Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

তাবলিগের পাঁচ মুরব্বি

মানুষকে দ্বীনের পথে ফিরিয়ে আনার জন্য উনিশ শতকের গোড়ার দিকে মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) প্রতিষ্ঠা করেন তাবলিগ জামাত। যেসব মুরব্বিদের ত্যাগের বিনিময় তাবলিগ জামাত আজ সমগ্র বিশ্বময় ছড়িয়েছে তাদের নিয়ে লিখেছেন-

Icon

আ.স.ম আল আমিন

প্রকাশ: ১৩ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

তাবলিগের পাঁচ মুরব্বি

মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভি

তাবলিগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা ও আমির হলেন মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভি (রহ.)। তিনি ভারতের উত্তর প্রদেশের মুজাফফরনগর জেলার অন্তর্গত কান্ধলা নামক স্থানে ১৮৮৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মাওলানা মুহাম্মদ ইসমাঈল। শিশুকালেই কুরআনের হিফজ সম্পন্ন করেন এবং প্রাথমিক শিক্ষা নিজ ঘরে অর্জন করেন।

তিনি বড়ভাই ইয়াহইয়া কান্ধলভির সঙ্গে মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহীর সান্নিধ্যে থেকে ১০ বছর আধ্যাত্মিক সাধনা করেন। ১৩২৬ হিজরিতে দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হন। দেওবন্দে শায়খুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান দেওবন্দি (রহ.)-এর কাছে তিনি বুখারি ও তিরমিজি শরিফ পড়েন। তিনি দ্বীনহারা মানুষকে দ্বীনের পথে ফিরিয়ে আনার মহৎ উদ্দেশ নিয়ে ১৯২৬ সালে উত্তর ভারতের মেওয়াত অঞ্চল থেকে শুরু করেন তাবলিগের কাজ।

প্রথমদিকে ভারতের অখ্যাত মেওয়াত পল্লিতে তাবলিগ জামাতের কাজ শুরু হলেও বাইরের দুনিয়া তখনো জানত না আসলে কী বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে মেওয়াতে। গ্রামটি ছিল অবহেলিত, কুসংস্কারে ভরপুর। তাবলিগ জামাতের কার্যক্রমের ফলে মেওয়াতের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবনে আসে ব্যাপক পরিবর্তন। দ্বীন ও ইমানের ছায়ায় তারা হয়ে ওঠে একেকজন আলোকিত মানুষ। বিংশ শতাব্দীর এ মহান ধর্মপ্রচারক ১২ জুলাই ১৯৪৪ সালে এ পৃথিবী ছেড়ে আল্লাহতায়ালার সান্নিধ্যে চলে যান।

মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভি

মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভি (রহ.) এরপর তাবলিগ জামাতের আমিরের পদে অধিষ্ঠিত হন মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভি (রহ.)। তিনি মাওলানা ইলিয়াস (রহ.)-এর ছেলে। ভারতবর্ষের উত্তর প্রদেশের মুজাফফরনগর জেলার কান্ধলা নামক স্থানে ২০ মার্চ ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দ রোজ বুধবার জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মাত্র ১০ বছর বয়সে কুরআনের হিফজ সম্পন্ন করেন। হিফজ সম্পন্ন করে বাবা মাওলানা ইলিয়াস (রহ.)-এর কাছেই প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন।

শায়খুল হাদিস যাকারিয়া (রহ.)-এর কাছে সুনানে আবু দাউদ পড়েন। মাজাহিরুল উলুম মাদ্রাসায় মাওলানা আবদুল লতিফ (রহ.)-এর কাছে সহি বুখারির পাঠ গ্রহণ করেন। শায়খ ইলিয়াস (রহ.)-এর মৃত্যুর পর তাবলিগের মুরব্বিরা তার মাথায় আমিরের পাগড়ি পরিয়ে দেন। তখন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি তাবলিগ ও দাওয়াতের মেহনতের কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন।

বিশ্বজুড়ে সমাদৃত ‘আমানিল আহবার-বিখ্যাত হাদিসের কিতাব শরহু মা’আনিল আছারের ভাষ্যগ্রন্থ, ‘হায়াতুস সাহাবা’ সাহাবিদের জীবনীগ্রন্থ ‘মুন্তাখাব হাদিস’-তাবলিগ জামাতের ছয় নম্বর সম্পর্কিত নির্বাচিত হাদিসসমূহ, তার অনুবাদ ও ব্যাখ্যা সংবলিত অমর গ্রন্থ ।

ভারত বিভক্তির পর ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে মাওলানা মুহাম্মদ ইউসুফ (রহ.) বাংলাদেশে তাবলিগের সফরে আসেন। সে সময় ঢাকার কাকরাইল মসজিদে এসেছিলেন তিনি। এর আগে তাবলিগের কাজ প্রাথমিক পর্যায়ে শুরু হলেও মাওলানা মুহাম্মদ ইউসুফ (রহ.)-এর আগমনের মাধ্যমেই কাকরাইল মসজিদকেন্দ্রিক আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের কার্যক্রম শুরু হয়। তাবলিগের এক সফরে ২৯ জিলকদ ১৩৮৪ হিজরি মোতাবেক ২ এপ্রিল ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইন্তেকাল করেন।

মাওলানা এনামুল হাসান

তাবলিগের কাজকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে যারা আমরণ চেষ্টা করেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম একজন মাওলানা এনামুল হাসান। তিনি গোটা জীবনকে ইলমে অহির খেদমতের পাশাপাশি দ্বীনি দাওয়াতের জন্য উৎসর্গ করেছেন। তিনি তাবলিগ জামাতের তৃতীয় মুরব্বি। তিনি ১৯১৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ভারতের উত্তর প্রদেশের কান্ধালা নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মাওলানা ইকরামুল হাসান। বাবার কাছেই তার প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি হয়।

আনুমানিক নয় কিংবা দশ বছর বয়সে তাবলিগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মুরব্বি মাওলানা ইলিয়াস (রহ.)-এর তত্ত্বাবধানে নিজামুদ্দিন চলে আসেন এবং মাওলানা ইলিয়াস ও মাওলানা এহতেশামুল হাসানের কাছে আরবি ভাষা-সাহিত্যসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। প্রাথমিক পর্যায়ের কিতাবাদি অধ্যয়ন করার সময়ই শিক্ষক-মুরব্বি মাওলানা ইলিয়াসের নজর কাড়েন এনামুল হাসান।

১৯৬৫ সালে বিশ্ব তাবলিগ জামাতের আমির মাওলানা ইউসুফ কান্দলভি (রহ.) ইন্তেকালের পর শায়খুল হাদিস মাওলানা জাকারিয়া (রহ.) তাকে বিশ্ব তাবলিগ জামাতের আমির হিসাবে মনোনীত করেন। এ মহান মনীষী ১৯৯৫ সালের ১০ জুন ইন্তেকাল করেন।

মাওলানা জুবায়েরুল হাসান

মাওলানা জুবায়েরুল হাসান ছিলেন বিশ্ব তাবলিগ জামাতের অন্যতম নীতিনির্ধারক। ভারতের নিজামুদ্দীন মারকাজের শূরার অন্যতম শীর্ষ সদস্য। তাবলিগ জামাতের একক কোনো আমির না থাকলেও তাকেই শীর্ষ মুরব্বি হিসাবে মানতেন সবাই। তার জন্ম ১৯৫০ সালের ৩০ মার্চ। প্রাথমিক পড়াশোনা বাবা মাওলানা এনামুল হাসানের কাছে সম্পন্ন করেন। আক্বসাদ রায়পুরি (রহ.)-এর কাছে কুরআন শরিফ হিফজ সম্পন্ন করেন।

