
প্রিন্ট: ০৭ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:০০ এএম

প্রকাশ: ৩০ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আরও পড়ুন
প্যারিসে রেস্তোরাঁয় বসে আছি। নিতান্ত একা; যাদের আসার কথা ছিল তারা আসেননি। এমন সময় এক অতি সুপুরুষ এসে আমারই টেবিলের একখানা শূন্য চেয়ারে আসন গ্রহণ করলেন-অবশ্য প্রথমে ফরাসি কায়দায় বাও করে, আমার অনুমতি নিয়ে।
নিতান্ত মুখোমুখি তদুপরি কার্তিকের মতো চেহারাখানা বারবার আমার মুগ্ধ চোখ তার চেহারার দিকে ধাওয়া করছিল। তিনিও নিশ্চয়ই এ রকম পরিস্থিতিতে জীবনে আরও বহুবার পড়েছেন। কী করতে হয় সেটা তার রপ্ত আছে।
সিগারেট বাড়িয়ে দিয়ে বলছেন, ‘ইচ্ছে করুন।’
ধন্যবাদ জানালুম।
জিজ্ঞেস করলেন, ‘ফরাসিটা বলতে পারেন তো? আমি তো আর কোনো ভাষা জানি নে।’
বললুম, ফরাসি ভাষাটা সবসময় ঠিক বুঝতে পারি কিনা বলা একটু কঠিন। এ মনে করুন, কোনো সুন্দরী যখন প্রেমের আভাস দিয়ে কিছু বলেন, তখন ঠিক বুঝতে পারি। আবার যখন ল্যান্ডলেডি ভাড়ার জন্য তাগাদা দেন, তখন হঠাৎ আমার তাবৎ ফরাসি ভাষাজ্ঞান বিলকুল লোপ পায়।’
ফরাসি ভদ্রলোক হেসে বললেন, ‘সে না হয় হলো। কিন্তু বলুন তো, শব্দার্থ আপনি ঠিক ঠিক বুঝতে শিখেছেন? এই যদি আমি বলি যে, আমি “জার্নালিস্ট” তাহলে তার মানে কী হলো?’
একগাল হেসে বললুম, ‘তা আর জানি নে? তার মানে হলো আপনি খবরের কাগজে লেখেন।’
‘উঁহু হলো না। ঠিক তার উলটো; আমি লিখি নে। সে কথা যাক। আরেকটি উদাহরণ দি। আমি যদি বলি, ‘আচ্ছা তা হলে আরেকদিন দেখা হবে’, তবে তার মানে কী?’
আমি এবারে আরেক গাল আর হাসলুম না; বললুম, ‘তার মানে আরেক দিন দেখা হবে, এতে
আর অস্পষ্টতাটা কোথায়?’
বললেন, ‘ফেল!’ তার মানে হলো, ‘আপনি এবারে দয়া করে গাত্রোৎপাটন করুন’।
খুশি হয়ে বললুম, হ্যাঁ হ্যাঁ, আমরাও যখন বাংলায় বলি, ‘এবার তুমি এসো।’ তখন তার অর্থ ‘তুমি এবারে কেটে পড়’।’
‘ঠিক ধরেছেন। তাই বলছিলুম, আমি জার্নালিস্ট; কিন্তু না-লেখার জন্য লোকে পয়সা দেয়। খুলে কই।
‘এই ধরুন কয়েক মাস আগে খবর পেলুম, আমাদের ডাকসাইটে রাজনৈতিক মসিয়ো অনুস্বার একটি রমণীর সঙ্গে ঢলাঢলি করছেন। ওদিকে বাজারে তার সুনাম আর খ্যাতি অতিশয় ধর্মভীরুরূপে-কোথায় জানি গির্জা মেরামত করে দিয়েছেন, কোন সেন্টের জন্মদিনে জাব্বাজোব্বা পরে পারবে পয়লা নম্বরী বনেছিলেন এরকম ধারা কত কী? খবরটা শুনে বললুম, ‘বটেরে স্যাঙাৎ, দাঁড়াও তোমাকে দেখাচ্ছি।’
‘করলুম কি, লাগলুম তত্ত্ব-তালাশে। ডাক্তাররা নাকি এক্স-রে দিয়ে পেটের মধ্যিখানের ছবি তোলেন? স্রেফ গাঁজা; তার চেয়ে ঢের ঢের বেশি নাড়িভুঁড়ির খবর মেলে কয়েক আউন্স রুপো ঢেলে, সোনা ঢাললে তার চেয়েও ভালো।
‘সেই নর্তকীর নামধাম সাকিন ঠিকানা হাড়হদের তাবৎ খবর পেয়ে গেলুম এক সপ্তাহর ভিতর।’
সিগারেট ধরাবার জন্য কথা বন্ধ করে একটুখানি ভেবে নিয়ে বললেন, কিন্তু এ কর্মে একটুখানি খাবসুরত হতে হয়। আমি-বলে থামলেন।
আমি বললুম, ‘আপনার চেহারা সম্বন্ধে কী আর বলব।’
বাধা দিয়ে বললেন, ‘থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ। তারপর করলুম কী জানেন, একপ্রস্ত উত্তম সুট পরে, গোঁফে আন্তর মেখে লেগে গেলুম নর্তকীর পেছনে।
‘আমি অবিশ্যি নর্তকীকে প্রিয়ারূপে চিরকালের জন্য জিতে নিতে চাইনি। মসিয়ো অনুস্বার তাকে নিয়ে প্রেমসে প্রেমের ঢলাঢলি করুন আমার তাতে নস্যি। আমি শুধু চাই একটুখানি খবর।
‘কিছুটা ভাবসাব হয়ে যাবার পর আমি আভাসে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলুম যে, তিনি যদি অন্য সূত্র থেকে অর্থাৎ অনুস্বারের কাছ থেকে টাকা মারেন তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। তিনি দু ঘোড়া না চড়ে আড়াইশটা চড়ুন আমি আপনাদের দেশের ফকিরের মতো নির্বিকার। আমি একটুখানি প্রেমেই খুশি।
কাজেই আস্তে আস্তে প্রেমের নেশায় বানচাল হয়ে নর্তকী খবর দিয়ে ফেললেন, কোন হোটেলে কবে তারা গোপনে স্বামী-স্ত্রী রূপে বাস করেছেন, কোন ইয়েটে কবে ক’দিন ক’রাত্তির কাটিয়েছেন। সেই খেই ধরে তাবৎ গোপনীয় খবর জোগাড় করে গেলুম, অনুস্বারের কাছে। তাকে বললুম, তার জীবনী লিখতে চাই, তাতে অবশ্য নর্তকী সম্পর্কীয় কিঞ্চিৎ প্রামাণিক সংবাদও থাকবে। তবে কিনা, কিছু অর্থ পেলে আমি এসব ছাপব না।’
অনুস্বার জউরি এবং ঘড়েল লোক। যেসব হোটেলে জাল সই করেছেন তার ফোটোগ্রাফ দেখে বুঝলেন আমিও কাঁচা নই। তারপর বললেন, লিখিনি বলেই তো টাকা পেলুম, হাজার দশেক। যাকগে, এখন আমি চললুম।’
ব্যাপারটা বুঝতে আমার মিনিট খানেক লাগল। তখন ছুটে গিয়ে তাকে বললুম, ‘এটা কি তবে ব্ল্যাক-মেলিং হলো না?’
হেসে বললেন, ‘অর্থাৎ ‘না লিখিয়ে জার্নালিস্ট’। তাই তো বলছিলুম, ভাষা জিনিসটি অদ্ভুত।’
আমি স্বয়ং জার্নালিস্ট আঁতকে উঠলুম।