Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

হিজরি সন মুসলমানদের গৌরবের স্মারক

Icon

মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাসুম

প্রকাশ: ২১ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

হিজরি সন মুসলমানদের গৌরবের স্মারক

মানবজীবন সময়ের সমষ্টি। সময়কে মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহারোপযোগী করে আল্লাহতায়ালা প্রাকৃতিকভাবে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করেছেন। যেমন দিন, রাত, মাস, বছর ইত্যাদি।

ইরশাদ হচ্ছে- নিশ্চয়ই নভোমণ্ডল-ভূমণ্ডল সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধানে মাস ১২টি, এর মধ্যে ৪টি নিষিদ্ধ মাস; এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। অন্যত্র মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, তিনিই সূর্যকে তেজস্কর ও চন্দ্রকে জ্যোতির্ময় করেছেন এবং এগুলোর মঞ্জিল নির্দিষ্ট করেছেন, যাতে তোমরা বছর গণনা ও সময়ের হিসাব জানতে পার। আল্লাহ এগুলো নিরর্থক সৃষ্টি করেননি।

জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য তিনি এসব নিদর্শন বিশদভাবে বিবৃত করেন। নতুন বছরের সঙ্গে আসে নতুন চাঁদ ও নতুন মাস। নতুন চাঁদে নতুন মাসে রাসূলে আরাবি (সা.) নিুোক্ত দোয়া পাঠ করতেন- ‘হে আল্লাহ! তুমি ওই চাঁদকে আমাদের ওপর উদিত কর নিরাপত্তা, ইমান, শান্তি ও ইসলামের সঙ্গে। (হে চাঁদ) আমার ও তোমার প্রতিপালক আল্লাহ।’। আলোচ্য নিবন্ধে হিজরি বর্ষ সম্পর্কে আলোকপাত করার প্রয়াস পেলাম।

নানা বর্ষ গণনার ইতিকথা

বহু প্রাচীনকাল থেকে সন গণনা প্রচলিত। আরবদের মধ্যে গোত্রগত বিভাজনের কারণে নানা ধরনের বর্ষ গণনা করা হতো। তবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো সাল বা বর্ষ ছিল না।

বিভিন্ন ধরনের এসব সনের মধ্যে হজরত নুহ (আ.)-এর বন্যা সন, ইয়েমেনের খ্রিষ্টান বাদশা আবরাহা কর্তৃক কাবা ঘর ধ্বংসের জন্য প্রেরিত হস্তিবাহিনীর নামে আমুল ফিল, আমুল ফুজ্জার, আমুল ফতেহ, হবুতি, লুই এবং খসরু সন উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া আরবরা বণিক ছিল বিধায় আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে রোমান সনকে অনুসরণ করত। ব্যাবেলি সন চালু হয় সম্রাট বুখতে নসরের জন্ম তারিখ থেকে।

মিশর ত্যাগ করে বনি ইসরাইল যেদিন মুক্ত হয়, সে দিন থেকে তাদের সন গণনা শুরু। হজরত ঈসা (আ.)-এর জন্মদিন থেকে খ্রিষ্টাব্দ বা ইংরেজি সালের প্রচলন। গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা এবং উজ্জয়িনীর কিংবদন্তি রাজা বিক্রমাদিত্য খ্রিষ্টপূর্ব ৫২ অব্দে ভারতবর্ষে বিক্রমাব্দ প্রচলন করেন। রোমীয়, ব্যাবেলীয়, ইংরেজি, ইরানি, হিন্দুস্তানি প্রত্যেকটি সালের সূচনাতে কোনো না কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা রয়েছে।

হিজরি বর্ষের প্রবর্তন

হিজরতের ১৭ বছর পর দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) যখন রাষ্ট্র ক্ষমতায়, তখন অনেক নতুন ভূখণ্ড ইসলামি খেলাফতের অন্তর্ভুক্ত হয়। রাষ্ট্রীয় কাগজপত্র ইত্যাদিতে সাল-তারিখ উল্লেখ না থাকায় অসুবিধা হতো। আর তখন কুফার গভর্নর ছিলেন হজরত আবু মুসা আল আশয়ারি (রা.)।

তাই তিনি প্রশাসনিক কাজের অসুবিধার কথা জানিয়ে সন ও তারিখ নির্ধারণের আবেদন করেন। সে আবেদনকে গুরুত্ব দিয়ে এবং প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে ফারুকে আজম (রা.) একটি পরামর্শ সভার আয়োজন করেন। যেহেতু নবি করিম (সা.)-এর হিজরতেই ইসলামের পূর্ণতা লাভ, কল্যাণধর্মী রাষ্ট্র গঠন এবং মানব ইতিহাসে নবদিগন্তের সূচনা করে, তাই সে সভাতেই প্রিয় নবি (সা.)-এর হিজরতের বছরকে সন গণনার বছর হিসাবে নির্ধারণের জন্য হজরত মাওলা আলী (রা.) পরামর্শ দেন।

ঐশী বাণীর আলোকে পবিত্র মহররম মাস থেকে ইসলামি বর্ষ হিজরি সালের শুরু করার ও জিলহজ মাসকে সর্বশেষ মাস হিসাবে নেওয়ার পরামর্শ দেন হজরত উসমান গণি (রা.)। সর্বসম্মতিক্রমে তা গৃহীত হয়। আর তখন থেকেই ইসলামি বর্ষ বা হিজরি সন গণনার শুরু। আর বর্ষ গণনায় বিভ্রান্ত লক্ষ করে স্বয়ং রাব্বে করিম মানবজাতির সংশোধনের জন্য সূরা তাওবার উপর্যুক্ত আয়াত হিজরিতের দশম বর্ষে নাজিল করেন। আয়াতে হিজরি সনের ১ম মাস মহররম, সপ্তম মাস রজব, ১১তম মাস জিলকদ আর ১২তম মাস জিলহজ বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে।

হিজরতের দিনক্ষণ

প্রিয় নবিজি (সা.)-এর মক্কা মুকাররমা থেকে মদিনা মুনাওয়ারায় হিজরতের ঘটনা মুসলমানদের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। হিজরত মানে ছেড়ে যাওয়া, পরিত্যাগ করা; দেশান্তর হওয়া ও দেশান্তরিত করা।

পরিভাষায় হিজরত হলো ধর্মের জন্য এক স্থান ত্যাগ করে অন্য স্থানে চলে যাওয়া। সর্বোপরি মহান আল্লাহতায়ালার আদেশ পেয়ে নবুয়তের ত্রয়োদশ বর্ষে ৬২২ খ্রিষ্টাব্দের ১২ সেপ্টেম্বর রাসূল (সা.) মক্কা মুকাররামা থেকে মদিনা শরিফের উদ্দেশে হিজরত করেন।

২৩ সেপ্টেম্বর মোতাবেক ৮ রবিউল আওয়াল মদিনা মুনাওয়ারার পার্শ্ববর্তী কোবায় পৌঁছান তিনি। ২৭ সেপ্টেম্বর মোতাবেক ১২ রবিউল আওয়াল জুমার দিনে নবি করিম (সা.) মদিনা মুনাওয়ারায় প্রবেশ করেন। তিনি যখন মদিনা শরিফে প্রবেশ করেন, তখন তাকে বরণ করার জন্য তার উটের দড়ি নিয়ে আনসারি সাহাবিদের মাঝে টানাটানি শুরু হলো। রাসূল (সা.) বললেন, ‘উট ছেড়ে দাও। যেখানে সে বসবে, সেটাই হবে আমার বাসস্থান। তাকে এমনই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ উট বনু নাজ্জার গোত্রের এলাকায় গিয়ে দাঁড়াল। যা ছিল রাসূল (সা.)-এর নানা বাড়ি। এ গোত্রের হজরত আবু আইয়ুব আনসারি (রা.) বাড়ির সামনে গিয়ে উট বসে পড়ল। এখানেই নবিজি (সা.)-এর বাসস্থান নির্ধারণ করা হলো। এখানেই গড়ে উঠেছে মসজিদে নববি ও মদিনাতুর রাসূল বা রাসূলের শহর। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া; জাদুল মাআদ; তারিখুল ইসলাম)।

বাংলাদেশে হিজরি সনের (নববর্ষ) প্রচলন

৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে হজরত ওমর (রা.) কর্তৃক হিজরি সন প্রবর্তিত হওয়ার এক বছর পরই আরব বণিকদের আগমনের মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের প্রচার-প্রসার ও হিজরি সনের প্রচলন শুরু হয়। পরে ৫৯৮ হিজরি মোতাবেক ১২০৯ খ্রিষ্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির বঙ্গ বিজয়ের মাধ্যমে বাংলার জমিনে মুসলিম শাসনের ইতিহাস সূচিত হয়। ফলে হিজরি সন রাষ্ট্রীয় মর্যাদা লাভের মাধ্যমে জাতীয় সন গণনায় পরিণত হয়। সন গণনায় দীর্ঘ ৫৫০ বছর রাষ্ট্রীয়ভাবে কার্যকর থাকার পর ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধের পরাজয়ের মধ্যমে হিজরি সনের রাষ্ট্রীয় মর্যাদার অবসান ঘটে। জনসংখ্যায় দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশের সরকারও হিজরি নববর্ষ পালনের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না করে নববর্ষ ও অন্যান্য উৎসব পালনের নামে বিজাতীয় সংস্কৃতিকে প্রশ্রয়দান করছে।

কোনো রাজনৈতিক দল কিংবা জোট-মহাজোট কেউ ইসলামি নববর্ষ হিজরি সন পালনের উদ্যোগ নেয়নি। দেখা যায়নি হিজরি নববর্ষের শুভেচ্ছা পরস্পর বিনিময় করতেও। সংবাদপত্র বের করেনি বিশেষ সংখ্যা, আয়োজন নেই কোনো মিডিয়াতে বিশেষ অনুষ্ঠানের। বিশ্ব শান্তির দূত ও কল্যাণের প্রতীক রাসূলে আরবি (সা.)-এর স্মৃতিবিজড়িত সন গণনার প্রতি সম্মান জানিয়ে ১ মহররম ছুটি ঘোষণা করে সরকারিভাবে হিজরি সন উদযাপনের ব্যবস্থা করা সময়ের দাবি।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম