Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

প্রেমের সফর মেরাজ

Icon

ড. আবদুল আলীম তালুকদার

প্রকাশ: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

প্রেমের সফর মেরাজ

কুরআন হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী যে কয়টি অতি তাৎপর্যপূর্ণ ও পুণ্যময় রজনি রয়েছে তার মধ্যে পবিত্র শবেমেরাজ অন্যতম।

‘মেরাজ’ আরবি শব্দ। এর অর্থ সিঁড়ি, ঊর্ধ্বগমন ইত্যাদি। মহানবি হজরত মুহাম্মাদ (সা.) মক্কা নগরী থেকে ফিলিস্তিনের মসজিদুল আকসা হয়ে প্রথম আসমান থেকে একে একে সপ্তম আসমান এবং সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত সশরীরে সজ্ঞানে জাগ্রত অবস্থায় হজরত জিবরাইল (আ.) ও হজরত মিকাইল (আ.)-এর সঙ্গে বিশেষ বাহন বোরাকের মাধ্যমে ভ্রমণ করানো এবং সেখান থেকে একাকী রফরফ বাহনে আরশে আজিম পর্যন্ত যাওয়া, মহান আল্লাহতায়ালার সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভ ও জান্নাত-জাহান্নাম পরিদর্শন করে ফিরে আসার বিস্তারিত বিবরণ মেরাজ নামে পরিচিত। হিজরি নবম মাস তথা রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে এ মেরাজ সংঘটিত হয়।

এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা কুরআনুল কারিমের সূরা বনি ইসরাইলের প্রথম আয়াতে ইরশাদ করেন, ‘পূত-পবিত্র ও মহিমাময় তিনি (আল্লাহতায়ালা) যিনি তার বান্দাকে (মুহাম্মাদ সা.) রাত্রিকালে ভ্রমণ করিয়েছিলেন আল মসজিদুল হারাম থেকে আল মসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার চারদিকে আমি (আল্লাহ) করেছিলাম বরকতময়, তাকে (মুহাম্মাদ সা.) আমার কুদরতি নিদর্শন দেখানোর জন্য। নিশ্চয়ই তিনি (আল্লাহ) সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা।’

প্রখ্যাত সাহাবি হজরত ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, নবি করিম (সা.) ইরশাদ করেন, রজবের ২৭ তারিখ রাতে হঠাৎ আমার কাছে জিবরাইল (আ.) একটি সাদা রঙের বোরাক নিয়ে উপস্থিত হলেন। (উল্লেখ্য, বোরাক হচ্ছে সাদা রঙের এক ধরনের বাহন, সে প্রতিটি কদম ফেলে দৃষ্টির শেষ সীমানায়) রাসূল (সা.) বলেন, আমি এতে আরোহণ করলাম, অতঃপর মসজিদে প্রবেশ করলাম এবং সেখানে দুরাকাত নামাজ আদায় করলাম। এরপর আমি মসজিদ থেকে বের হলাম। তখন জিবরাইল (আ.) একটি শরাব এবং একটি দুধের পাত্র নিয়ে আমার সামনে উপস্থিত হলেন। তখন আমি দুধের পাত্রটি গ্রহণ করলাম। জিবরাইল (আ.) বললেন, আপনি ফিতরাতকেই গ্রহণ করেছেন। (মুসলিম শরিফ ১ম খণ্ড, পৃ.-৯১)।

ইবনে কাসির (রহ.) তার তাফসির গ্রন্থে মেরাজ সম্পর্কে বলেন, সত্য কথা হলো, নবি (সা.) মেরাজ গমন করেন সশরীরে ও জাগ্রত অবস্থায়, স্বপ্নে নয়। একদিন রাতেরবেলা রাসূল (সা.) হজরত উম্মেহানি (রা.)-এর ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন; রাসূল (সা.) তখন তদ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় ছিলেন। এমন সময় বিস্ময়করভাবে ঘরের ছাদ ফেটে যায় এবং সে স্থান দিয়ে হজরত জিবরাইল (আ.) ঘরে প্রবেশ করেন।

জিবরাইল (আ.) রাসূল (সা.)কে জাগিয়ে হারাম শরিফে নিয়ে আসেন। রাসূল (সা.) এখানে এসে হাতিমে কাবায় ঘুমিয়ে পড়েন। হজরত জিবরাইল ও মিকাইল (আ.) আবার রাসূলকে জাগিয়ে দেন এবং জমজম কূপের পাশে তাকে নিয়ে আসেন। সেখানে রাসূল (সা.)-এর বক্ষ বিদীর্ণ করে পবিত্র জমজমের পানি দ্বারা তার বক্ষ মোবারক ধৌত করেন। যাত্রাপথে রাসূল (সা.) ইয়াসরিব নগরীতে উপস্থিত হন। সেখানে অবতরণ করে দুরাকাত নামাজ আদায় করেন। বোরাক চলতে থাকে দ্রুত গতিতে। এক পর্যায়ে তুর পর্বতের সিনাই প্রান্তরে উপস্থিত হয়। এখানেও রাসূল (সা.) অবতরণ করে দুরাকাত নামাজ আদায় করেন।

তারপর হজরত ঈসা (আ.)-এর জন্মস্থান ফিলিস্তিনের বায়তুল লাহামে উপস্থিত হন। এভাবে বিভিন্ন নবি-রাসূলদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো পরিদর্শন করে বায়তুল মুকাদ্দাসের দ্বারে উপনীত হয়ে তিনি বোরাক নামক বাহনটি অদূরে বেঁধে রাখেন এবং বায়তুল মুকাদ্দাস মসজিদে প্রবেশ করে পূর্ববর্তী সব নবি-রাসূলকে সঙ্গে নিয়ে কিবলামুখী হয়ে দুরাকাত নামাজ আদায় করেন এবং এ নামাজের ইমামতি করেন। এরপর সিঁড়ির সাহায্যে প্রথম আকাশ, তারপর পর্যায়ক্রমে আরও ঊর্ধ্ব আকাশগুলোতে আরোহণ করেন।

ওই সিঁড়িটির স্বরূপ সম্পর্কে মহান আল্লাহই ভালো জানেন। যা হোক, প্রতিটি আকাশে সেখানকার ফেরেশতারা তাকে অভ্যর্থনা জানান এবং ষষ্ঠ আকাশে হজরত মূসা (আ.) ও সপ্তম আকাশে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। এরপর তিনি সব নবি-রাসূলের স্থানগুলোও অতিক্রম করে যান এবং এক বিশাল প্রান্তরে উপনীত হন। সেখানে ভাগ্যলিপি লেখার শব্দ শুনতে পান।

তিনি সিদ্রাতুল মুন্তাহা অবলোকন করেন, সেখানে মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশে স্বর্ণের প্রজাপতি ও নানা রঙের প্রজাপতি ছোটাছুটি করছিল। ফেরেশতারা স্থানটিকে ঘিরে রেখেছিল। সেখানেই তিনি একটি দিগন্তবেষ্টিত সবুজ রঙের পালকির মতো ‘রফ্রফ্’ ও বায়তুল মামুর দেখতে পান। বায়তুল মামুরের কাছেই কাবার প্রতিষ্ঠাতা হজরত ইবরাহিম (আ.) প্রাচীরের সঙ্গে হেলান দিয়ে বসা অবস্থায় ছিলেন। এ বায়তুল মামুরে দৈনিক ৭০ হাজার ফেরেশতা প্রবেশ করেন। কেয়ামত পর্যন্ত তাদের বারবার প্রবেশ করার সুযোগ আসবে না। সিদরাতুল মুনতাহার কাছাকাছি ছিল জান্নাত। নবি (সা.) স্বচক্ষে জান্নাত ও জাহান্নাম দেখেন। আরশে মুয়াল্লায় মহান আল্লাহর সঙ্গে কথাবার্তা হয়। আল্লাহতায়ালা তার প্রিয় রাসূলকে বিশেষভাবে অভিবাদন জানান। নবি (সা.)ও আবেগ-কম্পিত কণ্ঠে সালাম পেশ করেন।

মহান আল্লাহ ও তার রাসূলের সেই মহিমাময় আলাপচারিতার সারাংশই নামাজে তাশাহহুদে পাঠ করা হয়। সে সময় তার উম্মতের জন্য প্রথমে ৫০ ওয়াক্তের নামাজ ফরজ হওয়ার নির্দেশ হয়। এরপর তা কমিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত করে দেওয়া হয়। এর দ্বারা সব ইবাদতের মধ্যে নামাজের বিশেষ গুরুত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়। এরপর তিনি বায়তুল মুকাদ্দাসে ফিরে আসেন এবং বিভিন্ন আকাশে যেসব পয়গম্বরদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল। তারাও তার সঙ্গে বায়তুল মুকাদ্দাসে অবতরণ করেন। তারা এখান থেকেই বিদায় নেন এবং রাসূল (সা.) বোরাকে সওয়ার হয়ে রাতের অন্ধকার থাকতেই মক্কায় পৌঁছে যান।

লেখক : কবি, শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক ও ইসলামি গবেষক

মেরাজ

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম