আমি একটি কান। রক্ত মাংসের গড়া জীবন্ত একটি কান। আমি খুব সুন্দর। গায়ের রং মাঝারি রঙের ফর্সা। উজ্জ্বল ফর্সা ও শ্যামলা রঙের মাঝামাঝি। যাকে বলে দুধে আলতা গায়ের রং। আমার মালিক এক সুন্দর নারী। সেও দেখতে খুব সুন্দর। যার কান এত সুন্দর, সে সুন্দর না হয়ে পারে! আমি গর্বিত, কারণ আমি ন্যাচারাল সুন্দর। আমার মালিক কিন্তু আমাকে ছাড়া অপরিপূর্ণ। আমি তার শরীরের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমি তার অপরিহার্য অঙ্গ। আমার গায়ের গড়ন খুব আকর্ষণীয়। লম্বা ও খাড়া। আমাকে দেখে অনেকেই ফিদা হয়। অনেক মেয়েই আমার মালিককে বলে, ‘আহা! তোমার কান দুটো কতই না সুন্দর।’ এ রকম প্রশংসা শুনতে আমার খুব ভালো লাগে। আমি তখন আবেগে আপ্লুত হয়ে যাই। নিজের অজান্তেই আমার চোখে পানি চলে আসে। তোমরা হয়তো অবাক হচ্ছো। আরে! কানের আবার চোখ আছে নাকি। শোনো, তোমাদের বলছি; আমার চোখ, নাক, মুখ সবই আছে, কিন্তু তোমরা দেখতে পাও না। আমি ঠিকই কাঁদি, কিন্তু সে কান্না তোমরা কখনোই শুনতে পাও না। আমি ব্যথা পেলে অবশ্য আমার মালিকও ব্যথা পায়। কিন্তু সেও আমার হৃদয়ের কান্না শোনে না। এমনকি একটু উপলব্ধিও করে না।
আমি তখন খুব ছোট। আমার মালিকের বয়স তখন দশ বছর। তোমরা তো জানোই যে, আমার বয়স ও আমার মালিকের বয়স একই। আমরা সমবয়সি। কারণ আমরা একইসঙ্গে পৃথিবীতে আগমন করেছি। তোমরা তো জানোই কান টানলে মাথা আসে। আমার মালিকের মাথা থাকলে আমিও থাকব। আর আমার পাওয়ার কত দেখেছো! আমাকে টানলে মাথাকেও আমার সঙ্গে আসতে হয়। অতএব আমার সম্পর্কে বুঝেশুনে কথা বলা উচিত। তবে সমস্যাও রয়েছে। কোনো দুর্ঘটনাজনিত কারণে আমি আলাদা হলে আমার যেমন অপমৃত্যু ঘটবে, তেমনি তখন কান টানলে আর মাথা আসে না। এ ব্যাপারে মানুষ আবার খুব মজা করে থাকে। সংশপ্তক নামে একটা ধারাবাহিকে কান কাটা রমজান নামে একটা চরিত্র আছে। তোমরা চাইলে নাটকটা দেখতে পারও আবার বইটাও পড়তে পারও।
বাংলা ব্যাকরণে আমাকে নিয়ে খুব আলোচনা করা হয়। আমাকে নিয়ে একটা বাগধারা আছে, ‘কানকাটা’। যার অর্থ হলো বেহায়া। কাউকে কানকাটা বলা মানে লোকটাকে বেহায়া বলে ডাকা। এটা কিন্তু নিন্দা অর্থে ব্যবহৃত হয়। আবার ‘কানকথা’ মানে হলো শোনা কথা বা গুজব। ‘কান দেয়া’ মানে শোনা। ‘কানপড়া’ মানে দুষ্ট বুদ্ধি দেওয়া। কারও কানপড়ায় কান দিতে নেই। এমন আরও অনেক কিছু রয়েছে।
যাক যেটা বলছিলাম। দশ বছর বয়সে আমার কান ফুটা করে দেওয়া হয়। কান ফুটা করার উদ্দেশ্য হলো আমাকে গহনাবৃত করা। এক বয়স্ক মহিলা এসে একটা সুঁই দিয়ে আমার কান দুটো ফুটা করে দিলেন। আমি ব্যথায় চিৎকার দিয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দিলাম। আমার কান্না কেউ শুনতে পায়নি, তবে আমার মালিকের কান্না সবাই শুনতে পেয়েছে। কেউ আহা আহা বলেছে। কেউ উহু উহু বলেছে। কেউ বলেছে মেয়ের ন্যাকামি দ্যাখো। আমাদের মনে হয় কান ফুটা করায়নি। বেশ কয়েকদিন আমি দুইটা সুতা আমার শরীরে ঝুলিয়ে কাটিয়েছি। তারপর আমার গায়ের ক্ষত ও ব্যথা শুকালে আমাকে দুইটা স্বর্ণের দুল পরিয়ে দেওয়া হলো। স্বর্ণ পরিধান করে আমার মালিকের সে কী আনন্দ। কিন্তু আমার এদিকে জীবন যায় যায়। এমনিই একটা ভারী জিনিস ঝুলে আছে, তার ওপর আবার টান লাগলে খুব ব্যথা লাগে।
এখন আমি অনেক বড়। আমার মালিকের সৌন্দর্যে সবাই বিমোহিত। আমার মালিক সারাদিন কেবল সাজুগুজু নিয়েই ব্যস্ত থাকে। চোখ, মুখ, নাক, চুল, নখ, হাত, জামা-কাপড়ের সঙ্গে আমি কানও তার গুরুত্ব থেকে বাদ যাই না। আমাকে নিয়ে সে এখন আরও বেশি চিন্তা করে। আমার বাহ্যিক সৌন্দর্যের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য নিয়েও সে খুব সচেতন। আমাকে কীভাবে আরও বেশি আকর্ষণীয় করা যায়। নিয়মিত আমার নাড়িভুঁড়ি পরীক্ষা করে। আমার হৃদযন্ত্র, বৃক্ষ সবকিছুতেই তার সচেতনতা।
আমাকে খুব বেশি আকর্ষণীয় করার জন্য সে বিউটি পার্লারে যায়। বান্ধবীদের কাছ থেকে টিপস নেয়। কোন বান্ধবী কানে কী পরে তা ভালোভাবে খেয়াল করে। সিনেমা-নাটকে নায়িকারা কানে কী পরে তা ফলো করে। কানে কী ডিজাইন করে সেই ট্রেন্ড ফলো করে। চাঁদ, তারা, সূর্য ও বিভিন্ন রিং দিয়ে আমাকে সে রীতিমতো অলঙ্কৃত করে। এত অলঙ্কারের ভিড়ে এখন আর আমাকে ভালোমতো দেখাই যায় না। অলঙ্কারের ভারে এদিকে আমার জান যায় যায় অবস্থা। কিন্তু আমার মালিকের সেদিকে কোনো দৃষ্টি নেই। সে তার সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ নিয়ে ব্যস্ত। অথচ এদিকে যে একটি অত্যাচারিত কান তাকে ডেকে ডেকে বলছে, ‘বোন আমাকে বাঁচাও; আমাকে বাঁচাও’ সেদিকে তার কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। সে আছে তার কানের প্রদর্শনী নিয়ে।
খিলগাঁও, ঢাকা

