মায়ের ভাষা স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ দান
ড. মো. কামরুজ্জামান
প্রকাশ: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের একটি অংশ মনে করেন, মহাবিশ্বের বয়স ১ হাজার ৩৮০ কোটি বছর। বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ফিলিপস মনে করেন, পৃথিবীর বয়স ৯.৬ কোটি বছর। গার্ডিয়ানের গবেষকরা বলেছেন, পৃথিবীতে ৪১০ কোটি বছর আগে প্রাণের অস্তিত্ব ছিল।
বিবর্তনবাদীদের মতে, আধুনিক মানুষ সৃষ্টি হয়েছে আজ থেকে ৫০ হাজার বছর আগে। তাদের কারও কারও মতে, চার লাখ বছর আগেও পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব ছিল। ভাষা বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রাণী সৃষ্টির শুরু থেকেই বিশ্বে ভাষা সৃষ্টি হয়েছে।
আধুনিক গবেষকদের মতে, ৮০ লাখ বছর আগে ভাষার উৎপত্তি হয়েছে। ইহুদি, খ্রিষ্টান ও মুসলিম গবেষকদের মতে, পৃথিবীর প্রথম মানুষ আদম (আ.)। সৃষ্টির শুরুতে সব প্রাণীর ওপর আদম (আ.)-এর নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব ছিল। আর আল্লাহতায়ালা তাকে সব জিনিসের নাম শিক্ষা দিয়েছিলেন। এ জ্ঞানের আলোকে তিনি বিভিন্ন প্রাণীর নামকরণ করেছেন। এটা ছিল আদম (আ.)-এর ভাষাজ্ঞানের বড় প্রায়োগিক প্রমাণ।
ভাষা বিশেষজ্ঞদের মতে, ভাষাজ্ঞানের লিখিত নিদর্শন মেলে আজ থেকে ঠিক পাঁচ হাজার বছর আগে থেকে। মুসলিম গবেষকদের মতে, পৃথিবীর প্রাচীন ভাষা ছিল আরবি। ইসলামের প্রথম মানব আদম (আ.)-এর জান্নাতে বসবাসের সময় তার ভাষা ছিল আরবি। তিনি জান্নাত থেকে পৃথিবীতে আসার পর আরবি ভাষা ভুলে যান। অতঃপর তিনি সুরইয়ানিয়া ভাষায় কথা বলতে থাকেন। অতঃপর তাওবার মাধ্যমে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন। আবার তিনি আরবিতে কথা বলা শুরু করেন।
ইসলামি গবেষকদের মতে, আদম (আ.) থেকে নুহ (আ.) পর্যন্ত পৃথিবীর সব মানুষই আরবিতেই কথা বলত। এ দীর্ঘ সময় ধরে সব মানুষ একই শব্দ ব্যবহার করত। (বাইবেল, আদিপুস্তক, ১১/১)।
আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ূতী (র.) বলেন, সব আসমানি গ্রন্থ আরবি ভাষায় নাজিল হয়েছিল। নবিরা আসমানি গ্রন্থগুলো তাদের নিজ জাতির মাতৃভাষায় অনুবাদ করে শিক্ষা দিয়েছিলেন। যুগের চাহিদা মোতাবেক একে একে সব কিতাব রহিত হয়ে যায়। শুধু আসমানি কিতাব আল-কুরআন হুবহু আরবিতেই বহাল রয়ে যায়। (আল ইতকান ফি উলুমিল কুরআন, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা, ১৩৬)।
সময়ের ব্যবধানে মানব সৃষ্টির পরিবর্তন ঘটেছে; বিবর্তন ঘটেছে মানব সভ্যতার। এ বিবর্তনের কারণে বিশ্বব্যাপী ভাষাতেও বিচিত্র রূপ ধারণ করেছে। সৃষ্টির শুরুর দিকে মানুষ ইশারা এবং অঙ্কনের মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করত। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ কথা বলার উপায় বের করে। তারা কথা বলার মাধ্যমে ভাবের আদান-প্রদান শুরু করে।
কিন্তু এ কথা বলার সময় সব ব্যক্তির রীতি এবং উচ্চারণ এক রকম হতো না। এক একজনের মুখে ভাষার রীতি একেক রকম দেখা দিত। এতে ভাষা এবং তার উচ্চারণ নীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। অর্থাৎ ভাষা উচ্চারণের ক্ষেত্রে বিভিন্নজনের বিভিন্ন রীতির উদ্ভব ঘটে। ফলে ভাষাতে বিভিন্ন পরিবর্তন সৃষ্টি হয়। এ পরিবর্তন এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজšে§ স্থানান্তরিত হতে থাকে।
এ স্থানান্তর ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি এবং সম্প্রদায় থেকে সম্প্রদায় পর্যন্ত গড়ায়। শেষ পর্যন্ত দেশ থেকে দেশান্তরে ভাষার এ পরিবর্তন ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে নানা দেশে নানা অঞ্চলে ভাষার উৎপত্তি হতে থাকে। পরিবর্তিত এ ভাষার সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে। মানবগোষ্ঠী চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। তাদের মাধ্যমে জন্ম নিতে থাকে বিভিন্ন জাতি, গোষ্ঠী, দেশ এবং মহাদেশ। ফলে ভাষাতে সৃষ্টি হয় ব্যাপক বৈচিত্র্য। বর্তমানে পৃথিবীতে ২০০-এর ওপরে রাষ্ট্র রয়েছে। আর মানুষ রয়েছে প্রায় ৮০০ কোটি।
এ ৮০০ কোটি মানুষ কমবেশি প্রায় ৮০০০ ভাষায় কথা বলে থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর মধ্যে ২৩টি প্রধান ভাষায় অধিকাংশ মানুষ কথা বলে। আর এ ভাষাভাষী মানুষের দিক থেকে পৃথিবীতে চীনা ভাষার অবস্থান প্রথম। এ ভাষায় পৃথিবীর প্রায় ১২৮ কোটি মানুষ কথা বলে। দুই নম্বরে অবস্থান করছে স্পেনীয় ভাষা। স্পেনীয় ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪৪ কোটি। তিন নম্বরে রয়েছে ইংরেজি ভাষা।
পৃথিবীতে এ ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩৮ কোটি। আরবি ভাষার অবস্থান চতুর্থ। পৃথিবীতে এ ভাষায় কথা বলা মানুষের সংখ্যা ৩৫ কোটি। এর পরই রয়েছে আমাদের মাতৃভাষা বাংলার অবস্থান। পৃথিবীতে এ ভাষায় কথা বলা মানুষের সংখ্যা প্রায় ২৯ কোটি।
বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। আর মাতৃভাষার মানেই হলো মায়ের ভাষা। মায়ের ভাষাতে কথা বলা মানুষের চিরায়ত সহজাত প্রবৃত্তি। কারণ, এ ভাষায় মানুষ খুব সহজেই তার মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে। মাতৃভাষা আল্লাহর এক অপার অনুগ্রহ। কারণ, আল্লাহতায়ালা সব নবিকে স্বজাতির ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছিলেন (সূরা ইবরাহিম : ৪)। এ আয়াতটি মাতৃভাষা শিক্ষা ও সংরক্ষণের জন্য বিশেষ গুরুত্ব নির্দেশ করে। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, তিনিই আল্লাহ যিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন।
অতঃপর মনের ভাব প্রকাশ করতে ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন (সূরা : আর রহমান ৩-৪)। ভাষা শিক্ষা ও উচ্চারণের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো শুদ্ধভাবে উচ্চারণ, লিখন ও পঠন। প্রতিটি ভাষা শুদ্ধ উচ্চারণের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। কারণ, ভাষার শুদ্ধ উচ্চারণ ছাড়া অর্থ বিশুদ্ধ হয় না। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ‘আইএলটিএস’ কোর্সটি ইংরেজি ভাষা শিক্ষার অন্যতম উদাহরণ। ভাষার বিশুদ্ধ উচ্চারণ ও ব্যবহারের ব্যাপারে ইসলামও যথেষ্ট গুরুত্ব প্রদান করেছে। শুদ্ধ উচ্চারণ ও প্রাঞ্জল ভাষায় কথা বলার ব্যাপারে ইসলামের নির্দেশনা স্পষ্ট। আব্দুল মালেক বিন মারওয়ান বলেন, ‘ভাষা ও শব্দের অশুদ্ধ উচ্চারণ কাপড়ের ছিদ্র ও মুখে গুটিবসন্তের দাগের মতো’ (আল-আদাবুস সুলতানিয়্যাহ, ১/৪৫)।
ইমাম জহুরি বলেন, ‘বিশুদ্ধ ভাষা আভিজাত্যপূর্ণ।’ মহানবি মুহাম্মাদ (সা.) ছিলেন আরবের সবচেয়ে বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জলভাষী। তিনি মাতৃভাষায় কথা বলতে গর্ববোধ করতেন। মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘আরবদের মাঝে আমার ভাষা সর্বাধিক স্পষ্ট। তোমাদের চেয়ে আমার ভাষা অধিকতর মার্জিত ও সুস্পষ্ট।’ (ইবনুল আরাবি)।
নবিজি (সা.) আরও বলেছেন, আরবের সবচেয়ে মার্জিত ভাষার অধিকারী সাদিয়া গোত্র। আর আমি সেই গোত্রেই বড় হয়েছি। তাদেরই কোলে আমার মুখ ফুটেছে। তাদের মাঝে আমি সর্বাধিক সুভাষিত ভাষা ব্যক্ত করেছি। নবিজি (সা.)-এর এ বক্তব্য মাতৃভাষায় পারদর্শী হওয়া এবং যোগ্যতা অর্জন করার বিষয়ে সাক্ষ্য বহন করে।
সুতরাং, এ যোগ্যতা অর্জন করা, মহানবি (সা.)-এর যোগ্যতারই অংশবিশেষ। ইসলামের ইতিহাসে দোভাষী নিয়োগ দেয়ার ঘটনা বিরল নয়। মহানবি (সা.) তাঁর সময়ে জায়েদ বিন ছাবিত (রা.)কে দোভাষী হিসাবে নিয়োগ প্রদান করেছিলেন। দোভাষী হিসাবে নিয়োগ পাওয়ার পর যায়েদ বিন সাবিত (রা.) বিভিন্ন ভাষার ওপর দক্ষতা অর্জন করেন। অন্য ভাষায় লিখিত চিঠি পড়া ও তার জবাব প্রদান কাজে তিনি ব্যস্ত সময় পার করতেন (বুখারি, ৬ষ্ঠ খণ্ড, ২৬৩১)।
এ সম্পর্কে যায়েদ ইবনে সাবিত (রা.) বলেন, আমি মাত্র ১৫ বা ১৭ দিনের মাথায় অন্য ভাষা আয়ত্ব করি। নবিজি (সা.) কিছু লিখতে বললে আমি লিখে দিতাম, আর ইহুদি-খ্রিষ্টানরা চিঠি দিলে আমি সেটা পড়ে দিতাম। (ফাতহুল বারি, ১৩/১৮৬)। অন্য ভাষার প্রতি ইসলাম কর্তৃক গুরুত্ব দেওয়ার আরেকটি নজির হলো সাত কিরাত। আর সেটা হলো এভাবে, আল কুরআন আরবি ভাষাতেই নাজিল হয়েছিল। কিন্তু আরবের বিভিন্ন গোষ্ঠী সেটা বিভিন্ন রীতিতে তা পাঠ করত। ইসলাম কুরআন পঠনের বিভিন্ন এ রীতিকে অনুমোদন দিয়েছিল। এ কারণে পৃথিবীতে কুরআন সাত কিরাতে পড়ার প্রচলন রয়েছে। এ ব্যাপারে নবিজি (সা.) বলেন, নিশ্চয়ই আল-কুরআন ৭ উপভাষায় নাজিল হয়েছে। এর মধ্যে তোমাদের কাছে যেটা সহজ হয় সেটাতেই তুমি পাঠ করতে পারো (বুখারি, ৪র্থ খণ্ড, হাদিস নং ১৯২৪)। মাতৃভাষার প্রতি ইসলামের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ হলো ভাষার অবিকৃতি। মাতৃভাষার বিকৃতি ইসলাম সমর্থন করে না।
ইহুদি এবং খ্রিষ্ট্রানরা ভাষা বিকৃতি করে মুখ বাঁকিয়ে গ্রন্থ পাঠ করত। এর মাধ্যমে ভাষার জটিলতা সৃষ্টি হতো এবং তাদের অনুসারীদের ধোঁকা দিত। আল্লাহতায়ালা তাদের এ ভাষাগত বিকৃতি পছন্দ করেননি। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘আর তাদের মধ্যে একদল রয়েছে, যারা বিকৃত উচ্চারণে মুখ বাঁকিয়ে কিতাব পাঠ করে। যাতে তোমরা মনে কর তারা কিতাব থেকেই পাঠ করছে। কিন্তু তা আসলে আদৌ কিতাব নয়’ (সূরা : আল-ইমরান ৭৮)।
সুতরাং ইসলামে ভাষা বিকৃতি সমর্থন যোগ্য নয়। ভাষা বিকৃতি ও অশুদ্ধ উচ্চারণ ইসলামে নিষিদ্ধ। উচ্চারণে বিকৃতি হওয়া থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাওয়ার দোয়া খোদ কুরআনেই উল্লেখ রয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘হে আমার রব! তুমি আমার ভাষার জড়তা দূর করে দাও! যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে’ (সূরা : ত্বহা, আয়াত ২৭-২৮)।
ভাষাজ্ঞান মূলত আল্লাহর ইচ্ছাকৃত সৃষ্টি। কেননা তিনি আদম (আ.)কে সবকিছুর নাম শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি ভাষাজ্ঞানও শিক্ষা দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘আর তিনি আদমকে যাবতীয় জিনিসের নাম শিক্ষা দিলেন। আর সেগুলো তিনি ফেরেশতাদের সম্মুখে প্রকাশ করলেন এবং বললেন, এ সমুদয় জিনিসের নাম আমাকে বলে দাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও’ (আল বাকারা : (৩০-৩৩)।
সমুদয় শব্দ দ্বারা এখানে পৃথিবীর সব ভাষাকে বোঝানো হয়েছে। আর এ ভাষাজ্ঞান দ্বারা আদম (আ.) পৃথিবীর সব বস্তুর নামকরণ করেছিলেন। পৃথিবীর দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান; সবকিছুর নাম তিনিই রেখেছিলেন।
উল্লেখিত আয়াত এবং হাদিস দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, ইসলামে মাতৃভাষার ব্যবহার, শিখন ও পঠনের গুরুত্ব অপরিসীম। ইসলামে এটি মানুষের জন্মগত অধিকার হিসাবে স্বীকৃত। এটি সংরক্ষণের জন্য সংঘটিত যে কোনো আন্দোলনই স্বাধিকার আদায়ের শামিল। আর এ স্বাধিকার আন্দোলন করতে গিয়ে যদি কারও মৃত্যু হয়, তিনি শাহাদাতের মর্যাদা পাবেন।
লেখক : অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া