Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

নুরুল ইসলাম ফাউন্ডেশনের মসজিদভিত্তিক মক্তব প্রকল্প

প্রত্যন্ত জনপদে কুরআনের আলো ছড়ায় যমুনা গ্রুপ

Icon

তোফায়েল গাজালি

প্রকাশ: ০২ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

প্রত্যন্ত জনপদে কুরআনের আলো ছড়ায় যমুনা গ্রুপ

প্রত্যন্ত জনপদে কুরআনের আলো ছড়ায় যমুনা গ্রুপ

পঞ্চগড় সদর থেকে প্রায় ৫০ কিমি. দূরের উপজেলা দেবীগঞ্জের প্রত্যন্ত গ্রাম। শহরতলি ছাড়িয়ে মেঠোপথ ধরে ঘণ্টাখানেক চলার পর আমাদের গাড়ি যেখানে থামল, সেটি আলমপাড়া জামে মসজিদ। মসজিদের সামনে লাগানো নুরুল ইসলাম ফাউন্ডেশনের সবুজ সাইনবোর্ড। বড় হরফে লেখা গণশিক্ষা ও মসজিদভিত্তিক মক্তব প্রকল্প। আমাদের স্বাগত জানানোর জন্য এগিয়ে এলেন মক্তবের শিক্ষক মাওলানা ওমর ফারুক। বাঁশের ছাউনি আর পুরোনো টিনে ঘেরা মক্তব ঘরের ভেতর থেকে আসছিল কুরআনের মধুর ধ্বনি- আউজু..... ....... বিসমিল্লাহ.... ...! ভেতরে প্রবেশের মুহূর্তে আনুমানিক ৫০-৫৫ জন শিশু সমস্বরে আমাদের অভিবাদন জানাল-আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ! মসজিদের এক কোনায় গোল হয়ে বসে কিছু শিশু পড়ছে-ওজুর ফরজ চারটি, সমস্ত মুখ ধৌত করা..... .....দুই হাতের কনুইসহ ধৌত করা.......... ইত্যাদি।

এ চিত্র শুধু পঞ্চগড়ের আলমপাড়ারই নয়-বরং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শত শত গ্রামে ছড়িয়ে থাকা মক্তবের। প্রায় দুবছর থেকে সমাজের পিছিয়ে পড়া ও ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে গণশিক্ষা ও মসজিদভিত্তিক মক্তব প্রকল্পের উদ্যোগ গ্রহণ করে দেশের শীর্ষ শিল্প প্রতিষ্ঠান যমুনা গ্রুপের সমাজ সেবামূলক সংস্থা নুরুল ইসলাম ফাউন্ডেশন।

এ প্রকল্পের অধীনে হাজার হাজার শিক্ষার্থী যেমন কুরআনের আলোয় নিজের জীবনকে রাঙিয়ে নিচ্ছে, তেমনি মূল শিক্ষাধারা থেকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীরা আবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফিরে লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করছে। আলমপাড়া মক্তবের শিক্ষক ওমর ফারুক বলেন, ‘শিশুদের কুরআন শেখানোর পাশাপাশি গ্রামের নিরক্ষরতা দূরীকরণেও আমরা কাজ করি। হতদরিদ্র মানুষের পাশে ফাউন্ডেশনের সেবা পৌঁছে দেই। সমাজের শান্তি ও শৃঙ্খলার জন্য শিশুশ্রম, বাল্যবিয়ে, কিশোর গ্যাংসহ সামাজিক অপরাধের বিরুদ্ধেও মানুষকে সচেতন করি।’

ফাউন্ডেশনের মাঠ পর্যবেক্ষণ কর্মকর্তা সুহাইল আহমদ জানান, নুরুল ইসলাম ফাউন্ডেশনের মক্তব প্রকল্পের অধীনে এ রকম শত শত শিক্ষক আছেন-যারা দেশ ও মানুষের কল্যাণে নিবেদিত হয়ে গ্রামগঞ্জে কাজ করছেন। তিনি বলেন, সমাজের বহু মানুষ ধর্মের মৌলিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। অনেকে ধর্মীয় শিক্ষা অর্জনের সময়-সুযোগ পান না। বাংলাদেশে এ রকম হাজার হাজার পাড়া-মহল্লা আছে যেখানে কুরআন শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। দেশের সুবিধাবঞ্চিত প্রতিটি মানুষের কাছে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে এবং সর্বসাধারণ যাতে খুব সহজে অল্প সময়ে পবিত্র কুরআন শিখে নিজেকে আলোকিত মানুষ হিসাবে গড়তে পারেন-এ জন্যই নুরুল ইসলাম ফাউন্ডেশন মসজিদভিত্তিক মক্তব প্রকল্প চালু করেছে। এসব মক্তবে মুসলমানদের বিশুদ্ধভাবে পবিত্র কুরআন, দোয়া-দরুদ, নামাজ-কালাম ও দ্বীনের প্রয়োজনীয় মাসআলা-মাসায়েল শেখানোর পাশাপাশি কুরআনের অর্থ ও মর্ম বুঝতে বিশেষভাবে সহযোগিতা করা হয়। একই সঙ্গে দেশের নিরক্ষর নাগরিকদের অক্ষর-জ্ঞানদানের কার্যক্রমও চালাচ্ছে নুরুল ইসলাম ফাউন্ডেশন। তিনি বলেন-আল কুরআনের প্রথম বাণী ‘পড়, তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।’ (সূরা আলাক-১)। মহানবি হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তি সর্বশ্রেষ্ঠ, যে কুরআন শিক্ষাগ্রহণ করে এবং শিক্ষাদান করে।’ (সহিহ বুখারি-৫০২৭)। পবিত্র কুরআনের এ আয়াত ও রাসূল (সা.)-এর পবিত্র এ হাদিসটি কুরআন শিক্ষা সম্প্রসারণে আমাদের সব সময় প্রেরণা জোগায়।

কথা হয় দিনাজপুরের চিরিরবন্দরে নুরুল ইসলাম ফাউন্ডেশন পরিচালিত মসজিদভিত্তিক মক্তব প্রকল্পের শিক্ষক, মাওলানা মেরাজের সঙ্গে। তিনি বলেন, আজ যারা শিশু আগামী দিন তারাই জাতির কাণ্ডারি। প্রত্যেক শিশুর মাঝেই লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের সুন্দর পৃথিবী। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দুনিয়ার জীবনের শোভা।’ (সূরা কাহফ : আয়াত ৪৬)।

আদর্শ পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে শিশুদের নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা দেওয়ার বিকল্প নেই। প্রিয় নবি হজরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা নিজেদের সন্তানকে স্নেহ কর এবং তাদের আদর্শ শিক্ষায় গড়ে তোল।’

সেই আদেশকে উপজীব্য করে শিশুমানসে নৈতিকতা ও ধর্মীয় শিক্ষার বীজ বুননের মাধ্যমে একটি সুখী, সমৃদ্ধ, স্বনির্ভর ও আদর্শ দেশ গড়ার জন্য নিরলসভাবে কাজ করছে নুরুল ইসলাম ফাউন্ডেশন। প্রকল্পের লক্ষ্য উদ্দেশ্য সামনে রেখে আমরা মসজিদভিত্তিক মক্তবের শিক্ষার্থীদের আদর্শ মানুষ হিসাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। আমরা আল্লাহর কাছে দোয়া করি তিনি যেন আমাদের এ খেদমতকে কবুল করেন। এর অসিলায় যমুনা গ্রুপের প্রয়াত চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামকে জান্নাতের সম্মানিত আসনে সমাসীন করেন। আমিন।

কথা হয় নীলফামারীর ডোমার ইউনিয়ন পরিষদের ৯নং ওয়ার্ডের মেম্বার শফকিুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, গত দুবছর থেকে আমাদের এলাকায় নুরুল ইসলাম ফাউন্ডেশন সম্পূর্ণ বিনামূল্যে মসজিদভিত্তিক মক্তব প্রকল্প পরিচালনা করে আসছে। এতে করে আমাদের এলাকার সুবিধাবঞ্চিত কোমলমতি শিশুরা যেমন কুরআন শিক্ষার সুযোগ পেয়েছে, তেমনি তারা নৈতিক এবং চারিত্রিকভাবেও বেশ উন্নত হয়ে উঠছে। আমি যমুনা গ্রুপের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

মক্তব আরবি শব্দ। পারিভাষিক অর্থে মুসলিম পরিবারের শিশুদের ইসলামি শিক্ষাদানের জন্য যে স্থানে একত্রিত করা হয়, তাই মক্তব। মসজিদে নববিতে সাহাবাদের শিক্ষাদানের জন্য রাসূল (সা.) একজন শিক্ষক নিয়োগ করেছিলেন, তখন থেকেই মক্তব শিক্ষার যাত্রা। ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনে মক্তবই হচ্ছে মুসলিম জাতির প্রথম পাঠশালা।

৭১১ সালে মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের পরপরই ভারতবর্ষে মক্তব ও মাদ্রাসা শিক্ষার সূচনা হয়। তবে শুরুর দিকে এর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ছিল না। ভারতবর্ষে মক্তব ও মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার বিস্তার ঘটে মূলত মোগল আমলে। বাংলাদেশের মসজিদগুলোয়ও সকালবেলা মক্তবে দ্বীনি শিক্ষা দেওয়ার রেওয়াজ যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। এক সময় গ্রাম-বাংলায় সকাল হতো মক্তবের শিশুদের কুরআন পড়ার গুঞ্জনে। সকালের নির্মল আবহাওয়া আরও পবিত্র হয়ে উঠত তাদের মক্তবমুখী পদচারণায়। দূর থেকে শোনা যেত শিশুদের সম্মিলিত কলধ্বনি। কিন্তু এখন এসব দৃশ্য কদাচিৎ চোখে পড়ে। শহর-গ্রাম থেকে হারিয়ে যাচ্ছে মুসলিম শিশুদের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় পাঠশালা মক্তব। সেই দৃশ্য যেন আবার সমহিমায় গ্রামগঞ্জে ফিরে এসেছে নুরুল ইসলাম ফাউন্ডেশনের মসজিদভিত্তিক মক্তব প্রকল্পের মাধ্যমে।

মক্তব শিক্ষার বিপর্যয়ে উদ্বিগ্ন ঠাকুরগাঁয়ের পীরগঞ্জের একান্নপুরের মক্তব শিক্ষক মাওলানা আব্দুর রশীদ বলেন, ‘মুসলিম শিশুদের ধর্মীয় জ্ঞানার্জনের এটিই প্রথম পাঠশালা। মক্তব হারিয়ে যাওয়া মানে, মুসলিম শিশুরা ধর্মীয় প্রাথমিক জ্ঞানার্জনের সহজ পথ থেকে বিচ্যুত হওয়া। তাই মক্তব শিক্ষার বিস্তারে এগিয়ে আসা আমাদের ইমানি দায়িত্ব। আর সেই দায়িত্বই সুচারুরূপে পালন করছে নুরুল ইসলাম ফাউন্ডেশন।

এ লক্ষ্যকে সামনে রেখেই, সারা দেশে সকালবেলার মক্তবগুলো আবার শতভাগ ফিরিয়ে আনতে চায় নুরুল ইসলাম ফাউন্ডেশন। মক্তব প্রকল্পের অধীনে মক্তবের পাঠ্যসূচি এবং পাঠপদ্ধতি আধুনিকায়ন করে বাস্তবসম্মত একটি মক্তব অবকাঠামো দাঁড় করানোরও চেষ্টা করছেন তারা।

বর্তমানে ভারতবর্ষ ছাড়াও দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের দেশ বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনায় মক্তব ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। মসজিদের ইমামরা সাপ্তাহিক ছুটির দিন শিশুদের কুরআন পাঠ ও মৌলিক ধর্মীয় বিষয়গুলো শিক্ষা দিয়ে থাকেন। মক্তব শিক্ষার ঐতিহ্যকে এখনো গুরুত্বের সঙ্গে ধরে রেখেছে তিউনিসিয়া। দেশটির শিক্ষাব্যবস্থায় ‘মক্তব’ শিক্ষাকে এখনো বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। মসজিদ ছাড়াও বিভিন্ন অবস্থাসম্পন্ন ব্যক্তিরা মক্তব শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকেন। তিউনিসিয়ার শিশুদের কুরআন পড়ার হাতেখড়ি মক্তবেই হয়। সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত তথা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও রয়েছে মক্তব শিক্ষার ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা।

গুলিস্তান পীর ইয়ামেনী জামে মসজিদের খতিব মুফতি ইমরানুল বারী সিরাজী বলেন, ‘যমুনা গ্রুপের মতো এভাবে সমাজের সব বিত্তশালীরা মক্তবের পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে এলে আবার মক্তব শিক্ষার জাগরণ তৈরি হবে। নৈতিক ও চারিত্রিক গুণসম্পন্ন, পরোপকারী, কল্যাণকামী ও আল্লাহর প্রতি অনুরাগী একটি সৎ ও সুনাগরিক প্রজন্ম তৈরি হবে। সুখ শান্তি ও সমৃদ্ধিতে ভরে উঠবে আমাদের এ দেশ।’

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম