আলেকজান্ডার ব্যারন-এর হাসির গল্প
সবজান্তা
ভিনদেশি হাসির গল্প

প্রকাশ: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রাইভেট কোয়েলশ। তার সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয় ট্রেনিং ডিপোতে। সেনাবাহিনীতে যোগদানের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই সৈনিকরা ইউনিফর্ম, রাইফেল আর অন্যান্য জিনিসপত্রের সঙ্গে একটা ডাকনামও লাভ করে। প্রাইভেট কোয়েলশের ঝুঁকে পড়া ঢ্যাঙা শরীর আর হর্ন রিমড চশমার ফাঁকে ভ্রুজড়ানো দৃষ্টি দেখলে কারোরই বুঝতে অসুবিধা হয় না, কেন তাকে ‘প্রফেসর’ উপাধি দেওয়া হয়েছে। দু-একজনের মনে যদি এ বিষয়ে ক্ষীণ সন্দেহ থাকে, মিনিট পাঁচেক কোয়েলশ এর বক্তৃতা শুনলে সে সন্দেহ চিরদিনের মতো দূর হয়ে যায়।
মাস্কেট্রির প্রথম পাঠের কথা। আমরা সবাই নর্থ-ওয়েস্ট ফ্রন্টিয়ারের রিবন পরা এক সার্জেন্টকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিলাম। গাঢ় কিশমিশ রঙা মানুষটি আমাদের বোঝাচ্ছিলেন সার্ভিস রাইফেলের মেকানিজম। তিনি বললেন, ‘রাইফেল থেকে নিক্ষিপ্ত বুলেটের ছোটার গতি হলো প্রতি সেকেন্ডে দু’হাজার ফুটেরও বেশি।’
এমন সময় একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘প্রতি সেকেন্ডে দু’হাজার চারশ চল্লিশ ফুট।’ কথাটা বলেছে প্রফেসর।
‘ঠিক।’ সার্জেন্ট নিচু স্বরে বলেই আবার ফিরলেন মাস্কেট্রির পাঠে। পাঠ শেষ করে সম্ভবত প্রতিশোধ নেওয়ার মনোভাবে একের পর এক প্রশ্ন করতে লাগলেন প্রফেসরকে। প্রত্যেকটা প্রশ্নের ফটাফট উত্তর দিল প্রফেসর। প্রযুক্তিগত ব্যাখ্যা, রাইফেলের পার্টস, সেগুলো যত্ন নেওয়ার কৌশল সবই তার মুখস্থ।
সার্জেন্ট জানতে চাইলেন, ‘আগে কোনো ট্রেনিং নিয়েছিলে?’
প্রফেসর জবাব দিল, ‘না সার্জেন্ট, এসবই আমি জেনেছি মাথা খাটিয়ে বই পড়ে।’
প্রফেসরের সঙ্গে আমাদের প্রথম সাক্ষাৎটা এমনই ছিল। শিগ্গির যে সে কমিশন পাবে, সে বিষয়ে তার মনে কোনো সন্দেহ নেই।
উচ্চাশা পূরণের জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে লাগল প্রফেসর। ট্রেনিং ম্যানুয়াল জোগাড় করে পড়তে লাগল সে রাত জেগে। ইন্সট্রাক্টরদের কান ঝালাপালা করে ফেলল প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে।
যখন আমাদের কেউ একটা ভুল করে, সবার সামনে সেই ভুল শুধরে দেয় প্রফেসর। আমাদের কারও ভেতরে হালকা জ্ঞানের আভাস দেখা দিলে ভারী জ্ঞানের অবতারণা করে সেটাকে চাপা দিয়ে দেয়।
এয়ারক্রাফট চিনতে পারলে গর্ববোধ করতাম আমরা। একদিন যখন হাঁটাহাঁটি করছি, অনেক ওপর থেকে কানে ভেসে এলো একটা প্লেনের গুঞ্জন। প্রখর সূর্যের আলোতে যখন কেউই প্লেনটাকে দেখতে পেলাম না, তখন ওপরদিকে মাথা না তুলেই প্রফেসর বলল, ‘ওটা নর্থ আমেরিকান হাভর্ট ট্রেনার। ইঞ্জিনের কর্কশ শব্দে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।’
আমাদের মতো সাধারণ বুদ্ধির মানুষ প্রফেসরের সঙ্গে পাল্লা দেয় কীভাবে?
তবে আমরা কেউই গরমের ঝিম ধরানো সেই বিকালের কথা ভুলব না, যেটি প্রফেসরের জীবনের মোড় সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে দিয়েছিল।
সেদিন আমাদের হ্যান্ড গ্রেনেডের পাঠ দিচ্ছিলেন কর্পোরাল টার্নবুল। বয়সে তরুণ হলেও তিনি সাধারণ কেউ নন। আমাদের চোখে তিনি বীর।
‘তোমরা দেখতে পাচ্ছো হ্যান্ড গ্রেনেডের গায়ে অনেক খোপ আছে।’ বললেন কর্পোরাল টার্নবুল।
‘চুয়াল্লিশ।’
‘কী?’ কর্পোরাল তাকালেন কাঁধের ওপর দিয়ে।
‘চুয়াল্লিশটা খোপ!’ তার দিকে তাকিয়ে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে বলল প্রফেসর।
কর্পোরাল কিছু না বলে ভ্রু কুঁচকালেন। আবার ক্লাস নেওয়ার জন্য মুখ খুললেন তিনি।
‘আরেকটা কথা কর্পোরাল।’ পাথরের মতো জমে গেলাম আমরা সবাই। আবার কথা শুরু করেছে প্রফেসর, ‘আলোচনাটা গ্রেনেডের পাঁচটা বৈশিষ্ট্য দিয়ে শুরু করলে ভালো হতো না?’
এবার জ্বলে উঠল কর্পোরালের চোখ, ‘বেশ, আলোচনাটা তাহলে তুমিই করো।’ বলে হ্যান্ড গ্রেনেডটা ছুড়ে দিলেন প্রফেসরের দিকে। লজ্জার কোনো চিহ্ন দেখা গেল না প্রফেসরের মুখে। প্রফেসরের বক্তৃতা শেষ হলে কর্পোরাল বললেন, ‘ধন্যবাদ প্রাইভেট কোয়েলশ। এবার যথাস্থানে ফিরে যাও।’ বিদায় নেওয়ার জন্য আমরা সবাই লাইনে দাঁড়াতেই মুখ খুললেন কর্পোরাল।
‘হয়তো শুনেছ, প্লাটুন অফিসার আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন, তোমাদের ভেতর থেকে একজনকে বেছে নিতে। পদোন্নতির সময় এসে গেছে। অনেক ভেবেচিন্তে দেখলাম, সবচেয়ে যোগ্য হলো প্রাইভেট কোয়েলশ।’ রান্নাঘরের স্থায়ী দেখাশোনার দায়িত্ব তাকেই দেওয়া হলো।
পরে অনেকদিন এটি নিয়ে রসিকতা করা হয়েছে। এ ঘটনার ক’দিন পর ক্যান্টিন থেকে ফিরছিলাম আমি আর আমার এক বন্ধু। খোলা দরজা দিয়ে দেখতে পেলাম, দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে কোণঠাসা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তিন রাঁধুনি; আর রান্নাঘরের ভেতর থেকে ভেসে আসছে সুপরিচিত একঘেয়ে কণ্ঠস্বর।
‘নাহ, তোমাদের আলু ছোলার এ জঘন্য অবৈজ্ঞানিক আর অস্বাস্থ্যকর পদ্ধতি সহ্য করব না। এতে করে কত মূল্যবান ভিটামিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, সে বিষয়ে তোমাদের জ্ঞান অর্জন করাতে হবে।’
ওরে বাবা রে, আবার সেই জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা!