
প্রিন্ট: ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:২০ পিএম
মলাট বৃত্তান্ত
একদিনের বাঙালি
পহেলা বৈশাখের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাপারটা কী বল তো? * বৈশাখী ভাতা! এককালীন দিবা, নাকি কিস্তিতে?

শফিক হাসান
প্রকাশ: ১৩ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আরও পড়ুন
সৌজন্যবশত মৌখিকভাবে দাওয়াত দেওয়ার মাসুল এটা! রমিজ এভাবে হাজির হবে, তাও পহেলা বৈশাখের দিনে? চিন্তারও অতীত ছিল মাহবুবের। কল করল সে-‘ভাইজান, আমি ঢাকায়। কোথায় আসব?’
চিনতেও একটু বেগ পেতে হয়েছে মাহবুবের। বলল, ‘এখন বাসার দিকে আসতে পারবেন না। বৈশাখী উৎসব উপলক্ষ্যে সব রাস্তাই বন্ধ। আপনি বরং রমনা পার্কে থাকুন। আমি আসছি সেখানে।’
‘আচ্ছা, ভাই। সকালে আসেন।’
‘আরে না, বিকাল হবে না। এখনই রওনা দিচ্ছি।’
‘আমি বলেছি সকালে, মানে তাড়াতাড়ি আসুন!’
খাওয়া ভুলে নাশতার টেবিলে ঝিম মেরে বসে রইল মাহবুব। পাতার ওপর দিয়ে লতা গেছে, তাকেও বলে আত্মীয়! এমন এক লতায়-পাতায় গ্রাম সম্পর্কের আত্মীয় রমিজ সেদিন কল করেছিল। ভদ্রতাবশত মাহবুব বলেছিল, ‘কখনো ঢাকায় এলে দেখা করে যাবেন।’ সেটার এমন দশা করবে, বুঝতে পারেনি সে। কোনটা মুখের কথা আর কোনটা মনের- গ্রামের লোকজন বুঝতে পারে না। অবশ্য একমাত্র ঢাকাবাসীই বুঝতে পারে ‘মৌখিক মধুমাখা আচরণ। দীর্ঘদিনের কৌঁসুলি অবস্থানে তাদের এসব শিখে নিতে হয়। সাপ মরল, লাঠিও না ভাঙল!
সত্যিই আজ রাস্তায় কোনো গণপরিবহণ নেই। থাকবে কী করে, হয়তো চালক-কন্ডাক্টররাও সপরিবারে মেলায় চলে এসেছে বাসন্তি রং পোশাক পরে! রমিজকে খুঁজে পেতে কষ্ট হলো। মোবাইল ফোনে নেটওয়ার্ক ভালো কাজ করছে না। জীবনে প্রথম দেখা। তাতেই রমিজ সরাসরি খাওয়া-দাওয়ায় চলে গেল। বলল, ‘চলেন ভাইজান, বরফমিশ্রিত শরবত খাই। ঘামে গোসল করে ফেললাম। এখন বরফ ঢেলে গরমকে সেদ্ধ করব।’
দুই গ্লাস লেবুর শরবত আজ ৪০ টাকা। অন্যদিন ২০ টাকাতেই মিলত। টাকা পরিশোধ করার পর রমিজ দোকানদারের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আরেক গ্লাস দিন। জিনিসটা ভালোই বানিয়েছেন। গরম জানে ঠান্ডার মূল্য কী!’
তখনো গান চলছে। রমনার বটমূলে বাউলরা জুড়ে দিয়েছে তারস্বরে সংগীতায়োজন। মাহবুব বলল, ‘চলেন, গান শুনি।’
ভেসে আসা গানের বাণী শুনে থমকে দাঁড়াল রমিজ। বলল, ‘ভাইজান, বেয়াদবি মনে না করলে একটা প্রশ্ন করতে চাই।’
‘দুইটা পর্যন্ত করতে পারেন।’
‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো-গান এখন কেন! বৈশাখ তো চলেই এসেছে। তাহলে তাকে আবার ডাকা হচ্ছে কেন?’
‘এটা রবীন্দ নাথের গান। গুরুর শিষ্যরা নিশ্চয়ই কম বোঝেন না!’
‘তিনি নিশ্চয়ই চৈত্র মাসে গানটা গেয়ে বৈশাখকে আহবান করতে বলেছেন। বৈশাখের প্রথম দিনে তাকেই আবার ডাকার মানে কী?’
সন্তোষজনক জবাব খুঁজে না পেয়ে মাহবুব বলল, ‘তাহলে গান শোনার দরকার নেই। আমরা অন্যদিকে যাই।’
কিছু হাঁটতেই একাকিনী তরুণীর সাক্ষাৎ পাওয়া গেল। গাঁদাফুল জড়িয়েছে গলায়। রমিজ উৎসাহী গলায় বলল, ‘আপা, আপনার শাড়িটা সুন্দর।’
তরুণী হেসে জবাব দিল, ‘ধন্যবাদ ভাই। আপনার শার্টটা আরও সুন্দর।’
‘জি আপা। এলাকার বাজার থেকে কিনেছিলাম। নগদ আড়াইশ টাকায়।’
‘বাকিতে কিনলে নিশ্চয়ই তিনশ টাকা রাখত?’
‘বাকি দিতই না!’
আলাপ জমে উঠেছে। মাহবুব হতভম্ব হয়ে শুনছে বাতচিত। রমিজ প্রসঙ্গ পালটাল এবার- ‘আপনার কি বিয়ে হয়েছে?’
তরুণী মিষ্টি করে হাসল-‘বিয়ে না হলে কী করবেন? আমাকে বিয়ে করতে চাইবেন নাকি!’
‘চাইতেই পারি। আপনি মনকাড়া সুন্দরী!’
‘যাকে আপা ডাকছেন, তাকে বউ ডাকতে লজ্জা করবে না?’
‘না বউ... স্যরি, আপা। লজ্জা-শরম আমার একটু কম।’
‘পুরো জাতিরই যেখানে লজ্জা নেই, আপনার থাকবে কীভাবে!’
আলাপ আর বাড়তে না দিয়ে তরুণী অন্যদিকে পা বাড়াল।
মাহবুব রাগতস্বরে বলল, ‘এসব কী শুরু করেছেন? ইভটিজিংয়ের অভিযোগ করলে আমাদের অবস্থাটা কী হবে ভেবে দেখেছেন?’
‘মাথা ঠিক নাইরে ভাই। আপনি এলেন এখন। আমি আরও আগে থেকেই দেখছি বউমেলা!’
‘বউমেলা মানে?’
‘সুন্দরীমেলা। এটার নাম বৈশাখী মেলা না দিয়ে বউ-সুন্দরীমেলা দিলেই যথার্থ হতো।’
‘এরা সবাই অন্যের বউ, অন্য কারও প্রেমিকা। অন্য কারও ভবিষ্যৎ।’
‘আপনার-আমার বউয়ের হিস্যা নাই এখানে?’
‘না। আমার বউ বাসায়। যদি জানতে পারে আমি এসব কথা শুনেছি, অন্য মেয়েদের দেখেছি, খবর করে ছাড়বে!’
‘বৈশাখী মেলাটা কোন দিকে, ভাইজান?’
‘এটাই তো!’
‘আম মেলায় আম পাওয়া যায়, শাড়ি মেলায় শাড়ি। বৈশাখী মেলায় বৈশাখ বিক্রি হচ্ছে না কেন! কোনো স্টল চোখে পড়ল না।’
‘পাগলাটে কথাবার্তা বলছেন কেন। এটা আপনার গ্রাম নয়।’
‘ঠিক বলেছেন, ভাইজান। বরং গ্রামেই চলে যাই। সেখানে বউমেলার আয়োজন করব। সুযোগমতো নিজের বিয়েটাও হয়ে যাক!’
‘বিয়ে করবেন কেন?’
‘না করেইবা কী করব? ওই আপার সঙ্গে আপনার যদি কখনো দেখা হয়, জিজ্ঞেস করে দেখবেন পাত্র হিসাবে আমাকে পছন্দ করবে কিনা!’
দূরের কোনো বাঁশিতে ভেসে এল
গানের সুর-বৈশাখে হলো দেখা/ চৈত্রে পরিচয়...।