আলেমদের উদ্দেশে আবদুল্লাহ মারুফী
দ্বীনি শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিন সর্বত্র
আশরাফ জিয়া
প্রকাশ: ০৬ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘পরিবর্তিত চলমান বিশ্ব শিক্ষাব্যবস্থায় কওমি মাদ্রাসা : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক শিক্ষা সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দের উচ্চতর হাদিস বিভাগের প্রধান আল্লামা আবদুল্লাহ মারুফী।
এতে দেশের গবেষক আলেম, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক ও প্রতিনিধিত্বশীল তরুণ আলেমরা উপস্থিত ছিলেন। সেমিনারে তরুণ আলেমদের উচ্চশিক্ষা ও কওমি মাদ্রাসার সিলেবাস নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দেন তিনি। তার বক্তব্য অনুলিখন করেছেন-আশরাফ জিয়া
বাংলাদেশের মাদ্রাসার শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে আমি পুরোপুরি অবগত নই, তবে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কওমি মাদ্রাসার সমাপনী শিক্ষার্থীদের মাস্টার্স সমমান দেওয়ার সংবাদ আমাকে অত্যন্ত আনন্দিত করেছে। এটি এ দেশের আলেম-ওলামাদের উন্নতির বহিঃপ্রকাশ ও বিরাট অর্জন।
সাধারণ ও দুনিয়াবী যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেমন-কলেজ, ইউনিভার্সিটি, মাদ্রাসার পরিবেশের সঙ্গে সেগুলোর পরিবেশের মিল নেই। আমরা প্রায়ই দেখি আমাদের মাদ্রাসার অনেক ছাত্র ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়। কিন্তু দুঃখের কথা হলো, সেই দ্বীনহীন পরিবেশে কখনো তারা হিনমন্যতার শিকার হয়ে তাদের দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে পড়ে।
অথচ তাদের সেখানে গিয়ে প্রভাব বিস্তার করার কথা ছিল। এর পেছনে কিছু ছাত্রকে তরবিয়ত ও দীক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের দুর্বলতাকে কারণ হিসাবে আমার মনে হয়।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহর বান্দাদের সঠিক পথের দিশা দেওয়া। এ জন্য প্রথম আমাদের নিজেদের দ্বীন, আমল এবং আকিদার ক্ষেত্রে পাকাপোক্ত হওয়া একান্ত জরুরি। আমাদের পূর্বসূরিরা সব সময় এ কথাই বলতেন, আমাদের ইলম অর্জন যেন কখনোই দুনিয়া লাভের উদ্দেশ্যে না হয়।
আমাদের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত-ক্ষণস্থায়ী দুনিয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে নিজের এবং অন্যদের চিরস্থায়ী আখেরাত সুন্দর করার ফিকির করা। দুনিয়ার ব্যাপারে আমাদের অন্তরে এ ধারণা বদ্ধমূল থাকা উচিত, (যেটা কুরআন-হাদিস এবং বুজুর্গদের সোহবত থেকে জানা যায়) যে, আমাদের রিজিক পৌঁছানোর দায়িত্ব আল্লাহতায়ালা নিয়েছেন।
আমাদের ব্যাপারে যেটা তিনি লিখে রেখেছেন সেটা আসবেই আর যেটা ভাগ্যে নেই সেটা আমরা কখনোই পাব না। যদি এ বিশ্বাস, তাকওয়া ও পরহেজগারির সঙ্গে নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রেখে আমাদের ছাত্ররা দাঈ হিসাবে ইউনিভার্সিটিতে যায় এবং সেখানে তারা পড়াশোনার পাশাপাশি দাওয়াতের মাধ্যমে অন্যদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করতে পারে তাহলে আমার মতে, এটা হবে এক বিরাট সাফল্য এবং এ বিষয়ে আমাদের চিন্তা করা উচিত।
কিন্তু সাধারণ বাস্তবতা এর পুরোপুরি উলটো হয়। সেখানে গিয়ে তারা প্রভাব বিস্তারের পরিবর্তে প্রভাব গ্রহণ করে বিগড়ে যায়। অথচ তাদের জন্য সেখানে গিয়েও কিন্তু ঠিক থাকা সম্ভব ছিল।
বিশেষ করে তাবলিগের মেহনতের কারণে সেটা এখন আরও সহজ হয়েছে। সুতরাং আমি বলতে চাচ্ছি, এ প্রেক্ষাপটে আমাদের কাজের পদ্ধতি দুটি হওয়া উচিত।
প্রথমটি হলো, শুরু থেকেই আমাদের সন্তানদের দ্বীনি শিক্ষা দেওয়া এবং তাদের এমনভাবে প্রস্তুত করা যে, ভবিষ্যতে কখনো কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে গেলে যেন তারা নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রেখে মন্দ প্রভাব গ্রহণের পরিবর্তে ভালো প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
এর বাইরে জনগণের যে বিরাট একটি অংশ তাদের সন্তানকে শুরু থেকেই স্কুল, কলেজে পড়ায়, তাদের প্রতি লক্ষ করে আমাদের দ্বিতীয় কর্মপন্থা হতে পারে, সকাল ও সন্ধ্যাকালীন মক্তব প্রতিষ্ঠা করা। যেখানে আমরা সেসব জেনারেল পড়ুয়া ছাত্রদের ধর্মীয় শিক্ষা দিতে পারব, ইসলামী শিষ্টাচার শিক্ষা দেব।
ইসলামের সৌন্দর্য তাদের সামনে তুলে ধরব। তাহলে, ইন্শাআল্লাহ এর প্রভাবে সে এখান থেকেই ইসলামী চেতনা, মূল্যবোধ ও ইসলামী স্বকীয়তার সঙ্গে বেড়ে উঠতে থাকবে এবং ভবিষ্যতে জেনারেল শিক্ষা তার ধর্মীয় মূল্যবোধে প্রভাব ফেলতে পারবে না।
এমনিভাবে আমরা বয়স্কদের পেছনেও মেহনত করতে পারি। অনেক বয়স্ক জেনারেল শিক্ষিত মানুষ আছেন যারা দ্বীন শিখতে চায়। যখন আমরা তাদের সে সুযোগটা করে দেব তখন সেটাও অনেক ফলপ্রসূ হবে ইন্শাআল্লাহ। তারা আমাদের থেকে দ্বীন শেখার পাশাপাশি আমরাও তাদের থেকে আধুনিক অনেক কিছু জানতে পারব। এটা আমাদের উভয়ের জন্যই উপকার বয়ে আনবে। এর জন্য আমরা ভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারি।
সর্বশেষ কওমি মাদ্রাসার সিলেবাস সংক্রান্ত কিছু কথা বলতে চাই। এতে সন্দেহ নেই যে, আমাদের সিলেবাসে পরিবর্তন আনা দরকার। পুরোনো কঠিন ও জটিল কিতাবগুলো এখন পড়ানোর প্রয়োজন নেই। মাইবুজি, সুল্লাম বুঝা এবং এর মর্মোদ্ধারের পেছনে সময় ব্যয় করার সময় বর্তমান তালেবে ইলমদের নেই। আমরা সিলেবাসকে সংক্ষেপেও পড়াতে পারি। যেমন মানতেকের (তর্কশাস্ত্র) কোনো একটি গুরুত্বপূর্ণ কিতাব পড়িয়ে দেওয়া হলো, যার দ্বারা শিক্ষার্থীরা মানতেকের পরিভাষাগুলো শিখে গেল।
ফালসাফার (দর্শনশাস্ত্র) কোন একটি ছোট কিতাব পড়িয়ে দেওয়া হলো, যার দ্বারা ফালসাফা সম্পর্কে তাদের ধারণা তৈরি হয়ে গেল। এমনকি নাহু-সরফের ক্ষেত্রেও। আমরা চাইলে এমনটা করতে পারি।
আমাদের ছাত্রদের বাংলাভাষায় লিখিত ভালোমানের, উপকারী সরফের কোনো কিতাব অথবা শুধু ‘ইলমুস সিগা’ কিতাবের বাংলা তরজমা পড়িয়ে বাকি সময় তাদের অনুশীলন করাতে পারি। এতে তার মূল্যবান একটি বছর বেঁচে যাবে। সরফ শেখার জন্য অনেক কিতাব পড়ার প্রয়োজন নেই। ভালোমানের একটি কিতাব পড়ানোই সরফ শেখার জন্য যথেষ্ট।
নাহুর ব্যাপারেও একই কথা। ‘হেদায়াতুন্নাহু’ নাহুশাস্ত্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কিতাব। নাহু শেখার জন্য শুধু এ কিতাবটি পড়ানোই যথেষ্ট। শুধু এ কিতাব পড়ানোর পাশাপাশি তামরিন করালে এক বছরেই নাহুতে আমাদের ছাত্রদের পাণ্ডিত্য অর্জন করা সম্ভব। এর পেছনে কয়েকবছর ব্যয় করার প্রয়োজন নেই।
তা ছাড়া সবকিছুর মূলে যেহেতু ভাষা, তাই দ্বীনি দাওয়াত প্রচারের লক্ষ্যে মাতৃভাষার পাশাপাশি ইংরেজিতে দক্ষ হওয়ার বিকল্প নেই। কারণ বর্তমানে আরবির পাশাপাশি ইংরেজি আন্তর্জাতিক ভাষা হিসাবে সারা দুনিয়ায় স্বীকৃত। সুতরাং আমরা আমাদের বাচ্চাদের এভাবে গড়ে তুলতে পারি, যেন তারা বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি ও আরবি উভয় ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারে। তাহলে যে কোনো সমাজে গিয়ে তারা নির্দ্বিধায় আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দিতে পারবে ইন্শাআল্লাহ।
আল্লাহতায়ালা আমাদের কথাগুলো বোঝার ও এর ওপর আমল করার তৌফিক দান করুন। আমিন।