১৯৭১ সালে ভারতের প্রখ্যাত দ্বীনি প্রতিষ্ঠান জামেয়া মাজাহিরুল উলুম সাহারানপুর থেকে তিনি পড়াশোনা সম্পন্ন করেন। কর্মজীবনে শিক্ষাদান ও দাওয়াতি কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৭৪ সালের ৯ আগস্ট প্রথম মাদ্রাসায়ে কাদিমের মসজিদে তাবলিগ জামাতের সঙ্গীদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন। এরপর থেকে ইন্তেকাল পর্যন্ত জড়িত ছিলেন নবিওয়ালা এ কাজের সঙ্গে।

বাংলাদেশের মুসলমানদের সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক ছিল মাওলানা জুবায়েরুল হাসানের।

প্রতি বছর টঙ্গীর তুরাগতীরে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ইজতেমায় তিনি নিয়মিত আসতেন। ইজতেমার বিশেষ আকর্ষণ আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করতেন তিনি। মোনাজাতের আগে তাবলিগের ছয় উসুলের ওপর হেদায়াতি বয়ানও করতেন তিনি। তার দরাজ কণ্ঠ, আবেগময় ভাষা এবং সাবলীল উপস্থাপনায় আখেরি মোনাজাত অন্য রকম এক ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করত। তার দোয়ার কারণে হৃদয়ভেজা কান্না আর আমিন আমিন ধ্বনিতে মুখরিত হতো তুরাগতীর।

এ মহান মুরব্বি ১৮ মার্চ ২০১৪ সালে রোজ মঙ্গলবার বেলা ১১টায় ড. রাম মানোহার লুহিয়া হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৬৪ বছর।

মাওলানা সাদ কান্ধলভি

বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী এক আলোচিত নাম মাওলানা সাদ কান্ধলভি। তিনি ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দ মোতাবেক ১৩৮৫ হিজরিতে দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাজে জন্মগ্রহণ করেন। মাওলানা সাদ কান্ধলভি হজরত ইলিয়াস (রহ.)-এর বংশধর।

মাওলানা সাদ কান্ধলভি দিল্লির নিজামুদ্দিনেই বেড়ে উঠেছেন। তার লেখাপড়াও এখানেই। সাইয়েদ আবুল হাসান আলি নদভি (রহ.)-এর কাছে মাওলানা সাদের লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয়। তিনি তাকে মসজিদে নববির রওজাতুম-মিন রিয়াজিল জান্নাতে বসে প্রথম পাঠদান করেন। নিজামুদ্দিন মারকাজে অবস্থিত কাশিফুল উলুম মাদ্রাসায় ১৯৮৭ সালে লেখাপড়া সম্পন্ন করেন।

প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার পাশাপাশি মাওলানা সাদ কান্ধলভি আধ্যাত্মিক সাধনায়ও আত্মনিয়োগ করেন। তিনি দুজন মহান ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে খেলাফত লাভ করেন। তারা হলেন-সাইয়েদ আবুল হাসান আলি নদভি (রহ.) ও মুফতি ইফতিখারুল হাসান কান্ধলভি। তিনি মাত্র ১৯ বছর বয়সে খেলাফত লাভ করেন।

পারিবারিক সূত্রেই মাওলানা সাদ কান্ধলভি তাবলিগি কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। তাবলিগের কাজে তার শ্রম ও নিষ্ঠার কারণেই হজরত ইনামুল হাসান (রহ.) ১০ সদস্যের শূরা কমিটির অন্তর্ভুক্ত করেন এবং অনেক প্রবীণ ও বিজ্ঞ লোকের উপস্থিতিতে তাকে তিনজন আমিরে ফায়সালের একজন মনোনীত করেন।

২০১৪ সালের মার্চে মাওলানা জুবাইরুল হাসানের (রহ.) ইন্তেকালের পর মাওলানা সাদ একক আমিরে ফায়সাল হিসাবে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন।

এ সময় তার সঙ্গে আরও কয়েকজনকে ফায়সাল (সিদ্ধান্তদাতা) হিসাবে নিয়োগের দাবি করেন কেউ কেউ। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে তাবলিগ জামাতে মতপার্থক্য দেখা দেওয়ায় কয়েকজন সিনিয়র সদস্য নিজামুদ্দিন মারকাজ ছেড়ে চলে যান।

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম