Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

ইসলামে সুখী পরিবারের রূপরেখা

Icon

মাহমুদ আহমদ

প্রকাশ: ২০ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ইসলামে সুখী পরিবারের রূপরেখা

একটি সুখী-সমৃদ্ধ ও শান্তিময় পারিবারিক জীবনের প্রাথমিক শর্ত হলো বিয়ে। বিয়ে হচ্ছে একটি পবিত্র বন্ধন। এটা কারও অজানা নেই, একজন পুরুষ এবং একজন নারীর একত্রে জীবনযাপনে শরিয়ত মোতাবেক যে বন্ধন স্থাপিত হয়, তারই নাম বিয়ে।

বিয়ে-বন্ধন কেবল গতানুগতিক বা কোনো সামাজিক প্রথা নয়, এটা মানবজীবনের ইহকাল ও পরকালের মানবীয় পবিত্রতা রক্ষার জন্য আল্লাহ পাকের একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নেয়ামত। সুতরাং এটা যে কেবল পার্থিব জীবনের গুরুত্বই বহন করে এমন নয়, বরং পারলৌকিক জীবনের জন্যও অনেক গুরুত্ব বহন করে।

বিয়ের এ পবিত্র বন্ধনকে ছিন্ন করে সমাজে বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনা অহরহ ঘটছে। যদিও তালাকের বিষয়ে ইসলামের শিক্ষা রয়েছে কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে তালাক কোনো পছন্দনীয় কাজ নয়। বরং ইসলামে সবচেয়ে ঘৃণ্য ও নিকৃষ্ট হালাল কাজ হিসাবে তালাককে উল্লেখ করা হয়েছে।

বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে নারীকে করা হয়েছে পুরুষের জীবনসঙ্গিনী ও অর্ধাঙ্গিনী। কারণ পুরুষ নিজ জীবনে, আপন ভুবনে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয় বলেই একজন সহযোগিনীর একান্ত মুখাপেক্ষী। নারীর অবর্তমানে পুরুষের হৃদয় শূন্যকোঠা সমতুল্য। একজন সুস্থ সবল, সতী সাধ্বী, ধর্মপরায়ণা নারীকে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করার মাধ্যমেই কেবল তার এ শূন্যকোঠা পূর্ণ হতে পারে।

সৃষ্টির আদিকাল থেকেই নারী-পুরুষ একে অপরের পরিপূরক ও পরিপোষক। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘আর তার নিদর্শনাবলির মাঝে এ-ও হলো একটি নিদর্শন যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদেরই মাঝ থেকে জোড়া সৃষ্টি করেছেন যেন তোমরা প্রশান্তি লাভের জন্য তাদের কাছে যাও এবং তিনি তোমাদের মাঝে প্রেমপ্রীতি ও দয়ামায়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এতে সেসব লোকের জন্য নিদর্শনাবলি রয়েছে, যারা চিন্তাভাবনা করে’ (সূরা রুম, আয়াত : ২১)।

নারী-পুরুষের হৃদয়ে প্রশান্তি লাভের নির্ভরযোগ্য এক আশ্রয়স্থল হচ্ছে বিবাহবন্ধন। কেবল বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমেই কোনো পুরুষ এ পবিত্র আশ্রয়স্থলে প্রবেশ করতে পারে। তাই বিয়েকে বলা হয় শান্তির প্রতীক। বিয়ের এ অসাধারণ গুরুত্বের প্রতি লক্ষ করেই মানব সৃষ্টির আদিতে বৈবাহিক যোগসূত্রের গোড়াপত্তন হয়। কারণ এ সহ-জীবনযাপনের পূর্বশর্ত হচ্ছে বিবাহবন্ধন।

সবদিক বিবেচনা করেই পবিত্র কুরআনে মানব সম্প্রদায়কে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘যুগল প্রেমিক আর প্রেমিকার জন্য তুমি বিবাহের চেয়ে উত্তম কিছুই খুঁজে পাবে না’ (ইবনে মাজা)। অথচ আজ সামান্য বিষয়কে কেন্দ্র করে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে যে পবিত্র বন্ধন রচিত হয়েছে তা থেকে দূরে সরে যায়। ইসলামে তালাকের ব্যবস্থা রাখলেও তালাক প্রদানে উৎসাহিত করা হয়নি।

বর্তমানে বিচ্ছেদের প্রবণতা এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, মনে হয় এটা কোনো বিষয়ই নয়; আমরা এটাও লক্ষ করি না যে, এর মাধ্যমে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নৈতিকতা ও আদর্শকে ধ্বংস করে দিচ্ছি। স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদের কারণে শুধু স্বামী-স্ত্রী নয় বরং ছেলেমেয়েসহ আত্মীয়স্বজনও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে অনিশ্চিত করে দেয় অনেক ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ। তারা সব সময় এক ধরনের মানসিক চাপের মধ্যে থাকে।

ন্যায়সঙ্গত কারণে তালাক ইসলামে বৈধ, তবে এটি সবচেয়ে নিকৃষ্ট বৈধ কাজ। নারীরাও বৈধ উপায়ে এ তালাক নেওয়ার অধিকার রাখে। হজরত মুআররিফ (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর কাছে হালাল বিষয়ের মধ্যে তালাকের চেয়ে অধিকতর ঘৃণিত আর কিছু নেই’ (আবু দাউদ)। হাদিসে আরও এসেছে ‘যে নারী স্বামীর কাছে বিনা কারণে তালাক প্রার্থনা করে, তার জন্য জান্নাতের সুঘ্রাণ পর্যন্ত হারাম’ (ইবনে মাজা)।

তালাকের ভয়াবহতা সম্পর্কে হজরত আলি (রা.)-এর বর্ণনায় এসেছে, মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা বিয়ে কর কিন্তু তালাক দিও না। কেননা তালাক দিলে তার দরুন আল্লাহর আরশ কেঁপে ওঠে।’ (তাফসিরে কুরতুবি)। তবে একান্তই বিবাহবিচ্ছেদ কখনো অনিবার্য হয়ে উঠলে ইসলাম তার বিধান দিয়েছে।

একসঙ্গে চলতে গিয়ে কিছু ভুল বোঝাবুঝি স্বামী-স্ত্রীর মাঝে হতেই পারে। এ জন্য কখনো স্বামীকে ছাড় দিয়ে চলতে হয় আবার কখনো স্ত্রীকে। বিশেষ করে স্ত্রীদের ক্ষেত্রে কিছুটা বেশি ছাড় দিতেই মহানবি (সা.) উৎসাহিত করেছেন। মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘নারীদেরকে পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তুমি যদি একবারে এটিকে সোজা করতে যাও, তবে ভেঙে ফেলবে।’ অর্থাৎ তাদের স্বভাবে কিছুটা বক্রতা রাখা হয়েছে।

কিন্তু এটিই নারীদের সৌন্দর্য। তাদের যদি একবারেই সোজা অর্থাৎ সংশোধন করার চেষ্টা করা হয় আর সে জন্য অশোভন ও কঠোর পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়, তবে সেটি কখনো সংশোধিত হবে না আর এভাবে তার হাড় ভেঙে যেতে পারে, অর্থাৎ নারীরা বিগড়ে যেতে পারে। প্রেম-ভালোবাসা, সহনশীলতা ও পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের মাধ্যমে ধীরে ধীরে তাদের সংশোধন করতে হবে। ইসলাম এমন একটি পবিত্র-ধর্ম, যা নারী-পুরুষ প্রত্যেকের অধিকার খুব সুন্দরভাবে সংরক্ষণ করে এবং একটি সুন্দর সমাজ গঠনে নারী-পুরুষ উভয়ের অবদান রাখার কথা ঘোষণা করে।

ইসলামের আবির্ভাবের আগে নারীর মর্যাদা কিরূপ ছিল; তাদের অধিকার বলতে কিছু ছিল না। কিন্তু মানবতার মুক্তির দূত, নবিকূল শিরোমণি হজরত মুহাম্মাদ মুস্তফা (সা.)-এর আবির্ভাবে নারীরা তাদের যথাযোগ্য সম্মান ও মর্যাদা লাভ করে।

তার (সা.) প্রতি অবতীর্ণ পূর্ণাঙ্গ ঐশীগ্রন্থ আল-কুরআনে আল্লাহতায়ালা শিক্ষা দিলেন, ‘তারা তোমাদের জন্য এক ধরনের পোশাক এবং তোমরাও তাদের জন্য এক ধরনের পোশাক’ (সূরা বাকারা, আয়াত : ১৮৭)। এখন দেখুন, পোশাকের কাজ কী? পোশাকের কাজ হচ্ছে নগ্নতাকে ঢেকে দেওয়া। তাই আল্লাহতায়ালা বলেছেন, তোমরা স্বামী-স্ত্রী অবশ্যই একে অপরের দোষ-ত্রুটি ঢেকে রাখবে। কেননা, পোশাক সৌন্দর্য বৃদ্ধির কারণও হয়ে থাকে। এখানে নারী-পুরুষকে একে-অপরের সহযোগী আখ্যায়িত করা হয়েছে।

অন্যত্র আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমাদের স্ত্রীরা তোমাদের জন্য ক্ষেত্র স্বরূপ’ (সূরা আল বাকারা, আয়াত : ২২৩)। একজন ভালো কৃষক যেভাবে সর্বদা নিজের মূল্যবান জমিনের হেফাজত করে, পরিশ্রমের মাধ্যমে জমিনের পরিচর্যা করে, জমিকে ক্ষতিকর পোকামাকড়ের হাত থেকে রক্ষা করে, তেমনিভাবে ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে, পুরুষরা যেন জেনে রাখে যে, নারীরা তাদের অমূল্য-সম্পদ। সঠিকভাবে তাদের হেফাজত করা, তাদের ভালো-মন্দের দিকে দৃষ্টি রাখা এবং তাদের সঙ্গে উত্তম দাম্পত্য জীবনযাপন করতে যেন কোনো ত্রুটি না করে।

আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘পুরুষরা স্ত্রী লোকদের ওপর অভিভাবক, কেননা আল্লাহ তাদের কতককে কতকের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং এ কারণেও যে, তারা নিজেদের ধনসম্পদ থেকে স্ত্রী লোকদের জন্য খরচ করে’ (সূরা নিসা, আয়াত : ৩৪)। আর হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, হজরত হাকিম ইবনে মুয়াবিয়া (রা.) তার পিতা মুয়াবিয়া (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, হে আল্লাহর রাসূল! স্বামীর ওপর স্ত্রীর কী কী অধিকার রয়েছে?

তিনি (সা.) বললেন, তার অধিকার হলো যখন তুমি খাবে তখন তাকেও খাওয়াবে, তুমি যে মানের কাপড় পরবে, তাকেও সে মানের কাপড় পরাবে। তার মুখে আঘাত করবে না। অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করবে না’ (আবু দাউদ)। আমরা যদি আজ মহানবির (সা.) এ শিক্ষার ওপর আমল করি তবে প্রতিনিয়ত যে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে তা হয়তো আর দৃষ্টিতে আসবে না।

তাই আসুন, আমরা এমন কিছু না করি যার ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের ধিক্কার দেবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা চিন্তা করে তাদের জন্য জান্নাত-সদৃশ্য পৃথিবী গড়ার চেষ্টা আমাদের করতে হবে। আল্লাহতায়ালা আমাদের প্রকৃত ইসলামের শিক্ষা ও নিয়ম-নীতি অনুযায়ী চলার তৌফিক দান করুন, আমিন।

লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট

masumon83@yahoo.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম