্তি কিন্তু ধরা দেয় না। বিয়ের উদ্দেশ্য কেবল যৌন সুখ নয়।

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘লিতাসকুনু ইলাইহা’। যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও। আরবি সুকুন বা সাকিনা শব্দের অর্থ প্রশান্তি পাওয়া। তৃপ্তি লাভ করা। পরিবার প্রথা প্রয়োজনীয়তা এবং যৌক্তিকতার এটাই প্রথম এবং প্রধান কথা। শারীরিক তৃপ্তি ও মানসিক প্রশান্তি ছাড়াও পরিবারের আরও দুটো গুরুত্বপূর্ণ উপকারের কথা আল্লাহ বলেছেন। ‘মাওয়াদ্দাহ ওয়া রহমাহ’। আরবি মাওয়াদ্দাহ মানে হলো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, সহমর্মিতা, হৃদ্যতা। আর রহমাহ শব্দের অর্থ দয়া, মায়া, প্রেম।

মানবজীবনে একটি অধ্যায় আসে যখন তার যৌবন ফুরিয়ে যায়, শক্তি কমে আসে, হাসপাতালে ছটফট করে, মৃত্যুর পরোয়ানা মাথার ওপর ঝুলতে থাকে। তখন কিন্তু পরিবারশূন্য মানুষটির পাশে কেউ থাকে না। পৃথিবী থেকে বিদায়ের সময় তার বুক হাহাকারে পূর্ণ হয়ে ওঠে।

চিৎকার করে বলতে চায়, হায়! কোথায় আজ সুখের দিনের বন্ধুরা! সমকালীন একজন সুফি গবেষককে প্রশ্ন করা হলো-কেন বিয়ে এত গুরুত্বপূর্ণ। ইউরোপের একটি তরুণদের সম্মেলনে তিনি এ প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন।

তিনি বললেন, আমি যদিও সুফি গবেষক, কিন্তু আমার পড়াশোনা বেড়ে ওঠা ঘোর নাস্তিকদের মধ্যে। এ ইউরোপের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমি ডিগ্রি নিয়েছি। আমি দেখেছি, একজন নারী যিনি যৌবনে বিয়ের কোনো গুরুত্বই অনুভব করেন না, বিভিন্ন যুক্তি দেখিয়ে বলে বিয়ে করলে এই হয়, সেই হয়, নারীকে শিকলে বন্দি করা হয়, অধিকার ক্ষুণ্ন করা হয় ইত্যাদি ইত্যাদি।

ওই নারীটি যখন চল্লিশ পেরিয়ে পঞ্চাশের কাছাকাছি চলে আসে এবং যৌবনের আবরণ তার দেহ থেকে পড়ে যায়, তখন তাকে সেজেগুজে কোনো মদের দোকানে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয় কোনো ছেলে বন্ধুর মনোযোগ আকর্ষণের জন্য। ছেলেটি তার সঙ্গে যৌনমিলন না করুক অন্তত পাশে বসে কথা বলুক, তার সঙ্গে সময় কাটাক, এজন্য হলেও একজন পুরুষের খুব প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন ওই নারী। এ দৃশ্যটি আমার খুবই খারাপ লাগে।

আমি বহু নারীকে জিজ্ঞেস করেছি, এখন তোমার কী মনে হয় বিয়ে ভালো নাকি উন্মুক্ত যৌনতা ভালো? চোখের পানি ছেড়ে তারা বলত, বিয়ে করলে আজ অন্তত পাশে কেউ না কেউ অবশ্যই থাকত। আমাদের জীবনের চরম ভুল ছিল বিয়ে না করা।

-বিয়ে এত জরুরি কেন?

-বিয়ে করা সবার জন্য জরুরি নয়। আবার বিয়ে না করারও কোনো যৌক্তিক কারণ আজও কেউ দেখাতে পারেননি। তবে আমাদের ধর্ম বিশ্বাস এবং আমাদের নবিজি (সা.) বিয়ের প্রতি যে ধরনের গুরুত্ব দিয়েছেন, তা থেকেই সহজেই বুঝতে পারা যায়, বিয়েহীন সমাজ অন্তত মুসলমানের সমাজ নয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের সমাজ ধীরে ধীরে বিয়েহীন, পরিবারবিমুখ হয়ে পড়ছে। এর নানাবিধ কারণও রয়েছে।

তরুণরা বিয়ের প্রতি যতই বিমুখ হচ্ছে, ব্যভিচারের প্রতি ততই আগ্রহী হচ্ছে। এর পরিণাম বড়ই ভয়াবহ। আল্লাহতায়ালার শাস্তি থেকে বাঁচতে চাইলে, ভেঙে যাওয়া সমাজ ও পরিবারকে আবার দাঁড় করাতে চাইলে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে ধর্মচিন্তকদের।

মুমিনদের বিয়ে নির্দেশ দিয়ে পবিত্র কুরআনে অল্লাহতায়ালা বলেন, ‘ওয়ানকিহুল আয়ামা মিনকুম। ওয়াসসালিহিনি মিন ইবাদিকুম। অর্থ : হে বিশ্বাসী সমাজের বাসিন্দরা! তোদের মধ্যে যেসব যুবক-যুবতী সিঙ্গেল রয়েছে, তাদের বিয়ে দিয়ে দাও এবং তোমাদের যোগ্য দাস-দাসীদেরও বিয়ের ব্যবস্থ করো। (সূরা নুর, আয়াত ৩২।)

একটি পরিশুদ্ধ সমাজের জন্য বিয়ে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা এ আয়াত থেকেও বোঝা যায়। যারা বিয়ে করে না, তাদের ব্যাপারে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন রাসূল (সা.)। বুখারির বর্ণনা থেকে জানা যায়, একজন সাহাবি বিয়ে না করে জীবনভর ইবাদতের সাগরে ডুবে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। রাসূল (সা.) তার এ কথা শুনে ফেলেন।

তিনি প্রচণ্ড রাগ হয়ে বললেন, আরে! তোমাদের সবার চেয়ে বেশি মুত্তাকি আমি। আমি ইবাদতও করি, নারী সঙ্গও করি। এরপর পুরো উম্মতকে উদ্দেশ্য করে রাসূল (সা.) বললেন, ‘আননিকাহু সুন্নাতি। অর্থাৎ বিয়ে হলো আমার সুন্নাত। যারা আমার সুন্নাত পালন করবে, তারা আমার সঙ্গে জান্নাতে থাকবে। আর যারা আমার সুন্নাত ছেড়ে দেবে, তারা আমার উম্মতই নয়। (বুখারি শরিফ, কিতাবুন নিকাহ।)

-আজকাল দরিদ্রতাকে বিয়ের প্রতিবন্ধক মনে করা হয়। ধারণাটা কি আসলেই ঠিক?

-মাওলানা আবদুর রহিম তার বিখ্যাত পারিবারিক জীবন গ্রন্থে লিখেছেন, ইসলামের বিয়ের ব্যাপারে এত গুরুত্ব দেওয়ার পরও অনেক সময় যুবক-যুবতীরা কেবল দারিদ্র্যের অজুহাতে বিয়ে করতে রাজি হয় না। তারা মনে করেন, বিয়ে করলে আর্থিক দারিদ্র্য বেড়ে যাবে।

আর এ দায়িত্ব পালন করতে না পারলে বা আরও বেশি অর্থ উপার্জনের সুযোগ না হলে জীবনমান নিচে নেমে যাবে কিংবা জীবনে বিপর্যয় নেমে আসবে। যুবক-যুবতীদের এ ধরনের চিন্তাচেতনা শরিয়তের আলোকে মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।

বাস্তবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও এসব চিন্তা সঠিক বলে মেনে নেওয়া যায় না। কেননা, মানুষের আয়-রোজগার স্থায়ী বা অপরিবর্তনীয় কোনো বিষয় নয়। যে আল্লাহ আজ একজনকে ৫০ টাকা দিচ্ছেন, কাল সে আল্লাহই তাকে ১০০ টাকা দিতে পারেন।

দারিদ্র্য কিংবা অর্থাভাব যেন বিয়ের পথে বাধা না হয়ে দাঁড়ায়, এজন্য আল্লাহতায়ালা স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন, ‘ইয়ঁইয়াকুনু ফুকারাআ ইউগনিহিমুল্লাহু মিন ফাদলিহি, ওয়াল্লাহু ওয়াসিউন আলিম। অর্থ : যদি যুবক-যুবতীরা দারিদ্র্য হয়, তবে আল্লাহ তাদের নিজ দয়ায় স্বাবলম্বী করে দেবেন। আসলে আল্লাহর মতো বড় দাতা এবং বিজ্ঞ কেউ নেই। (সূরা নুর, আয়াত ৩২।)

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম